সৃজিত মুখোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
পুজোর বক্স অফিস সাফল্যের পর নতুন উদ্যমে মাঠে নেমেছেন পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়। বছরের শুরুতেই তাঁর তুরুপের তাস বাঙালির প্রিয় ম্যাটিনি আইডল উত্তমকুমার। কেরিয়ারে অনেক বেশি ঝুঁকি নিতে চাইছেন। বলিউড-টলিউড প্রসঙ্গেও অকপট। সম্প্রতি এক দুপুরে, দক্ষিণ কলকাতার রেস্তরাঁয় লাঞ্চে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তিনি। আনন্দবাজার অনলাইনের রেকর্ডার অন হতেই চেনা মেজাজে ধরা দিলেন সৃজিত।
প্রশ্ন: কেমন আছেন?
সৃজিত: দিব্যি আছি (হাসি)। কাজের মধ্যে রয়েছি। কয়েক দিনের মধ্যেই ‘ভূস্বর্গ ভয়ঙ্কর’-এর শুটিংয়ে বেরোব।
প্রশ্ন: উলুপী (সৃজিতের পোষ্য পাইথন) কেমন আছে?
সৃজিত: খুব ভাল আছে। খোশমেজাজে আছে। ১১ মাসের শিশু। তাই একটু লাজুক। কিন্তু ধীরে ধীরে নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিচ্ছে।
প্রশ্ন: শুনছি আপনি নাকি বাড়িতে পোষ্য হিসেবে আরও দুটো সাপ আনার পরিকল্পনা করেছেন?
সৃজিত: (হেসে) ভাবছি। কারণ উলুপীর তো নিজেকে একা মনে হতে পারে, তাই না? এখনও কিছু চূড়ান্ত হয়নি।
প্রশ্ন: সম্প্রতি অমিতাভ বচ্চন ‘অতি উত্তম’-এর ট্রেলার টুইট করে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। আপনার সঙ্গে ওঁর যোগাযোগ কী রকম?
সৃজিত: খুব ভাল। সাধারণত আমি যা কাজ করি, মিস্টার বচ্চন তার খোঁজ রাখেন। জন্মদিনে কথা হয়। নতুন কিছু ইন্টারেস্টিং কাজ করলেই ওঁকে জানাই। ‘পদাতিক’-এর সময়ে ওঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম যে মৃণাল সেনের থেকে পাওয়া ৩০০ টাকা দিয়েই ওঁর সিনেমার পথ চলা শুরু হয়েছিল কি না। উনি জানিয়েছিলেন যে, এটাই ঠিক তথ্য। এমনকি ছবির পোস্টারও উনি সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেছিলেন।
প্রশ্ন: ছবির ট্রেলার ঘিরে কৌতূহল দানা বেঁধেছে। এই ছবির ভাবনা কী ভাবে আসে?
সৃজিত: দুটো কারণ। প্রথমত, এমন সময়ে জন্মেছি যে উত্তমকুমারের সঙ্গে কাজ করার সৌভাগ্য হয়নি। দ্বিতীয়ত, ওঁর জন্মদিন বা মৃত্যুদিনে সংবাদমাধ্যমের তরফে একটা প্রশ্নের বার বার আমাকে উত্তর দিতে হত— ‘‘উনি বেঁচে থাকলে আপনি ওঁকে কোন চরিত্রে কাস্ট করতেন।’’ তার পর একটা সময়ে মনে হল, চেষ্টা করে দেখি। সময়ের কাঁটাকে কী ভাবে পিছনো সম্ভব, সেই ভাবনা থেকেই আইডিয়াটা আসে।
প্রশ্ন: পুরনো ছবির দৃশ্যের মাধ্যমে উত্তমকুমারকে পর্দায় ফিরিয়ে আনা কতটা কঠিন ছিল?
সৃজিত: খুব কঠিন! অনেকে দেখছি ছবির ভিএফএক্স-এর মানের সমালোচনা করছেন। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে, ওঁর একাধিক পুরনো ছবির প্রিন্টের অবস্থা খুবই শোচনীয়। ‘নায়ক’-সহ খুব কম সংখ্যক রেস্টোর করা হয়েছে। ৮৭টা ছবি দেখে ৫৪টা ছবির থেকে ক্লিপিংস নেওয়া হয়েছে। সেই মতো চিত্রনাট্য সাজাতে হয়েছে। ৫৪ বার চিত্রনাট্য আবার লিখতে হয়েছে। তার থেকেও বড় কথা, নেগেটিভ, ডিজিটাল ও স্যাটেলাইট স্বত্ব যাঁদের কাছে রয়েছে তাঁদের খুঁজে বার করাটা সব থেকে কঠিন। কারও দাদু হয়তো একটাই উত্তমকুমারের ছবি প্রযোজনা করেছিলেন। তাঁদের এখন এসি’র ব্যবসা! কারও বর্তমান বংশধর হয়তো এখন হোটেল চালান। এটা নিয়েই একটা আলাদা তথ্যচিত্র তৈরি হতে পারে।
প্রশ্ন: সে রকম কোনও পরিকল্পনা রয়েছে কি?
সৃজিত: দুঃখের বিষয়, আমাদের সে রকম কোনও পরিকল্পনা ছিল না। কারণ ছবিটা যে বাস্তবায়িত হবে, এ রকম কোনও ধারণাই তখন আমাদের ছিল না।
প্রশ্ন: গত বছর ২৪ জুলাই উত্তমকুমারের মৃত্যুদিনে ছবির টিজ়ার প্রকাশ্যে আসে। কিন্তু ছবি মুক্তি পেতে এতটা সময় লেগে গেল কেন?
সৃজিত: এই যে এত ক্ষণ যেগুলো বললাম তার জন্য। তা ছাড়া টিজ়ার দেখার পর আমি নিজেই খুব একটা খুশি ছিলাম না। কারণ উত্তমবাবুর চারপাশে ওই আবছা ধোঁয়া ধোঁয়া এফেক্টটা ছিল না। ফলে ‘ভূত’ বিষয়টা স্পষ্ট ছিল না। তাই আরও বেশি সময় নিয়েছিলাম।
প্রশ্ন: ‘পদাতিক’-এ আপনি এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) ব্যবহার করে সত্যজিৎ রায়ের কণ্ঠস্বর জীবন্ত করেছেন। কিন্তু এই ছবিতে সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়ে মহানায়কের কণ্ঠস্বর ফিরিয়ে আনলেন কেন?
সৃজিত: যে কণ্ঠস্বরে খুবই নয়েজ় ছিল, সেগুলো সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়ে ডাবিং করিয়েছিলাম। তার মধ্যে এল এআই। আমি নতুন প্রযুক্তির খোঁজখবর রাখি। তখন ঠিক করি সুরজিৎদার কণ্ঠ অভিনয় এবং এআই-এর সাহায্যে উত্তমকুমারের কণ্ঠস্বরের ধরনকে ফুটিয়ে তোলা হবে। ‘পদাতিক’-এ যে আমেরিকান এআই কোম্পানির প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, এই ছবিতেও তারাই কাজ করেছে। (ফোন বার করে ‘পদাতিক’-এর ট্রেলার দেখালেন)
প্রশ্ন: বিশ্বব্যাপী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিরোধী আন্দোলন চলছে। সেখানে আপনি এআই-এর সাহায্য নিলেন!
সৃজিত: কম্পিউটার যখন এসেছিল, তখনও প্রচুর কথা হয়েছিল। নতুন প্রযুক্তিকে ভয় না পেয়ে তাকে কী ভাবে কাজে লাগানো যায়, আমার মনে হয় সেটা নিয়ে বেশি আলোচনা হওয়া উচিত।
প্রশ্ন: ‘অতি উত্তম’ নিয়ে ব্যাপক ট্রোলিং শুরু হয়েছে। ট্রোলিং কি এখন আপনাকে আলাদা করে আর ভাবায়?
সৃজিত: একদম নয়। যে যে মিমগুলোর মধ্যে বুদ্ধিমত্তার ছাপ রয়েছে, আমি তো সেগুলো নিজে সমাজমাধ্যমে শেয়ারও করি (হাসি)। বরং নতুন কিছু হলে যদি ট্রোলিং না হত, তা হলে হয়তো চিন্তায় পড়ে যেতাম। মনে হত, তা হলে কি আমি ঠিক করছি? বিশেষ করে বঙ্গদেশে তো নতুন কিছু করলেই ট্রোলড হওয়া স্বাভাবিক!
প্রশ্ন: কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আপনার সাম্প্রতিক টুইট কি ট্রোলারদের উদ্দেশে জবাব ছিল?
সৃজিত: (হেসে) না, না ওটা তো যাঁরা ট্রোলের শিকার, তাঁদের জন্য। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেও ট্রোলাররা ছাড় দেয়নি! তাই মনখারাপ করার কিছু নেই।
প্রশ্ন: ‘অটোগ্রাফ’, ‘জাতিস্মর’, ‘শাজাহান রিজেন্সি’, ‘এক যে ছিল রাজা’ পেরিয়ে এ বার ‘অতি উত্তম’। আপনার ছবিতে অনুপ্রেরণা হিসেবে উত্তমকুমার বার বার ফিরে আসেন।
সৃজিত: এটা কাকতালীয়। কারণ উত্তমবাবু এমন বিষয় নিয়ে কাজ করতেন যেগুলো বাঙালির খুব কাছের। ‘চৌরঙ্গী’ আমারও প্রথম পড়া উপন্যাস। বাংলা সঙ্গীতের প্রতি আমার ভাল লাগা থেকে ‘জাতিস্মর’। ছোটবেলায় দাদু-দিদার মুখে ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মামলা নিয়ে শুনেছি। আজকে আমি শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ঝিন্দের বন্দি’ পড়ে ছবি বানালে বলা হবে যে রিমেক করা হচ্ছে! অনুপ্রেরণা আর রিমেকের মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে, সেটাই অনেকে ভুলে যান।
প্রশ্ন: বক্স অফিসকে মাথায় রেখে এই ছবিতে কোনও তারকা নির্বাচন করেননি। সেটা কি উত্তমকুমারকে প্রাধান্য দেওয়ার স্বার্থে?
সৃজিত: না। ২০১০ থেকে ২০২০, আমার কেরিয়ারের প্রথমার্ধ ধরে নেওয়া যেতে পারে। এর পর থেকে আমি চেষ্টা করছি, কাজ নিয়ে একটু এক্সপেরিমেন্ট করতে। অন্য ধরনের ছবি তৈরি করতে। আগে নতুন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করেছি। হারিয়ে যাওয়া অভিনেতাদের খুঁজে আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছি। কিন্তু নতুন অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করিনি। কেরিয়ারের এই সময় থেকে আমি নতুন অভিনেতাদের নিয়ে আরও বেশি কাজ করতে চাই। যেমন ধরা যাক ‘এক্স= প্রেম’।
প্রশ্ন: তার মানে কি আপনি নতুন ‘ট্রেন্ড’ শুরু করতে চাইছেন?
সৃজিত: আমি কোনও রকম ট্রেন্ড তৈরিতে বিশ্বাসী নই। শুরু থেকেই নিজের জন্য ছবি তৈরি করেছি। সেটা কোনও নতুন ধারা শুরু করবে কি না, তা নিয়ে আমি কোনও দিনই আলাদা করে ভাবিনি। বাজারে কী চলবে, সে চিন্তা ‘অটোগ্রাফ’-এর সময়েও ছিল না, এখনও নেই।
প্রশ্ন: টলিউডে এখন পারিবারিক ছবির ভিড়। একাধিক ছবি বক্স অফিসে সাফল্যের মুখ দেখেছে। আপনার ইচ্ছে করে না এই ধরনের ছবি পরিচালনা করতে?
সৃজিত: ইচ্ছে নেই। পারিবারিক ছবি তৈরির জন্য ইন্ডাস্ট্রিতে বহু ভাল পরিচালক রয়েছেন। আর ইন্ডাস্ট্রির জন্য এ রকম ছবিরও প্রয়োজন। এই ধরনের ছবিকেই এখন মূল ধারার ছবি বলা হচ্ছে। এই ধরনের ছবিকে কেউ ‘সিরিয়াল’ বলে গালাগাল করতেই পারেন! কিন্তু এই ধরনের ছবি যে দর্শককে প্রেক্ষাগৃহে নিয়ে আসছে, সেটা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। আর বক্স অফিস কিন্তু ইন্ডাস্ট্রির সুস্বাস্থ্যের জন্য খুবই জরুরি।
প্রশ্ন: গত বছর আপনার বুকে ব্যথা থেকে শুরু করে ডেঙ্গি। চিকিৎসকেরা বলেছিলেন বিশ্রাম করতে। কিন্তু কাজের ব্যস্ততায় বিশ্রাম কি আদৌ হচ্ছে?
সৃজিত: আমি শুটিং ফ্লোরে সব থেকে ভাল বিশ্রাম করতে পারি। যে কাজটা করতে সব থেকে বেশি পছন্দ করি, সেটাই আমার পেশা। তাই এই মুহূর্তে ‘বি-শ্রম’ নিয়ে ভাবছি না। বরং ভাবছি, মাঝে অতিমারির জন্য দু’বছর পিছিয়ে গিয়েছি। ফলে এখন অনেকগুলো কাজ পর পর মুক্তি পাচ্ছে। আসলে আমার টিমের সদস্যেরা খুবই ভাল। তাই আমি পর পর এতগুলো কাজ করতে পারি।
প্রশ্ন: কিন্তু এক জন নির্মাতা হিসেবে ভিন্ন স্বাদের কনটেন্ট নিয়ে গবেষণা এবং লেখা তো সহজ নয়।
সৃজিত: (হেসে) কম ঘুমাই। আমি দিনের মধ্যে মেরেকেটে ৪ ঘণ্টা মতো ঘুমোই। নিজের পড়াশোনা, পোস্ট প্রোডাকশন, মুম্বই ও কলকাতা মিলিয়ে প্রযোজকদের নতুন কনসেপ্ট শোনানো— বুঝতেই পারছেন প্রচুর কাজে ডুবে থাকি।
প্রশ্ন: অনেকেই বলছেন আপনি এখন বলিউডকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। ‘শাবাশ মিথু’ বা ‘শের দিল’-এর পর মুম্বইয়ে নিজের জায়গা কতটা পাকা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে?
সৃজিত: ওখানে ওটিটিতে আমার একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। কারণ ‘জাঁবাজ় হিন্দুস্তান কে’ সিরিজ়টা দর্শকদের পছন্দ হয়েছে। আবার আপনি যে দুটো ছবির কথা বললেন, সেগুলো ওটিটিতে অনেক বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এই বছর ‘শেখর হোম’ সিরিজ়টা মুক্তি পাবে। হিন্দি ছবির কথাও চলছে। কিন্তু সেটা ডেট পাওয়ার উপর নির্ভরশীল।
প্রশ্ন: বাংলা থেকে বলিউডে কাজ করতে গিয়ে কি অনেক বেশি ইন্ডাস্ট্রির গোষ্ঠী রাজনীতির শিকার হতে হয়?
সৃজিত: রাজনীতি ঠিক নয়। তবে ‘লবি’ তো রয়েইছে। বলিউডে আমি হয়তো বাংলার তুলনায় আট গুণ বেশি পারিশ্রমিক পাই। বাংলায় বাজেট কম হতে পারে, কিন্তু নাক গলানো বিষয়টা একদমই নেই। মুম্বইয়ে বিনিয়োগের পরিমাণ বেশি, অংশীদার বেশি। তাই স্বাভাবিক ভাবেই মতামতও বেশি।
প্রশ্ন: বলিউডে আপনি এই নাক গলানোর সম্মুখীন হয়েছেন?
সৃজিত: প্রচণ্ড। সেই ‘রে’ তৈরির সময় থেকে। তবে আমার মতে, প্রত্যেকটা ইন্ডাস্ট্রিতেই সমস্যা থাকে। নিজস্ব একটা যুদ্ধ থাকে। সেটার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েই কাজ করতে হয়।
প্রশ্ন: বলিউডে কাজ নিয়ে আপনি কি এখন তা হলে আগের থেকে বেশি আশাবাদী?
সৃজিত: (হেসে) এখন আমার মাথা অনেক বেশি ঠান্ডা হয়েছে। এখন মুম্বইয়ে ঝগড়া অনেক কম করি। যদি দেখি কোনও প্রজেক্টে বড্ড বেশি নাক গলানো হচ্ছে, তা হলে আমি সেখানে ঢুকিই না।
প্রশ্ন: চলতি বছরে তা হলে আপনার অনেকগুলো কাজই মুক্তির অপেক্ষায়।
সৃজিত: ‘পদাতিক’ মুক্তি পাবে। পুজোয় আসছে ‘টেক্কা’। নতুন একটা বাংলা ছবির (‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’) কাজ শুরু হবে। একটা বাংলা আর একটা হিন্দি ওয়েব সিরিজ় নিয়ে কথা চলছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy