Advertisement
২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

বিকল্প সংস্কৃতির খোঁজে এক চরিত্র

সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না! তিনি নাকি অহঙ্কারী? ক্ষুরধার প্রশ্নে সোজাসাপটা জবাব ব্রাত্য বসুর। সামনে স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন এখন বিকল্প সিনেমা, গান, নাটকের প্রয়োজন। কোমরের নীচের তলা, মানে পা নাচানোর চেয়ে মাথা নাচে, বুদ্ধি ঘোরে, হৃদয় ঘা দেয় এমন পারফর্মিং আর্টই তাঁর কাছে ‘বিকল্প’-র দরজা খুলে দেয়।

ব্রাত্য বসু। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

ব্রাত্য বসু। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

মনে করেন এখন বিকল্প সিনেমা, গান, নাটকের প্রয়োজন। কোমরের নীচের তলা, মানে পা নাচানোর চেয়ে মাথা নাচে, বুদ্ধি ঘোরে, হৃদয় ঘা দেয় এমন পারফর্মিং আর্টই তাঁর কাছে ‘বিকল্প’-র দরজা খুলে দেয়।

মন্ত্রীমশাই ব্রাত্য বসু। লোকে বলে তিনি অহঙ্কারী। আর তিনি বলেন, ‘‘অহঙ্কার শিল্পীর পরিচয়। সার্বিকভাবে নাটকের ছেলেমেয়েদের জন্য, সকলের জন্য আমি যা ভাবতে পারি, নাটকে এখন আর তা কেউ পারে না!’’ শোনা যায়, তিনি সমালোচনা পছন্দ করেন না! কিন্তু তিনি নিজের প্রতি নিরপেক্ষ থেকে, নির্মোহ হয়ে বলেন, ‘‘নাটক আমায় ধ্বংস করছে।’’

ইতিহাস বলছে দেবেশ চট্টোপাধ্যায়, দেবশঙ্কর হালদার, কৌশিক সেনের সঙ্গে তাঁর বহু প্রতিরোধ। ব্রাত্য বলেন, ‘‘নাটকের সংসারে অভিমান, অনিশ্চয়তা, মতবিরোধ থাকেই। মিডিয়া বাড়িয়ে বাড়িয়ে তা দ্বন্দ্বে নিয়ে যায়। আমি আমার কোনও বন্ধুর বিরুদ্ধে মিডিয়ায় কিছু বলিনি।’’

পরের প্রশ্ন থামিয়ে যোগ করেন, ‘‘একটা কথা জানাই। আমার নতুন নাটক ‘বিপিনের সংসার’-এর মূল চরিত্রে দেবশঙ্কর হালদার । ‘চার অধ্যায়’-এর অতীনও দেবশঙ্কর। আমাদের লড়াই নিয়ে কেউ কথা বললে আমরা খুব হাসি।’’

দেবেশ চট্টোপাধ্যায়, অর্পিতা ঘোষের সঙ্গে ভাব হয়ে গেছে? সোজা উত্তর না দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, ‘‘আমাদেরও ফ্লুরিজ-এ আড্ডা হয়। তখন ফেসবুকে ছবি দিতে হয়। কোনও দিন শুনেছেন আমি আমার বন্ধুদের বিরুদ্ধে কিছু বলেছি?’’

আরও পড়ুন:হিন্দির চেয়ে বাংলাতেই ভাল অরিজিন্যাল গান হচ্ছে

শোনা যায়, সাংবাদিকরা সমালোচনা করলে তিনি রাগ দেখান। ব্রাত্য অবাক, ‘‘রাগ যে-কোনও মানুষের স্বাভাবিক লক্ষণ। তবে যে সমালোচনা শিল্পের জন্য নয়, যেখানে আমার মুখ পছন্দ নয় বলে লোকে ব্যক্তি-আক্রমণ চালায়, সেই সমালোচনা মানি না।’’

সিনেমায় ঝুঁকেছেন অভিনয়ের খিদে নিয়ে। নতুন পরিচালক, কম প্রমোশনের ছবিতে অনায়াসে কাজ করেন। তাঁর কাছে চরিত্রই বড়। বড় ব্যানার নয়। তিনি আগ্রহী অনুরাগ কশ্যপের মতো ‘দেবদাস’ ভেঙে ‘দেব ডি’-র মতো ছবি করার। রি-মেক নয়। তিনি বিনির্মাণে বিশ্বাসী। ‘‘বাংলা ছবিতে যেমন ‘রাজসিংহ’, শরদিন্দুর ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘ’।’’ সাহিত্যে ফিরছেন ব্রাত্য।

হয়তো নাটকের খাতায় তাঁর কলমে খুব শিগগিরই উপন্যাস এসে পড়বে। থিয়েটারের মতোই সব ভাঙচুর করে নাটকের ছেলেমেয়েদের নিয়ে সিনেমা করবেন তিনি। এমন এক জেনারেশন উঠে এসেছে যারা যে কোনও দিন যে কাউকে টেক্কা দেবে। নাম বলতে লাগলেন, ‘‘কৃষ্ণেন্দু দেওয়ানজি, সত্রাজিৎ সরকার, প্রসেনজিৎ বর্ধন, অর্ণ মুখাপাধ্যায়, লোকনাথ দে, সুমিত রায়, তরঙ্গ সরকার, কৌশিক কর, অনির্বাণ ঘোষ আর অনির্বাণ ভট্টাচার্য।’’

পরে বললেন মহিলাদের নাম! ‘‘রায়তি বসু, ইন্দুদীপা ঘোষ, তূর্ণা দাস, অঙ্কিতা মাঝি, বিন্দিয়া ঘোষ, তন্নিষ্ঠা বিশ্বাস, কথাকলি,অন্তরা বন্দ্যোপাধ্যায়, পৌলমী বসু।’’ কিন্তু ভাল চরিত্র মানেই কি ঘরণী পৌলমী বসু?

বললেন, ‘‘বউ নয়, অভিনেত্রী হিসেবে ওকে কাস্ট করি। আমাদের আন্ডারস্ট্যািন্ডংটা আছে।’’

মনে করেন, বাংলা ছবির বক্স অফিসে যে ছবি হিট ‘‘তার কোনও কোনও ছবি স্বপন সাহা আর অঞ্জন চৌধুরীর ঝকঝকে মোড়ক মাত্র। সেটা মেকারদের সমস্যা নয়। দর্শক ফ্লপ করছে। তারা টিভি সিরিয়াল দেখতে চাইছে।’’

আর বাঙালি যে ‘সংস্কৃতিপ্রিয়’ এই তকমাটাই আজ তাঁর কাছে ভণ্ডামি বলে মনে হয়। জীবনানন্দ ধার করে বললেন, ‘‘প্রত্যেকে প্রত্যেককে আড় চোখে দেখে।’’ হিংসা, বিদ্বেষ কোনও নাগরিক জটিলতা নয়, এক ধরনের সিনড্রোম। যা বলে, ‘‘আমিই শুধু ভাল ছবি করব। আর কেউ না!’’

প্রেক্ষাগৃহে চলছে তাঁর নির্দেশনায় তাঁরই লেখা নাটক। পাইকপাড়া ইন্দ্ররঙ্গ-র ‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী’। আর নৈহাটি ব্রাত্যজন-এর ‘২১ গ্রাম’। তাঁর লেখা আরও খানচারেক নাটক নিয়ে ব্যস্ত শহরের অন্য নাটকের দল। খানসাতেক নতুন নাটকও হাতে। তার মধ্যে নিজের গল্পেই তিনি নিজে অভিনয় করছেন (বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কৃষ্ণগহ্বর’, দেবাশিস রায়ের ‘১৭ জুলাই’)। ‘স্বপ্নালু’ নাট্যদলের জন্য লিখছেন হাসির নাটক। অন্য দিকে মধ্যরাতে রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়’-এর নাট্যরূপ বেরিয়ে আসছে ‘অসমাপ্ত’-র মলয়ের হাত ধরে। সরকারি দফতরে সইসাবুদের পাতায় ‘অচলায়তন’-এর নাট্যরূপ বদলে যাচ্ছে তাঁর ভাবনায়। পাঠক তাঁর কাজের কথা পড়তে গিয়েই ক্লান্ত! কিন্তু তাঁর যেন ক্লান্তি নেই। হলুদ পাঞ্জাবিতে আলো মেখে বললেন, ‘‘লিখতে লিখতে ঘুম চলে যায়। লেখা তাড়া করে বেড়ায়।’’ বাংলা থিয়েটারের পথ বদলাচ্ছেন তিনি। আকাশমুক্ত পৃথিবীতে নাটকের ভিস্যুয়াল বদলাচ্ছে তাঁর নাটক। বললেন, ‘‘থিয়েটার কিন্তু স্থানিক। তাকে দাঁড়াতে হচ্ছে শপিংমল, আইপিএল, মেগা সিরিয়ালের সঙ্গে। স্ট্রাকচারের বদল জরুরি। তাই কোম্পানি থিয়েটারকে আসতেই হতো। পরিচালকই এখন টাকা জোগাড় করেন। কাস্টিং করেন।’’ মাস্টার মশাইয়ের মতো বুঝিয়ে বলেন, গ্রুপ থিয়েটারের সন্তান তিনি। কিন্তু মনে করেন, গ্রুপ থিয়েটারও ব্যক্তি চালায়। তাই তিনি তাকে কোম্পানি থিয়েটার বলছেন।

পরে অবশ্য বললেন, তিনি নিশ্চিত কোম্পানি থিয়েটারের মেয়াদ আরও দশ বছর। ‘‘আমি কোনও জাতীয় নাট্যশালা চাই না,’’ উত্তেজিত ব্রাত্য। তিনি বিশ্বাস করেন, একটা জাতি কতটা সভ্য তার পরিমাপ মঞ্চ থেকে হয়। অথচ সমাজ যেন সেখানেই তাপহীন।

থিয়েটার ছেড়ে দিলে আর নাটক লিখবেন না তিনি, ‘‘লিখলেই মনে হবে নাটক করি।’’

যেন শাসক ব্রাত্য নন। যেন রাগের চেয়ে অ-রাগ। যুগলে প্রেমের চেয়ে একা প্রেম। ‘হাজারোঁ খোয়াইশে’। বিরহের ঠোঁট। পারফর্মিং আর্টের মুক্ত আকাশের অন্য তারা।

অন্য বিষয়গুলি:

Bratya Basu Alternative Culture
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy