বাংলা হরর ছবি ‘সব ভূতুড়ে’-র দৃশ্য।
মহামতি পরশুরাম একদা লিখেছিলেন, “গান ও গালাগাল হিন্দিতেই জমে।” কিন্তু এ কথা লেখেননি যে, ভূতের সিনেমাও হিন্দিতেই জমে। পরশুরাম একহাতে যেমন ‘ভূশণ্ডীর মাঠে’-র মতো ভূত-কৌতুকের মহামিশ্রণ ঘটাতে পেরেছিলেন, অন্য হাতে তেমনই ‘মহেশের মহাযাত্রা’-র মতো তীক্ষ্ণ-বঙ্কিম গল্পও লিখেছিলেন, যাতে হরর এলিমেন্ট ছিল যথেষ্ট। বাঙালির ভয়ের জগতেও ব্যাপারটা তেমনই। ভূত নিয়ে ত্রৈলোক্যনাথ-সুলভ কৌতুক যেমন রয়েছে, তেমনই হেমেন্দ্রকুমার রায় বা বিভূতিভূষণ-শরদিন্দু মার্কা বুকের রক্ত জল করে দেওয়া, হাড়ে দুব্বোঘাস গজিয়ে দেওয়া ভয়ের কাহিনিও কম নেই। কিন্তু সে তুলনায় বাংলায় হরর সিনেমার তেমন কোনও পরম্পরা দেখা যায় না। বিভিন্ন সময়ে কিছু হরর এলিমেন্ট-যুক্ত ছবি বাংলায় নির্মিত হলেও, আমরা কোনও রামসে ব্রাদার্সকে বাংলায় পাইনি বা বিক্রম ভট্টের কোনও বাঙালি সংস্করণ পাইনি, যাঁরা পরম নিষ্ঠার সঙ্গে ভয়ের কারখানা চালিয়ে যাচ্ছেন দিনের পর দিন ধরে।
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলা সাহিত্যে হরর একটা বিশিষ্ট জায়গা দখল করে থাকলেও, বাংলা সিনেমায় কেন তা করল না? সত্যজিৎ বা তপন সিংহের মতো মায়েস্ত্রো পরিচালক হরর ছবির পরিধিতে পা দিয়েও কেন এক্সপ্লোর করলেন না বিষয়টিকে? অথচ এ কথা তো কিছুতেই অস্বীকার করা যাবে না যে, সত্যজিৎ স্বয়ং ছিলেন বাংলা হরর-অ্যানক্যানি সাহিত্যের অন্যতম প্রধান পুরুষ। যাঁর হাত দিয়ে ‘খগম’, ‘রতনবাবু ও সেই লোকটা’ অথবা ‘ভুতো’-র মতো গল্প বের হয়, তিনি নিজে কেন ‘মণিহারা’-য় তাঁর মাস্তানির একটা ঝলক মাত্র দেখিয়ে থেমে গেলেন? কেন তপনবাবু ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এ হরর-পরিধিতে ঘোরাফেরা করলেও একটাও পুরোপুরি হরর ছবি তুললেন না? সর্বোপরি প্রেমেন্দ্র মিত্রর মতো ব্যক্তিত্ব ‘কালোছায়া’ বা ‘কুয়াশা’-র মতো সাসপেন্স ছবি বানালেও কেন একটাও হরর ছবি তুললেন না? ‘হানাবাড়ি’-তে হরর রলমেন্ট থাকা সত্ত্বেও বলতে হয়, সে ছবি আদতে ক্রাইম থ্রিলার। অথচ হরর কাহিনি রচনায় প্রেমেনবাবুর সিদ্ধির কথা আমরা কে না জানি! এই সব আক্ষেপ মনের মধ্যে রেখেই বাংলা ছবির হরর-দুর্ভিক্ষের বিষয়ে ভাবতে বসা।
ইংরেজি সাহিত্যের স্কলার মিঠুরাজ ধুসিয়া গবেষণা করেছেন ভারতীয় হরর ছবি নিয়ে। তাঁর বই ‘ইন্ডিয়ান হরর সিনেমা: (এন)জেন্ডারিং দ্য মনস্টার’-এ তিনি এক বিস্তারিত তালিকা দিয়েছেন ভারতের বিভিন্ন ভাষায় নির্মিত হরর ছবির। সেখানে ১৯৪৮ সালে প্রেমেন্দ্র মিত্র পরিচালিত ‘কালোছায়া’ ছবিটিকেই তিনি প্রথম বাংলা হরর ছবি বলে চিহ্নিত করেছেন। সেই সঙ্গে অবশ্য এ-ও জানিয়েছেন যে, এ ছবি ছিল ক্রাইম থ্রিলার, তাতে হরর-এর আকার-প্রকার থাকলেও হরর সে অর্থে ছিল না। সে দিক থেকে দেখলে ১৯৪৯ সালে কমল আমরোহীর ছবি ‘মহল’-কেই মিঠুরাজ ‘ফার্স্ট জেনুইন হরর ফিল্ম ইন ইন্ডিয়ান সিনেমা’ বলেছেন। কিন্তু, মধুবালা-অশোককুমার অভিনীত ‘মহল’-এ প্রেত থাকলেও তা কি ভয়ের অবতারণা করে? শেষ পর্যন্ত ‘মহল’ একটা প্রেমের ছবি। তা হলে প্রশ্ন থেকে যায়, কাকে বলব হরর ছবি?
বিক্রম ভট্ট পরিচালিত ‘১৯২০’। বলিউডের নয়া হরর ঘরানা।
না, রহস্যঘন, কী হয়-কী হয় সাসপেন্স সমৃদ্ধ ছবিই হরর-এর মাপকাঠি নয়। হরর মানে সেই রকম ছবি, যা দেখতে বসলে স্ক্রিন থেকে উপচে ওঠা ভয় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াবে হল থেকে বেরিয়ে আসার পরেও। এবং অবশ্যই সেই ছবির ভিত্তি হবে অতিলৌকিক। হলিউডি উদাহরণ নিলে ‘দ্য এগজরসিস্ট’ অথবা ‘হোয়াট লাইজ বিনিথ’। কিন্তু তেমন ছবির পরম্পরা বাংলায় কোথায়? বাংলা ছবি প্রথম থেকেই অতিমাত্রায় সাহিত্য-নির্ভর। বাংলা সাহিত্যের সেই স্বর্ণযুগে সোনার কলম ধারণকারী লেখকেরা কিন্তু সব্যসাচী হয়ে হরর কাহিনি লিখেছেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র থেকে শুরু করে প্রমথনাথ বিশী, গজেন্দ্রকুমার মিত্র পর্যন্ত মহারথীরা নিয়ম করে নিষ্ঠার সঙ্গে হরর কাহিনি লিখে গিয়েছেন। সেই সব রচনার বেশির ভাগটাই শিশুপাঠ্য ছিল না। আরও একটা ব্যাপার, এই সব কাহিনিকে কিন্তু তাঁরা প্রকাশ করতেন আর পাঁচটা অন্য স্বাদের গল্পের সঙ্গে একই সংকলনে। এঁদের সরিয়ে যদি খোদ রবীন্দ্রনাথের কথাই ভাবা যায়, তবে দেখা যাবে সেই মহাপুরুষও ‘মাস্টারমশাই’-এর মতো অ্যাডাল্ট হরর কাহিনি লিখে গিয়েছেন (‘মণিহারা’, ‘নিশীথে’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এর কথা আপাতত সরিয়ে রাখছি। এরা হরর কাহিনি, নাকি তাকে অতিক্রম করে আরও কিছু, তা অনির্ণেয়।)। কিন্তু বাংলা সিনেমায় ইতস্তত বিক্ষিপ্ত উপস্থিতি ছাড়া হররের দেখা তেমন মেলে না।
১৯৫০ সালে নরেশ মিত্রর তোলা ‘কঙ্কাল’ ছিল বাংলা সিনেমার আদিকালের এক নির্জলা হরর ছবি। এর পরের বছর বসুমিত্র প্রোডাকশনের ব্যানারে বের হয় মণি ঘোষের পরিচালনায় ‘ভৈরব মন্ত্র’। এক তান্ত্রিকের শবসাধনা ও শবের জাগরণ নিয়ে তোলা এ ছবি এক হিসেবে আজকের জনপ্রিয় হরর জ্যঁর জোম্বি মুভির অগ্রদূত। অভিনয় করেছিলেন গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, শিশির মিত্র প্রমুখ। এর পর অজয় করের ‘জিঘাংসা’ তালিকায় এলেও, তাকে সে অর্থে হরর ছবি বলা যায় কি? ‘জিঘাংসা’ ছিল বিখ্যাত হোমস-কাহিনি ‘হাউন্ড অব দ্য বাস্কারভিলস’-এর বঙ্গ-রূপান্তরণ। সে কাহিনিতে রোমাঞ্চের পরিসর ছিল বিপুল। কিন্তু, আক্ষরিক অর্থে হরর বলতে যা বোঝায়, তা এই রহস্য-ছবিতে ছিল না।
পরে উত্তম-সুচিত্রা অধ্যূষিত ছবির যুগে হররের পথে হাঁটেইনি বাংলা ছবি। সে যুগ ছিল নির্যস রোম্যান্টিকতার। হিন্দিতে কিন্তু রোম্যান্টিকতার হাত ধরেই প্রবেশ করছে ভৌতিকতা বা অতিলৌকিক। ১৯৬০-এ তপন সিংহের পরিচালনায় ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ মুক্তি পায়। আলী আকবর খানের সঙ্গীত পরিচালনায় সে ছবি ছিল এক অনন্য মিউজিক্যাল। হরর এলিমেন্টকে সেখানে ডমিনেট করেছিল রোম্যান্স এবং সঙ্গীত। এ ছবি দেখতে বসলে রসিকজনের মনে পড়তে বাধ্য ব্রডওয়ের বিখ্যাত মিউজিক্যাল ‘ফ্যান্টম অব দ্য অপেরা’-র কথা। প্রশ্ন জাগে, তপনবাবু কি ১৯২৫ সালের নির্বাক ‘ফ্যান্টম অব দ্য অপেরা’ দেখেছিলেন? লন চেনি অভিনীত সেই কাল্ট মুভি? জানা নেই। তবে এটাও ঠিক যে, রবীন্দ্র-রচনাকে ভিত্তি করে তপনবাবু বেরতে চেয়েছিলেন অন্যত্র। কার্যত ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পে রবীন্দ্রনাথ যে অস্বস্তি তৈরি করে পাঠককে অথই জলে ফেলে দেন, এ ছবি কিন্তু তা করেনি। হন্টিং রোম্যান্স থাকলেও শেষ পর্যন্ত কিন্তু এ ছবি কিছুতেই হরর নয়।
‘মণিহারা’। কেন যে আর কোনও হরর ছবি তুললেন না সত্যজিৎ?
অতঃপর আসে সত্যজিৎ রায়ের প্রসঙ্গ। ‘তিন কন্যা’-র অন্তর্গত ‘মণিহারা’য় রায়সাহেব একেবারেই অনুসরণ করেছিলেন গথিক হররের আঙ্গিক। খাঁ খাঁ করা প্রাসাদোপম বাড়ি, আলো-ছায়ার অতিমাত্রিক ছম ছম এবং অবশ্যই এ ছবির আবহ সংগীত— সব মিলিয়ে এ ছিল প্রকৃত হরর ছবি। কিন্তু তার পরে কেন সত্যজিৎ একটাও হরর ছবি তুললেন না? অথচ লেখক সত্যজিতের হাত দিয়েই তো বেরিয়েছে ‘নীল আতঙ্ক’, ‘ফ্রিৎজ’, ‘অনাথবাবুর ভয়’ বা তারিণীখুড়ো সিরিজের গল্পগুলি! পরে ‘সত্যজিৎ রায় প্রেজেন্টস’ টেলি সিরিজে সেই আক্ষেপ খানিকটা মিটেছে। কিন্তু বড় পর্দায় সেই শূন্যতা থেকেই গিয়েছে। বাঙালি প্রাপ্তবয়স্ক দর্শক হরর পছন্দ করবেন না— এমনটাই কি ভেবেছিলেন তপনবাবু বা সত্যজিতের মতো পরিচালক? এমনটাই কি ভেবেছিলেন সেই সময়কার বাকিরাও। ফলে ‘কুহেলি’-র মতো থ্রিলার তৈরি হলেও হরর ছবি হয়নি বললেই চলে?
এখানে কয়েকটা কথা ভেবে দেখার একটু অবকাশ আছে। বাংলা ছবির মূল দর্শক সেই সময়ে নাগরিক মধ্যবিত্ত বঙ্গজন। ১৯৫০-১৯৭০ মধ্যবর্তী সময়ে বাঙালি নাগরিক মধ্যবিত্তের সিনেমা বিলাসের সঙ্গে কতটা খাপ খেত হরর? যে পাঠক বইয়ের পাতায় ‘তারানাথ তান্ত্রিকের গল্প’ বা ‘জঙ্গলবাড়ির বৌরাণী’ পড়তে ভালবাসছেন, তিনি কিন্তু পর্দায় খুঁজছেন ‘ফিলগুড’ একটা ব্যাপার। রোম্যান্টিক কমেডিই সেই সময়ে দর্শকের চাহিদা। তার বাইরে বেরতে চাইছেন না কেউই। হরর ছবির মধ্যে যে তিক্ততা থাকে, অনেক সময় দু’কুল ভাসিয়ে দেওয়া ডিপ্রেশন থাকে (প্রমথনাথ বিশীর বিখ্যাত কাহিনি ‘সাথে সাথে ঘুরবে’-ধাঁচের), তাকে ধারণ করতে সেই সময় বাংলা ছবি সম্ভবত প্রস্তুত ছিল না। ফলে ‘স্বর্ণযুগ’-এর বাংলা ছবিতে হরর তেমন জায়গা পায়নি বললে মনে হয় ভুল হবে না।
১৯৮০-র দশকে বলিউডে রামসে ব্রাদার্স-এর উত্থান একটা লক্ষণীয় বিষয় ছিল। রামসে ভাইদের প্রধান পুঁজিই ছিল হরর ছবি। উৎকট চেহারার ভূত আর তার সঙ্গে কিঞ্চিৎ খোলামেলা নায়িকা— এক জনপ্রিয় ফর্মুলা হয়ে দাঁড়ায়। এক হিসেবে দেখলে এই সব ছবিই ছিল ‘বি-মুভি’। ১৯৮০-র দশকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে এই সব ছবির অধিকাংশই প্রদর্শিত হতে থাকে নুন শো-এ। সেই সময়ে কৈশোরোত্তীর্ণরা জানেন, নুন শো নামক স্লটটি বরাদ্দ ছিল বিশেষ এক ধরনের ছবির জন্য। হালকা যৌনতা মাখা হলিউডি বি-মুভি আর মালয়ালম ছবির পাশাপাশি চলত ‘পুরানা মন্দির’, ‘পুরানি হাভেলি’, ‘শয়তানি ইলাকা’, ‘খুনি পাঞ্জা’ ইত্যাদি। যেখানে সুইমিং কস্টিউম পরে নায়িকারা বন্ধ বাথরুমে শাওয়ারে স্নান করতেন আর শাওয়ার থেকে জল পরা বন্ধ হয়ে গিয়ে ঝর ঝর করে রুক্ত ঝরে পড়ত। এ হেন ‘গ্রটেস্ক’ বিষয় বাংলা ছবিতে কদাচ আসেনি। তাই বলে বাঙালি দর্শক এই সব ছবি দেখেননি, এমন নয়। অঞ্জন চৌধুরী বা সুখেন দাসের মেলোড্রামার কালে রামসে ব্রাদার্সও দর্শক পেয়েছে। কিন্তু বাংলা ভাষায় রামসের প্যারালাল তৈরি হয়নি। টলিউডে সে অর্থে বি-মুভিই নির্মিত হয়নি। বি-মুভি তৈরি হতে যে ধরনের পুঁজির জোগান বা চাহিদা লাগে, তা বাংলায় ছিল না। ফলে টলিউড বি-ইন্ডাস্ট্রিকে দেখেইনি। হলিউডেও ১৯৮০-’৯০ দশকের হরর ছবির একটা বড় অংশ বি-ধাঁচের। ‘নাইটমেয়ার অন এলম স্ট্রিট’-মার্কা ছবি এই সময়ে মুঠো মুঠো তৈরি হয়েছে। বাঙালি দর্শক সে সব দেখেছেন। কিন্তু বাংলায় সে সব হয়নি। এর কারণ কি পর্দায় সেই ‘ফিলগুড’-কেই পেতে চাওয়া?
নরেশ মিত্রের ‘কঙ্কাল’ আদি পর্বের বাংলা হরর ছবি।
বলিউডে যখন রামসে ভাইদের ক্রুড হরর-এর যুগ শেষ হয়ে বিক্রম ভট্টের যুগ শুরু হল, বাংলায় কিন্তু তেমন ছায়া পড়ল না হররের। ভুবনায়নের পরে বাংলা ছবির চালচিত্র অনেকটাই বদলে গেল। টেকনোলজির বদলের পাশাপাশি ‘ফিলগুড’-মার্কা ছবিরও দিন শেষ হল। ঋতুপর্ণ ঘোষের মতো পরিচালক ‘শুভ মহরৎ’-এর মতো রহস্য কাহিনি তুললেও হররের পথে হাঁটলেন না। তার পরবর্তী প্রজন্মের পরিচালকরাও কি ভাবলেন বাংলায় হরর ছবি তোলার কথা? প্রশ্ন করায় পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায় বললেন, “ভেবেছি। বাংলা সাহিত্যে আর বাংলার ট্র্যাডিশনে ভূতের এত সমারোহ আর বৈচিত্র যে, তাদের নিয়ে ছবি করার ইচ্ছে একান্ত ভাবেই রয়েছে।” ভূত নিয়ে কৌতুক নয়, একেবারেই হরর ছবি তোলার ইচ্ছে রয়েছে তাঁর, জানালেন সৃজিত। কেমন হবে তাঁর হরর ছবি? তা কি আশ্রয় করবে বাংলা সাহিত্যকেই? পরিচালক জানালেন, না, সাহিত্য নয়, বরং ইতিহাসকে ঘিরেই হরর ছবি তোলার ইচ্ছে রয়েছে তাঁর। কলকাতার এ দিকে-ও দিকে ছড়িয়ে থাকা হন্টেড হাউজ নিয়ে হতে পারে সেই সব ছবি। হাইকোর্টই তো সেই রকম একটা বাড়ি, মত সৃজিতের। তবে বাংলায় যে হরর ছবির পরম্পরা নেই, সে কথাও স্বীকার করলেন ‘জাতিস্মর’-এর মতো প্যারানর্মাল বিষয় নিয়ে তোলা ছবির পরিচালক। বললেন, “বাংলা ভৌতিক সাহিত্য সমৃদ্ধ একটা শাখা হলেও, কেন যে বাংলা হরর ছবির পরম্পরা নেই, তা আশ্চর্যের। আমার মতে, এটা একটা ‘ভৌতিক’ ব্যাপার।”
তাঁর প্রথম ছবিই আশ্রয় করেছিল তিনটি অতিলৌকিক আখ্যানকে। ‘পুর্ব, পশ্চিম দক্ষিণ: উত্তর আসবেই’-এর মধ্যে হরর এলিমেন্টের জায়গা ছিল অনেকটাই। পরিচালক রাজর্ষি দে-কে এই নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানালেন, “বাংলা সাহিত্যে যে ভাবে হরর এসেছে, তাকে সিনেমায় রেপ্লিকেট করতে গেলে যে পরিমাণ অর্থ ও অ্যাডাপ্টেশন এবিলিটির প্রয়োজন, তার অভাব রয়েছে। আসল প্রশ্ন ওই অ্যাডাপ্টেশন এবিলিটি নিয়েই। তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘অলাতচক্র’ পড়ে যতই ছবি করার ইচ্ছে জাগুক, তা রূপায়ণ এখানে অসম্ভব। অবশ্য সবসময় যে অর্থ বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তা নয়। রামগোপাল বর্মার ‘রাত, ‘ভূত’, ‘ডরনা মানা হ্যায়’-গোছের ছবি মোটেই বিগ বাজেট মুভি নয়। তেমন স্পেশাল এফেক্টও এই সব ছবিতে নেই। যা রয়েছে, তা চিত্রনাট্যের মৌলিকতা। বাংলায় সেটারই অভাব রয়েছে।”
সত্যিই তো, বাংলায় কেন একটা ‘ডরনা মানা হ্যায়’ বা ‘ডরনা জরুরি হ্যায়’-এর মতো ছবি তোলা হয় না? পরিচালক বিরসা দাশগুপ্ত ‘সব ভূতুড়ে’-র মতো আনক্যানি-হরর ছবি আমাদের উপহার দিয়েছেন। অনীক দত্ত ভূতেদের নিয়ে ছবি করলেও তা আবদ্ধ থেকেছে কৌতুকের ট্র্যাডিশনেই। তিনিও কি হরর ছবি তোলার কথা ভাবেন না? আশা জাগে, অনাগত দিনের পরিচালকরা হয়তো ভাবছেন হরর অ্যান্থোলজি নিয়ে বা হরর ওয়েব সিরিজ নিয়ে।
আরও পড়ুন: কাস্টিং কাউচে মানা করায় হাত থেকে ছবির সুযোগ চলে যায় রিচার
হরর-এর উৎস সম্পর্কে ফ্রয়েড সাহেব আলো ফেলেছিলেন আমাদের মনোগহীনেই। আমাদের মনের আঁধার কুঠুরিতে লুকিয়ে থাকা আশ্রয়হীনতার ভয়ই ফিরে আসে হরর হয়ে, গা ছমছমে আনক্যানির রূপ ধরে। এই আশ্রয়হীনতাকে আশ্রয় করেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘মণিহারা’, ‘নিশীথে’। যেখানে তিনটি প্রাসাদই যেন জীবন্ত হয়ে গিলে খেতে আসে ছবিগুলির প্রোটাগনিস্টদের। সেই আশ্রয়হীনতা কি বাঙালির জীবনে অনেক দিনই অন্তর্হিত? বাংলা হরর সাহিত্যেও এখন ভাটির টান। হয় শিশুপাঠ্য চর্বিতচর্বণ, নয়তো তন্ত্র-মন্ত্রের মাবো-জাম্বোর অবতারণা ঘটিয়ে একটা হজপজ। গভীর মনোগহীনে কি বাঙালি এক স্থবির সত্তাকেই আঁকড়ে ধরে আছে? যেখানে অবচেতনের অলিগলিতে আলো-আঁধারির লালন আপাতত নেই। আর তাই বাংলা ছবিতেও অনুপস্থিত সেই উপছায়াময় জগৎ? তবে আশার কথা, ওয়েব সিরিজে খুব বেশি মাত্রাতেই দেখা মিলছে থ্রিলারের। সেখান থেকে ‘চিলার’-এ (থ্রিলার ও চিলিং হররের পাঞ্চ) কি প্রবেশ করবে না বাংলা ছবি? দেখা যাক, ভূতেরা তাঁদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কী বলেন।
আরও পড়ুন: ফের স্বস্তিকার চরিত্রহনন সোশ্যাল মিডিয়ায়, মোক্ষম জবাব দিলেন অভিনেত্রী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy