‘দ্য ডায়েরি অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল’ ছবির পরিচালক সনোজ মিশ্র। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
ছবির প্রথম ঝলক প্রকাশের পর থেকেই বিতর্কের সূত্রপাত। লাগাতার হুমকি। পুলিশি অভিযোগ থেকে আইন-আদালত। ‘দ্য ডায়েরি অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল’ মুক্তির আগে ‘নিখোঁজ’ হন পরিচালক সনোজ মিশ্র। ছবি তৈরির নেপথ্য ভাবনা থেকে শুরু করে যাবতীয় বিতর্ক প্রসঙ্গে আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে কথা বললেন পরিচালক।
প্রশ্ন: প্রথমেই জানতে চাই, আপনি এখন কোন শহরে রয়েছেন?
সনোজ: এই মুহূর্তে আমি দিল্লিতে রয়েছি।
প্রশ্ন: ৩০ অগস্ট মুক্তি পায় ‘দ্য ডায়েরি অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল’। তার আগে নাকি আপনি কলকাতা থেকে নিখোঁজ হন। তার পর আপনাকে বারাণসীতে দেখতে পাওয়া যায়। ঠিক কী ঘটেছিল?
সনোজ: ছবির মুক্তি যত এগিয়ে আসছিল, তত আমাকে হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। সমনের ভিত্তিতে পুলিশ বার বার আমার বাড়িতে আসছিল। মানুষ ভুল ভাবছিলেন। তাই আইনজীবীর পরামর্শে আমি লখনউয়ে আমার দেশের বাড়িতে যাই। সেখানেও একই সমস্যা। তার পর কলকাতায় আসার পর, আমাকে অপরিচিত একদল মানুষ অনুসরণ করছিলেন। মেট্রোয় চেপেছি, সেখানেও দেখছি, আমার পিছনে চার-পাঁচ জন। খুব ভয় পেয়ে যাই। তার পর আইনজীবীর পরামর্শে আমি ফোন বন্ধ করে দিই। কারণ, আমার মনে হচ্ছিল, আমার ফোন ট্যাপ করা হচ্ছে।
প্রশ্ন: আপনাকে অপহরণ করা হয় বলে শোনা যায়।
সনোজ: না! ১৫ অগস্ট কালীঘাট থেকে বেরিয়ে আমি সোজা বারাণসীর জন্য দুন এক্সপ্রেসে চাপি। ১৯ অগস্ট পর্যন্ত সেখানেই ছিলাম। কী করব, বুঝেই পাচ্ছিলাম না। লোকে ভেবে নিল, আমি নিখোঁজ হয়ে গিয়েছি!
প্রশ্ন: বারাণসীতে কোথায় ছিলেন?
সনোজ: আমি বারাণসীর ঘাটে ছিলাম। খুব জ্বরও হয়। ওখানেই লুকিয়ে দিনে এক বার খিচুড়ি খেতাম। হোটেলে থাকার ঝুঁকি নিতে চাইনি। ৩০ অগস্ট পর্যন্ত নিজেকে সুরক্ষিত রাখাটাই আমার মূল উদ্দেশ্য ছিল।
প্রশ্ন: আপনার স্ত্রী পরে পুলিশে নিখোঁজের অভিযোগ জানান। বাড়িতে খবর দিয়েছিলেন?
সনোজ: আমার সঙ্গে ফোন ছিল না। পরে ফেসবুকে এক পরিচিতের মাধ্যমে বাড়িতে সব জানাই।
প্রশ্ন: আপনি লখনউয়ে বড় হয়েছেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ছবি তৈরি করলেন কেন?
সনোজ: ১০-১৫ বছর আগে আমি আপনাদের ইন্ডাস্ট্রিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছিলাম। সেই সময় বাংলাকে আরও কাছ থেকে চিনতে পারি। বাংলায় আমার অনেক বন্ধুও রয়েছেন। আমি হিন্দিভাষী বলে বাংলায় যেতে পারব না বা বাংলার প্রেক্ষাপটে ছবি তৈরি করতে পারব না, এ রকম তো কোনও নিয়ম নেই!
প্রশ্ন: টলিউডে কাদের সঙ্গে কাজ করেছিলেন?
সনোজ: দুঃখিত। তাঁদের নিরাপত্তার খাতিরেই আমি কারও নাম জানাতে চাই না।
প্রশ্ন: কিন্তু ছবিটা তো এ রাজ্যে মুক্তি পেল না। কারণ কী?
সনোজ: অনেক চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কোনও পরিবেশক নিতে রাজি হলেন না। বাংলায় তো ‘দ্য কেরালা স্টোরি’র প্রদর্শনও বন্ধ করে দেওয়া হয়। বোঝাই যাচ্ছে, ভয়ের রাজনীতি করেই ছবিটা দেখানো হল না।
প্রশ্ন: শোনা যাচ্ছিল, আরজি কর-কাণ্ডের জেরে প্রযোজকেরা নাকি ছবি মুক্তিতে ভয় পেয়েছিলেন।
সনোজ: দেখুন, ছবিমুক্তির দিন তো আগে থেকেই স্থির ছিল। তার পর আরজি করের ঘটনা ঘটেছে। এই সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে ওই ঘটনার বিরুদ্ধেও আমি তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। বাংলার বর্তমান পরিস্থিতি কী, এই ঘটনা সেটা বুঝিয়ে দিয়েছে।
প্রশ্ন: লোকসভা নির্বাচনের মরসুমে ছবির পোস্টার প্রকাশ্যে আসার পরেই শুরু হয় বিতর্ক। বলা হয়, সন্দেশখালির ঘটনা এবং নির্বাচনের আবহকে ব্যবহার করতেই ছবিটিকে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করা হয়।
সনোজ: গত বছর ছবিমুক্তির কথা ছিল। কিন্তু আইনি জটিলতায় প্রযোজকেরা পিছিয়ে যান। তার পর সবাইকে এক ছাদের নীচে আনতেই আমার আরও এক বছর সময় লাগে। ছবির গবেষণার জন্য এক সময় আমি নিজে সন্দেশখালিতে গিয়েছিলাম। আমি জানতাম, ওখানে মহিলাদের উপর নির্যাতন করা হয়। পরে তো দেখলাম, শাহজাহান শেখকে গ্রেফতার করা হল।
প্রশ্ন: এ রাজ্যে মুক্তি পায়নি। দেশের অন্যান্য রাজ্যে ছবিমুক্তির পর কী রকম প্রতিক্রিয়া পাচ্ছেন?
সনোজ: খুব ভাল। যাঁরা দেখছেন, তাঁদের ভাল লাগছে। দ্বিতীয় দিনেই প্রথম দিনের তুলনায় দেড় গুণ বেশি ব্যবসা করেছে। গত রবিবারে সবচেয়ে বেশি ব্যবসা করেছে। সাড়ে ছ’শো স্ক্রিনে ছবি রিলিজ় করেছিলাম। সেই সংখ্যাটা এখন প্রায় এক হাজার। আগামী দিনে আরও বাড়বে। বরেলি, আলিগড়, মোরাদাবাদ-সহ বিভিন্ন জায়গায় ছবিটিকে করমুক্ত করার দাবি উঠছে। চার-পাঁচ জন মিলে ছবিটা প্রযোজনা করেছেন। আমার প্রচারের ক্ষমতা সীমিত। সাধারণ মানুষ ছবির হয়ে প্রচার করছেন। আমি খুব খুশি।
প্রশ্ন: সম্প্রতি তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ আপনার ছবি...
সনোজ: (থামিয়ে দিয়ে) আমি সব জানি। মন দিয়ে সব খবর পড়েছি। হাই কোর্ট যখন ছবিমুক্তির পক্ষে রায় দিয়েছে, তার পরেও তিনি কী ভাবে ছবি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, আমি জানি না। তিনি তো আদালতের উর্ধ্বে নন। ওঁর লজ্জিত হওয়া উচিত।
প্রশ্ন: ‘দ্য কাশ্মীর ফাইল্স’ এবং ‘দ্য কেরালা স্টোরি’র মতো আপনার ছবিটিকেও তো ‘প্রোপাগান্ডা’ ছবি আখ্যা দেওয়া হয়েছে!
সনোজ: সত্যি কথা বললে যদি ‘প্রোপাগান্ডা’ বলা হয়, তা হলে আমি স্বীকার করে নিচ্ছি আমার ছবিটি প্রোপাগান্ডা ছবি! আমি এই ধরনের ছবি আরও তৈরি করতে চাই।
প্রশ্ন: এই দুই ছবির পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রী এবং সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ আছে?
সনোজ: বিবেক ভাইয়া আমার ছবির কথা জানেন। তিনিও তো বাংলার প্রেক্ষাপটে একটি ছবি তৈরি করছেন। ছবিটা নিয়ে সুদীপ্তদার সঙ্গেও আমার কথা হয়েছে।
প্রশ্ন: কেউ বলছেন ১৯৭১ সালের আন্দোলন, কেউ বলছেন বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। আপনার ছবিতে কী কী বিষয় ধরতে চেয়েছেন?
সনোজ: ১৯৭১ সালের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। আমি সংখ্যালঘু মহিলাদের পরিস্থিতি দেখাতে চেয়েছি। বাংলার সরকার বাংলাদেশি মুসলমানদের স্বাগত জানাচ্ছে, এ দিকে সিএএ-এনআরসির প্রতিবাদ করছে। ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি— ছবিতে সব কিছুই রয়েছে।
প্রশ্ন: কিন্তু, এখনও পর্যন্ত একাধিক রিভিউয়ে তো ছবিটি সম্পর্কে নেতিবাচক কথা বলা হয়েছে।
সনোজ: আপনি যে সব রিভিউয়ের কথা বলছেন, সবই প্রভাব খাটিয়ে এবং টাকা দিয়ে করানো হয়েছে।
প্রশ্ন: অনেকেই তো বলছেন, আপনি বিজেপি এবং আরএসএস-এর সমর্থক। তাই এই ধরনের ছবি তৈরি করেছেন। কী বলবেন?
সনোজ: আমি রাষ্ট্রবাদী। এটা ঠিক, আমি ছোট থেকেই আরএসএস-এর সঙ্গে যুক্ত। সেখানে তো বিশেষত ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ নীতিই শেখানো হয়। সমাজবাদী পার্টিতেও আমার বন্ধু আছে, আবার তৃণমূলেও আছে। ছবিটা যদি সুপারিশে তৈরি করতাম, তা হলে তো ১০০ কোটি টাকার ছবি হত। কেন্দ্রীয় সরকারের সমর্থক বড় তারকাদের নির্বাচন করতাম। দেখুন, ‘গান্ধীগিরি’ ছবিটা যখন তৈরি করেছিলাম, তখন তো আমাকে কংগ্রেস সমর্থক বলা হয়েছিল!
প্রশ্ন: পরবর্তী ছবির কোনও পরিকল্পনা?
সনোজ: আমাকে এবং আমার পরিবারকে এখনও প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। যদি বেঁচে থাকি, তা হলে আবার ছবি পরিচালনা করব। আমার পরবর্তী ছবির নাম ‘দ্য ডায়েরি অফ মণিপুর’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy