হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
আমাদের ঘন মেঘদূত নেমে আসত কলকাতায় বা যাদবপুরে, রাখালদা বা সত্যেনদার ক্যান্টিনে— ‘তুমি এলে/অনেকদিনের পরে যেন বৃষ্টি এল, অনেক কথা মনে হল এলোমেলো…’ যে তরুণটি কোনও দ্রুতগামিনী সুনয়নার দিকে এই শব্দগুলি ছুড়ে দিত, সে জানত আমাদের বহু যুগের ও পার হতে কোনও কালীদাস দেখা দেবেন না। কিন্তু আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখবেন এক জন বাঙালি, সরস্বতী স্বয়ং যাঁর কণ্ঠে, সেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। যোগমায়া দেবী কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে শ্যামলা রঙের লাজুক মেয়েটি উল্টো দিকের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা কোনও আকুল কিন্নরকে কি দ্বিধাকম্পিত আশ্বাস দিত না, পথ হারাব বলেই এবার পথে নেমেছি?
পুরো ষাটের দশক জুড়ে মহামায়া লেনের ঘুপচি রান্নাঘরে মুসুরির ডালে ফোড়ন দিয়ে অথবা শ্রাবণের পুঞ্জমেঘের দিকে তাকিয়ে মহাকরণের কনিষ্ঠ কেরানি যা ভেবেছে তা-ও তো হেমন্ত কণ্ঠই। ‘আমি ঝড়ের কাছে রেখে এলাম আমার ঠিকানা।’ এমন যে রবীন্দ্রনাথ, তিনিও তো আশ্রমিক আভিজাত্য থেকে মধ্যবিত্তের গ্রামোফোন রেকর্ড আর পাড়ার পৌষমাসের জলসায় ঠাঁই পেলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো কিন্নর, হারমোনিয়াম সহযোগে ‘শুধু তোমার বাণী নয় গো’ গাইলেন বলেই। যারা সুচিত্রা-উত্তম, কচুরি-ছোলার ডাল, চুনি– বলরামের বাইরে যেতে চাইত না, তারাও মর্মে মর্মে টের পেল আমার ঘরে থাকাই দায়! সারা ভারতে এখনও বিয়ের ব্যান্ডপার্টি, আপনি চান বা না চান, বাজাবেই হেমন্ত সুরারোপিত ‘নাগিন মেরা মন দোলে রে’ আর হ্যারিসন রোড পাড়ায় মেহবুবা ব্যান্ডে ‘নিঝুম সন্ধ্যায় ক্লান্ত পাখীরা’ তো ঠাকুর বিসর্জনই হোক আর শিবরাত্রিই হোক, নেমন্তন্নে শুক্তোর মতো পাতে পড়বেই। মোট কথা, গত ষাট বছর হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছাড়া আর কেউই বাঙালি আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার কানের ভিতর দিয়ে মর্মে এত তীব্র ভাবে প্রবেশ করে প্রাণ আকুল করে তোলেননি।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে এগুলো জানেন?
বাঙালির কি গায়ক ছিল না? চিন্ময় লাহিড়ী বা ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কথা যদি ছেড়েও দিই, প্রায় সহযাত্রী মান্না দে ও কিশোর কুমারের কথা কি আমাদের মনে পড়বে না? নিঃসন্দেহে তাঁরা প্রতিভাবান। জনস্বীকৃতিতেও তাঁদের নাম আকাশছোঁয়া। তবু হেমন্ত নির্বিকল্প ও অনন্য। স্বরলিপির চতুরালি, রাগের উত্থানপতন পন্ডিতদের জন্য, হেমন্তর গলা শুনলেই বাঙালির মনে হয় নারী, নক্ষত্র, ঋতুদল মধুলীনা। কত সিনেমা শুধু হেমন্তকে সম্বল করে দুর্গম পথে পাড়ি দিয়েছে।
‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ অন্তত ‘দেবীকাহিনী’, ভাবুন সেখানেও ছড়িদার অনিল চট্টোপাধ্যায় ‘পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহভরা কোলে তব’ বলামাত্র মনে হয়, এই মরুবালুরাশি মরীচিকাসম— দিগবধূরা ধারাস্নান করছে। মনে আছে ‘শেষ পর্যন্ত’, একটি অকিঞ্চিৎকর ছায়াছবি। নায়িকা বলতে সুলতা চৌধুরী। তেমন ভূ-বৈচিত্র্য, ইন্ডোর সেটের চাকচিক্য কিছুই নেই। পুরীর সাবেকি সমুদ্র আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানের লাবণ্য সে ছবিকে তুমুল ভাবে উতরে দিল। সেই যে ভুলের বালুচর বুকে এসে বাসা বাঁধল, সে রকম মধুর ক্ষয়রোগ একজন্মে যাওয়ার নয়। তারপর থেকে মেঘলা দিনে মন একলাই থাকে— আর প্রতীক্ষা করে জাদুকরের মতো এক গায়কের। ভাদ্রমাসের ভ্যাপসা গরমেও দখিনা হাওয়া বয়ে যেতে পারে যদি হেমন্ত বেজে ওঠেন, ফাল্গুনে সেই ফুল্ল শিরিষ। আমাদের ময়লা সময়, আমাদের ধূসর শহর, আমাদের রংচটা হৃদয়কে তিনি হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার মতো টেনে নেন মায়াবী সন্ধ্যায় আর উজ্জ্বল সকালে। যাবতীয় ঈর্ষা, কলহ, মৃত্যুভয় ও কামনা সরিয়ে রেখে আমরা যেন দেবতার সন্তানদের মতো আবিষ্কার করি হেমন্তের স্বরক্ষেপণ বায়ুকে মধুময় করে তুলেছে, সিন্ধুতে মধুক্ষরণ হচ্ছে।
উত্তম কুমার এবং সুচিত্রার সঙ্গে আলোচনায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
আসলে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে গায়ক বা সুরকার ভাবলে কিছুই বলা হয় না। তিনি সময়ের একটা অবিনশ্বর দাগ, এমন এক সাংস্কৃতিক উপস্থিতি যিনি যুগের মুদ্রাভঙ্গকে বিপুল প্রতিভায় ইতিহাসের মহাফেজখানায় সংরক্ষিত করেন। কী যে অলৌকিক সমাপতন! ১৯৪৭ সালে, আমাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতার বছরে, চালু দেশাত্মবোধের রমরমার মধ্যে তিনি গেয়েছিলেন কিংবদন্তীর সমান ‘কোনও এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই শোনো’। এই গান যা ইতিহাসের বিদ্যুল্লতাকে অন্দরের মলিন উনুনে টেনে নিয়ে যায় তা বাঙালির স্বাধীনতার ফাঁকি ও চল্লিশ দশকের ট্রমাকে কণ্ঠের কুসুমকোরকে ধারণ করে আছে। কী এক অপব্যয়ী অক্লান্ত আগুনে পুড়তে পুড়তে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সলিল চৌধুরীর সাহচর্যে রচনা করেন সময়ের যুগপৎ প্রাচীন ও নবীন মলাট। ১৯৫৫ সালের ‘শাপমোচন’ তো সভ্যতার রূপান্তরের ইতিকথা জনপ্রিয়তার মোড়কে। এই যে একটি সামন্ততান্ত্রিক সভ্যতা, গ্রামীণ সমাজ, উত্তর-ঔপনিবেশিকতা পর্বে নগর সভ্যতার প্রণয়কটাক্ষে সায় দিল, আধুনিকতার দিক থেকে দেখলে তা অহল্যার শাপমোচনের সঙ্গে তুলনীয়। কিন্তু গান যা পালুশকারের অভিজাত সুরবিস্তারে ‘চন্দ্রচূড় জটাজালে আছিলা যেমতি’ বদ্ধ ছিল তা যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কত শাস্ত্রমুক্ত, কত সরল হতে পারে, হেমন্তের গাওয়া ‘ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস’ প্রমুখ বুঝিয়ে দেয় এই ঝড় বস্তুত সমাজবদলের রূপক।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় উত্তম-সুচিত্রার মেলোড্রামায় যে রীতিতে গাইতেন তার ভাবার্থ প্রকারান্তরে অনুকৃত হয় ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ চলচ্চিত্রে রাজসভায় গুপির গানে। শাস্ত্রীয় নিয়মকানুনের ঠাসা কারুকার্যের বাইরেও বাংলা গান হয়ে ওঠে প্রাণের উচ্চারণ। অথচ, তথাকথিত কাঠিন্য যে তিনি অবলীলায় পার হয়ে যেতে পারেন তার দৃষ্টান্ত তো ‘রানার’, যা রূপকথার অধিক। এই হতভাগ্য ডাকহরকরার যাত্রা যে অন্তহীন, তা শুধু ‘সা’ থেকে শুরু করে ছ’বার ষড়জ পরিবর্তন আছে। অর্থাৎ ‘সা’ বদলে যাচ্ছে, থামছে না রুট কর্ডে। মেজর কর্ড-এর দিগন্ত থেকে মাইনর কর্ড-এর দিগন্ত জুড়ে সলিল একটা ছবি ফুটিয়ে তুলতে চান, টোনের অদলবদল করেন, না হলে পুঁজিবাদী ব্যবসার ক্লান্তি ‘পিঠেতে টাকার বোঝা তবু এই টাকাকে যাবে না ছোঁয়া’ ধরা পড়বে না। হেমন্ত কী অনায়াসে এই দুরূহ ব্রত সম্পাদন করলেন! ‘রানার’-এর থেকে জনপ্রিয় বাংলা গান আর কটা? হেমন্ত ব্যতিত ‘রানার’ গাওয়া সম্ভব?
পাড়ার সেলাই দিদিমণি বা কোচিং সেন্টারের মাস্টারমশাই রবীন্দ্রনাথকে অনেক দূর থেকে সসম্ভ্রমে দেখতেন। দেবব্রত বিশ্বাস, বলা বাহুল্য, সর্বজনে নিবেদিত নন। কিন্তু, রবীন্দ্র শতবর্ষের পরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রসঙ্গীতকে মধ্যবিত্ত বাঙালির রোজনামচায় নিয়ে এলেন। সেই কবে ১৯৪৮ সালে ‘প্রিয় বান্ধবী’ চলচ্চিত্রে তিনি যখন গাইলেন ‘পথের শেষ কোথায়’, আমরা অক্লেশে ভাবলাম যে এই দার্শনিকতা আমাদেরও। স্বীয় প্রতিভায় রবীন্দ্রসঙ্গীত নামক সামান্তরিক গড়ে তোলেন। অন্য তিন বাহু অবশ্যই দেবব্রত, কণিকা, শচীন। আর আশ্চর্য! স্বয়ং জর্জ বিশ্বাস, তাঁর সঙ্গে সঙ্গে হেমাঙ্গ বিশ্বাসও। হেমন্তর রবীন্দ্রগানের ধরন নিয়ে কোনও সংশয় বরদাস্ত করতে রাজি ছিলেন না। তাঁদের অনুরাগ ও স্নেহ ছিল নিঃশর্ত। হেমন্ত না থাকলে ‘শ্যামা’, ‘শাপমোচন’, ‘বাল্মিকী প্রতিভা’, ‘চিত্রাঙ্গদা’ আর ‘চণ্ডালিকা’ উত্তর বাংলার পাহাড় থেকে নদিয়ার সমতল ঘুরে সুন্দরবনের সজনেখালি পর্যন্ত বাহুবিস্তার করতে পারত না। আমরা বাঙালি বলেই জানি, ভেড়ির নোনা জলও হেমন্ত পান করলে মিষ্টি হয়ে যেত!
অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।
একদা এলাকার যুব সমাজ রাস্তার মোড়ে তাল ঠুকত, ‘হ্যায় আপনা দিল তো আওয়ারা’ আর লাইব্রেরিতে বই ফেরত দেওয়ার অবসরে কোনও কাজলনয়না কিশোরীকে জানাত, ‘না তুম হামে জানো...’। এই সব গান মেরঠ থেকে কোচি, দেশজুড়েই বাজত। হেমন্ত বাঙালি হিসাবেই সর্বভারতীয় হয়ে গিয়েছিলেন। মৃত্যুর ন’বছর আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পরে জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায় ‘দাদার কীর্তি’ ছবির জন্য তিনি গেয়েছিলেন, ‘চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে...’। এমন নির্মল আত্মনিবেদন সমস্ত আত্মাকে শুদ্ধ করে। যিনি অজেয় অব্যক্ত মানসগোচর, তাঁর প্রতি এই একক অঞ্জলি সিনেমা হল ছাড়িয়ে গায়ককে নিয়ে যায় ইতিহাসের পরপারে।
এক জন গায়ক যিনি সবিনয়ে মৃত্যুর দু’বছর আগে ‘পদ্মভূষণ’ উপাধি নিতে অস্বীকৃত হন, এক জন গায়ক যিনি হলিউডে প্লেব্যাক করেছেন, এক জন গায়ক যাকে বিশ্বভারতী সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত করেছে, তিনি জীবন ও মৃত্যুতে ধুতি আর শার্টের মধ্য দিয়ে বাঙালিই রয়ে গেলেন। এমন সুদর্শন, অনুপম কণ্ঠের পুরুষ ছাড়া কে আর আমাদের শাসন করতে পারত স্বাধীনতার পর তিনটি দশক জুড়ে? একদা আমাদের সংস্কৃতিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় রাজত্ব করতেন বলেই তাঁর শতবর্ষের মুহূর্তে ভগ্ন স্বাস্থ্য, হৃত স্বপ্ন, আমাদের মতো নির্জীব উত্তর প্রজন্মের মনে হয় বাঙালি হয়ে ওঠা কত বড় স্বর্গাভিযান!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy