Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
26-11 Mumbai Attack

মুম্বই ডায়েরিজ ২৬/১১: ভয়ঙ্কর একটি রাতেরই ঘটনা নয়, এই সিরিজ বলছে আরও কিছু

এ গল্পে জঙ্গি হামলা যদি ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু হয়, তার বিস্তার হচ্ছে মুম্বই হাসপাতাল।

মুম্বইয়ে জঙ্গি হামলার ভয়াবহতাকে কেন্দ্র করেই আটটি পর্ব নিয়ে থ্রিলার ‘মুম্বই ডায়েরিজ ২৬/১১’।

মুম্বইয়ে জঙ্গি হামলার ভয়াবহতাকে কেন্দ্র করেই আটটি পর্ব নিয়ে থ্রিলার ‘মুম্বই ডায়েরিজ ২৬/১১’।

নন্দিতা আচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৩:৫০
Share: Save:

২০০৮-এর ২৬ নভেম্বর। মুম্বইয়ে জঙ্গি হামলা এবং তার ভয়াবহতা সমগ্র দেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই আটটি পর্ব নিয়ে থ্রিলার ‘মুম্বই ডাইরিজ ২৬/১১’।

প্রযোজক মনীষা আডবাণী, মধু ভোজওয়ানি। পরিচালক নিখিল আডবাণী, নিখিল গনসালভেস। অভিনয়ে মোহিত রায়না, কঙ্কনা সেনশর্মা, টিনা দেশাই, শ্রেয়া ধন্বন্তরি, নাতাশা ভরদ্বাজ, সত্যজিৎ দুবে, মৃন্ময়ী দেশপাণ্ডে প্রমুখ।

সন্ধ্যা নামার মুহূর্ত। স্বপ্নের নগরীর আলোকিত রাস্তা। হাইরাইজ বিল্ডিং। শান্ত সমুদ্রের জল কেটে বিচ্ছিন্ন এক সৈকতে এসে দাঁড়াল একটি ট্রলার। আধো অন্ধকারে পিঠে ব্যাগ নিয়ে লাফ দিয়ে নামল কিছু যুবক।

অন্য দিকে, ব্যস্ত মুম্বই হাসপাতালে সদ্য আসা তিন জন ট্রেনি চিকিৎসক। বিখ্যাত সার্জেন কৌশিক ওবেরয়ের আন্ডারে তাঁরা কাজ করবেন। এই কৌশিক অত্যন্ত বিতর্কিতও। যে কোনও রোগীর জীবন ফিরিয়ে দেওয়াই তাঁর মূল লক্ষ্য। দুর্ঘটনায় মরণাপন্ন রোগী, পুলিশের কনফার্মেশন অপেক্ষা না করেই চিকিৎসা শুরু করেন তিনি। এতে যদি নিয়ম ভাঙতে হয়, তিনি পরোয়া করেন না। এই নিয়ে হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত ইন্সপেক্টরের সঙ্গে তাঁর ঝামেলা লেগেই থাকে। তাঁর একরোখা জেদের কারণে কর্মজীবন থেকে ব্যক্তিজীবনে তিনি সমালোচিত হতেই থাকেন।

এ গল্পে জঙ্গি হামলা যদি ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু হয়, তার বিস্তার হচ্ছে মুম্বই হাসপাতাল। সঙ্গে এক বিখ্যাত হোটেল। ডাক্তার, রোগী, অস্ত্রোপচার, আইসিইউ— তারই মাঝে প্রবল গতিতে ছুটতে থাকে ঘটনার প্রবাহ। এ শুধু মুম্বই নগরীর ভয়ঙ্কর একটি রাত এবং তার পরের কয়েক দিনের ঘটনা নয়, এর সঙ্গে যেন জুড়ে রয়েছে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের জীবনের সারসূত্র— ভয়, আকাঙ্ক্ষা, ভালবাসা, নিষ্ঠুরতা, ত্যাগ, ঈর্ষা, কর্তব্যপরায়ণতা!

অভিনয়ে মোহিত রায়না, কঙ্কনা সেনশর্মা, টিনা দেশাই, শ্রেয়া ধন্বন্তরি, নাতাশা ভরদ্বাজ, সত্যজিৎ দুবে, মৃন্ময়ী দেশপাণ্ডে প্রমুখ।

অভিনয়ে মোহিত রায়না, কঙ্কনা সেনশর্মা, টিনা দেশাই, শ্রেয়া ধন্বন্তরি, নাতাশা ভরদ্বাজ, সত্যজিৎ দুবে, মৃন্ময়ী দেশপাণ্ডে প্রমুখ।

দেখা হয় টিভি চ্যানেলের প্রবল সক্রিয় সাংবাদিক মানসী এবং মুম্বই হাসপাতালের অত্যন্ত নগণ্য অলস মেডিক্যাল কর্মী সমর্থের সঙ্গে, যিনি সাংবাদিককে হাসপাতালের ভেতরের তথ্য দিয়ে কিছু টাকা রোজগার করেন। অন্য দিকে পাই বিখ্যাত চিকিৎসকের মেয়ে দিয়া পারেখকে। দিয়ার দাদুর অনেক অবদান রয়েছে এই মুম্বই হাসপাতালে। সাধারণ ট্রেনি চিকিৎসক হিসেবে দিয়ার প্রথম দিন হাসপাতালে আসা অন্য দুই চিকিৎসক অহন, সুজাতার সঙ্গে।

তেমনই পাই সেই হোটেলের কর্পোরেট কর্মী অনন্যাকে, যিনি আবার চিকিৎসক কৌশিকের স্ত্রী। রংবেরঙের হরেক চরিত্রের একটি তোড়ায় বাঁধা এই গল্প। চিকিৎসক চিত্রা সেন, হাসপাতাল সুপার সুব্রহ্মণ্যম, বৃদ্ধা রোগী পরমজিত, জঙ্গিদের গুলিতে বিদ্ধ পুলিশ ইন্সপেক্টর— প্রত্যেকেই এখানে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র।

বিস্ফোরণ শুরু হয় ক্যাফে থেকে। কী আশ্চর্য, সেখানেই হামলার ঠিক আগের মুহূর্তে হাসপাতালের তথ্য দেওয়া নিয়ে সমর্থের সঙ্গে ঝগড়া শুরু হয়েছিল মানসীর, সেই ভাবেই তারা ওখান থেকে বেরিয়ে আসে। এ দিকে আততায়ীরা ক্যাফেটেরিয়া থেকে ছত্রপতি শিবাজি বাস টার্মিনাস হয়ে প্যালেস হোটেল আক্রমণ করেছে। মৃত্যুর হাত থেকে কোনও মতে রেহাই পেল মানসী আর সমর্থ। কিন্তু আশ্চর্য ভাবে কোনও ট্রমার লেশও ছিল না তাঁদের মুখে। মানসী ঝাঁপিয়ে পড়ে ‘ব্রেকিং নিউজ’-এর জন্য। আর হাসপাতালে নিষ্কর্মার মতো ঘুরে বেড়ায় সমর্থ।

ক্রমাগত বিস্ফোরণে আহত, হত রোগীরা উপচে পড়তে থাকে মুম্বই হাসপাতালে। চিকিৎসক, সিস্টাররা নিঃশ্বাস ফেলতে পারেন না। তারই মধ্যে হাসপাতালে ডিউটি করে ফিরে যাওয়া এক হাসিখুশি নার্সের মৃত্যু, স‌বাইকে শোকগ্রস্ত করে। সবচেয়ে ভেঙে পড়ে সমর্থ।

একটি রাতের ঘটনা। বৃহৎ এক চক্রের মতো ঘুরতে থাকে। ঘটনার ভেতর ঘটনা। বর্তমানের সঙ্গে অতীত, ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা ঘুরতেই থাকে। স্বয়ং নিয়তি যেন সিনেমার রিল খুলে দেখিয়েই চলেছে চরম ভয়াবহতা। আর তার সঙ্গে যুদ্ধরত অসহায় মানুষ। এ সব ঘটনার মধ্যেই পরিচালক সাজিয়ে দিয়েছেন অবদমিত আবেগ এবং জীবনের দর্শন।

আক্রান্ত প্যালেস হোটেল, আত্মগোপন করা অতিথি এবং কর্মীরা, সেখানে দেখি কর্পোরেট অনন্যাকে। কী ভাবে সমস্ত বাধা পেরিয়ে কর্তব্যে অবিচল থেকে সে অতিথিদের জীবন রক্ষা করল!

এই কর্তব্যপরায়ণতা প্রায় সব চরিত্রের মধ্যেই দেখি। জীবনকে বাজি রেখে কাজ করে চলেছেন ডাক্তার, সিস্টার সকলেই। পুলিশ, মিলিটারি, প্যারা মিলিটারি এবং সাংবাদিক মানসীকেও দেখি, যে যার যার নিজের লক্ষ্যে স্থির। সাংবাদিক মানসী ইচ্ছাকৃত গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটিয়ে হাসপাতালে ঢোকে, ভেতরের তথ্য সংগ্রহের জন্য। আর তাতেই গোপন খবর, দু’জন আহত জঙ্গিকে যে পুলিশ ধরতে সক্ষম হয়েছে এবং তাদের হাসপাতাল এনেছে, তা ‘ব্রেকিং নিউজ’-এ প্রকাশ হয়ে যায়। ফল হয় ভয়াবহ। আক্রমণ করা হয় হাসপাতাল!

গল্পের প্রতিটা পদক্ষেপে উত্তেজনা, জীবন মৃত্যুর মাঝে পড়ে থাকা সূক্ষ্ম সুতোটির টানাপড়েন।

গল্পের প্রতিটা পদক্ষেপে উত্তেজনা, জীবন মৃত্যুর মাঝে পড়ে থাকা সূক্ষ্ম সুতোটির টানাপড়েন।

দৃশ্য চলে যায় ইসলামাবাদে। স্বাভাবিক জীবনযাপনে ‘সুপার বস’। থালা সাজিয়ে খাবার খায়, নিজের শিশু কন্যাকে আদর করে, নতজানু হয়ে প্রার্থনা করে আর খোলা স্ক্রিনে দেখে মুম্বইতে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা। তার নির্দেশ আসে হাসপাতাল আক্রমণ করার, পুলিশের হাতে ধৃত জঙ্গিদের মেরে ফেলা অথবা উদ্ধার করার জন্য।

মরতে হয় অজস্র সাধারণ মানুষকে। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া ঘুটঘুটে অন্ধকার করিডর দিয়ে দৌড়ে বেড়ান বিপন্ন মানুষ। এ দৃশ্য প্যালেস হোটেলেও দেখেছে দর্শক। পোকামাকড়ের মতো মানুষ মরছে। এই হাড়হিম যুদ্ধের মধ্যে বসে দর্শকও অবচেতনে জীবনভিক্ষা করে চলে, পলক পড়ে না তার!

তারই মধ্যে প্রতিটা আহত জীবন বাঁচানোর আপ্রাণ লড়াই ট্রেনি চিকিৎসক অহান, দিয়া, সুজাতার। বিখ্যাত সার্জেন কৌশিক এবং তাঁর সহকর্মীদের। রাত গড়িয়ে মধ্যরাত। অনেক খুনখারাপির পর আততায়ীরা চিকিৎসক চিত্রার শরীরে বোমা বেঁধে, তাকে ঢাল করে পালাতে চেষ্টা করে। এই চিত্রাকে আমরা দেখেছি স্নেহশীল, সবার ক্ষেত্রে কেয়ারিং। পেশেন্ট থেকে সহকর্মী— সবাই তাঁকে ভরসা করে।

পরিচালক এখানে অত্যন্ত নিরপেক্ষভাবে গল্প বলে গিয়েছেন। যার প্রতিটা পদক্ষেপে উত্তেজনা, জীবন মৃত্যুর মাঝে পড়ে থাকা সূক্ষ্ম সুতোটির টানাপড়েন। দর্শকের স্নায়ু ধনুকের ছিলার মতো টানটান। কী আশ্চর্য বিপরীত সমাপতন! এক দিকে গুলিতে ঝাঁঝরা মুম্বই পুলিশের এটিএস প্রধানের মৃত্যু। অন্য দিকে, ধরা পড়া আততায়ীর চিকিৎসায় সাড়া দিয়ে বেঁচে থাকা। আমরা দেখি কর্তব্যে অবিচল চিকিৎসক কৌশিক ক্রুদ্ধ পুলিশ অফিসারের রিভলভারের মুখে দাঁড়িয়েও আততায়ীর চিকিৎসা করে। কারণ ডাক্তার হিসেবে তাঁর একমাত্র কর্তব্য রুগীর চিকিৎসা করা!

চিকিৎসক দিয়া পারেখকে ক্ষণিকের জন্য বিস্মিত করে হাসপাতালে থাকা তার বিখ্যাত দাদামশাইয়ের ধুলোমলিন আবক্ষ মূর্তিটি। অথচ তাদের পরিবার একটু বেশি সম্মানিত এই দাদামশাই। এই ছবি, নাম, যশ-সহ জীবনের নশ্বরতাকেই যেন আর একবার প্রমাণ করে।

বেদনা এবং তুচ্ছতা ডিঙিয়ে চরিত্রগুলো অবশেষে আলোমাখা এক বৃহত্তর কর্মময় জীবনে পা রাখতে চলে।

বেদনা এবং তুচ্ছতা ডিঙিয়ে চরিত্রগুলো অবশেষে আলোমাখা এক বৃহত্তর কর্মময় জীবনে পা রাখতে চলে।

সিরিজটি শেষ হয়েছে দর্শককে স্বস্তি দিয়ে, যেখানে বেদনা এবং তুচ্ছতা ডিঙিয়ে চরিত্রগুলো অবশেষে আলোমাখা এক বৃহত্তর কর্মময় জীবনে পা রাখতে চলে।

প্রায় প্রত্যেকেরই অভিনয় অসম্ভব ভাল। কোথাও আরোপিত মনে হয়নি। ২৬/১১-র সেই ভয়াবহ রাত গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে চরিত্রদের সন্ত্রস্ত চোখের তলায় গভীর কালি, ঘেঁটে যাওয়া চুল, সাজগোজ গলে যাওয়া ক্লান্ত মুখ... দর্শককে খুব সহজেই তাদের লড়াইয়ের সঙ্গী করে তুলেছে।

চিকিৎসক কৌশিকের চরিত্রে মোহিত রায়না, চিকিৎসক চিত্রা দাসের চরিত্রে কঙ্কনা সেনশর্মা, অনন্যার ভুমিকায় টিনা দেশাই, মানসী-র চরিত্রে শ্রেয়া ধন্বন্তরি, দিয়া (নাতাশা ভরদ্বাজ) অহান (সত্যজিৎ দুবে) সুজাতা (মৃন্ময়ী দেশপাণ্ডে)—প্রত্যেকেই দুর্দান্ত!

মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চিকিৎসক চিত্রা এবং জঙ্গিদের কাঁপা গলায় গান, শাহরুখ খানের কথা বলা... এক অন্য আবেগ নিয়ে আসে। জীবন মৃত্যুর মাঝখানের এক চিলতে জমিটিকে বারাবার এ রকম নৈব্যর্ক্তিক ভাবে তুলে ধরা হয়েছে সমস্ত সিরিজটিতে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy