Advertisement
২৭ নভেম্বর ২০২৪

বলিউডি শিল্প কারিগরি বদলে দিচ্ছেন বাঙালিরা

জানুয়ারি ২০১৪। ধূ ধূ বরফে ঢাকা পহেলগাঁও। পেঁজা তুলোর মতো বরফ পড়ছে। কবরখানার সামনে একটি কাঠের বাড়ি থেকে ধুন্ধুমার গোলাগুলি চলছে। শ্যুটিংয়ের মধ্যেই শাহিদ কপূর বারবার বলছিলেন, বাড়িটা বড় সুন্দর! পরিচালক বিশাল ভরদ্বাজ মুচকি হেসে বললেন, “এটা আসল বাড়ি নয়, সেট।” বিশ্বাস করতে পারেননি শাহিদ। প্রোডাকশন ডিজাইনারকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, “সুব্বু, ইয়ে সেট হ্যায়? তিন দিনসে ম্যায় সমঝ নহি পায়া!”

কাশ্মীরে ‘হায়দর’-এর সেট নির্মাণ। ছবি: সুব্রত চক্রবর্তীর সৌজন্যে

কাশ্মীরে ‘হায়দর’-এর সেট নির্মাণ। ছবি: সুব্রত চক্রবর্তীর সৌজন্যে

সুজিষ্ণু মাহাতো
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:০২
Share: Save:

জানুয়ারি ২০১৪। ধূ ধূ বরফে ঢাকা পহেলগাঁও। পেঁজা তুলোর মতো বরফ পড়ছে। কবরখানার সামনে একটি কাঠের বাড়ি থেকে ধুন্ধুমার গোলাগুলি চলছে।

শ্যুটিংয়ের মধ্যেই শাহিদ কপূর বারবার বলছিলেন, বাড়িটা বড় সুন্দর! পরিচালক বিশাল ভরদ্বাজ মুচকি হেসে বললেন, “এটা আসল বাড়ি নয়, সেট।” বিশ্বাস করতে পারেননি শাহিদ। প্রোডাকশন ডিজাইনারকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, “সুব্বু, ইয়ে সেট হ্যায়? তিন দিনসে ম্যায় সমঝ নহি পায়া!”

সুব্বু, অর্থাৎ সুব্রত চক্রবর্তী আর তাঁর বন্ধু অমিত রায়। ‘হায়দর’-এর প্রোডাকশন ডিজাইনার। হায়দরের পরে তামাম বলিউডের প্রশংসায় ভাসছেন এই দুই বঙ্গসন্তান। সুব্রতর দাবি, কাশ্মীর নিয়ে এত নিখুঁত প্রোডাকশন ডিজাইনিং সাম্প্রতিক কালে হয়নি। কেন? “সাম্প্রতিক অতীতে কাশ্মীরে যে যে ছবি হয়েছে সেগুলো আউটডোর অথবা কোনও স্থায়ী নির্মাণকে ঘিরে হয়েছে। কিন্তু হায়দরের একাধিক বিস্ফোরণের দৃশ্য থাকায় আমরা কারও বাড়িতে তা করতে পারিনি। প্রতিটি সেট তৈরি করতে হয়েছে। সুব্রতর কথায় সায় দিয়েছেন কাশ্মীরে হায়দরের শ্যুটিং কো-অর্ডিনেটর বিলাল আহমেদও। প্রায় এক দশক ধরে বিলাল কাশ্মীরে একাধিক বলিউডি ছবির শ্যুটিংয়ের দায়িত্ব সামলেছেন। তাঁর কথায়, “এখানে বলিউড মূলত আউটডোর শ্যুটিং করতে আসে। আমার স্মরণকালে এ রকম বিশাল মাপের সেট তৈরি করে কাশ্মীরে কাজ হয়েছে বলে মনে পড়ে না।”

শুধু সুব্রত ও অমিত নন, বলিউডের প্রোডাকশন ডিজাইনিংয়ের ক্ষেত্রে এখন বড় জায়গা নিচ্ছেন আর্ট কলেজ থেকে পাশ করা বাঙালিরা। সুব্রত-অমিতের জুটির টিমে সকলেই আর্ট কলেজের ছাত্রছাত্রী। তাদের মধ্যে বাঙালিরাও রয়েছেন। বলিউডের আর এক শীর্ষস্থানীয় প্রোডকাশন ডিজাইনার জুটি, সুমিত বসু ও স্নিগ্ধা বসু দু’জনেই আর্ট কলেজের প্রাক্তনী। সমীর চন্দ বা নীতিশ রায়ের মতো বিখ্যাত বাঙালি প্রোডাকশন ডিজাইনাররাও তাই-ই ছিলেন। এর মধ্যে সমীরের কাছেই হাতেখড়ি ছিল সুব্রত-অমিতের। অমিতের কথায়, “নিজেরা কাজ শুরু করার আগে এক দশক সমীর চন্দের সহকারী হিসেবে কাজ করেছি। ওনার অভিভাবকত্বে ওমকারা, রং দে বসন্তী, গুরু, রাবণের মতো ছবিতে কাজ করেছি।”

সুব্রত-অমিত-স্নিগ্ধারা সকলেই এক বাক্যে বলছেন, প্রোডাকশন ডিজাইনের ধারণায় বছর দশেক হলো একটা পরিবর্তন এসেছে বলিউডে। তার পিছনে হলিউডের একটা বড় প্রভাব রয়েছে। এর আগে প্রোডাকশন ডিজাইনারের বদলে শিল্প নির্দেশক বলার চলই ছিল বেশি। এবং সমীর চন্দের মতো শিল্প নির্দেশকেরও আক্ষেপ ছিল, এ দেশে প্রোডাকশন ডিজাইনারদের আসলে গালভরা কাঠের মিস্ত্রী ছাড়া কিছু মনে করা হয় না। মূলধারার ছবিতে শিল্প নির্দেশনাকে আলাদা করে তেমন গুরুত্বই দেওয়া হতো না। তার মধ্যেই ব্যতিক্রমী পরিচালক, ব্যতিক্রমী শিল্প নির্দেশক অবশ্যই ছিলেন। এবং তার মধ্যেও বাঙালিরা অগ্রগণ্য। অজিত বন্দ্যোপাধ্যায় (গুড্ডি, আনন্দ, আঁধি), বীরেন নাগ (সিআইডি, প্যাসা, সাহিব বিবি আউর গুলাম), সুধেন্দু রায়রা (মধুমতী, ডন, ডর) শিল্প নির্দেশক হিসেবে খুবই সমাদর পেয়েছিলেন। সত্যজিৎ রায়ের সহকর্মী বংশী চন্দ্রগুপ্তও বলিউডে গিয়ে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করেছেন। কিন্তু গড়পড়তা ভাবে শিল্প নির্দেশনা বলতে বোঝাতো চিত্রনাট্যের চাহিদা মতো সেট এবং প্রপস জোগানো।

কিন্তু এখন প্রোডাকশন ডিজাইনাররা ছবির দৃশ্যভাবনাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। পরিচালক ও চিত্রগ্রাহকের সঙ্গে মিলে ছবির সার্বিক ডিজাইন নির্মাণ করেন। শিল্প নির্দেশক প্রোডাকশন ডিজাইনারের নির্দেশে কাজ করেন। দৃশ্যের ডিজাইনের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে অভিনেতাদের পোশাক পরিকল্পনা করা হয়। সুব্রতর মতে, ব্যাপারটা বদলানোতে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল আরেক দিকপাল প্রোডাকশন ডিজাইনার-শিল্প নির্দেশক নীতিন দেশাইয়ের। “লগান, এবং বিশেষত দেবদাস-এর নীতিনজীর কাজ দেখে হইচই পড়ে যায়। তার পর থেকেই প্রোডাকশন ডিজাইনারদের কাজ নিয়ে আগ্রহ বাড়তে থাকে”, বললেন সুব্রত। সুধেন্দুর কন্যা শর্মিষ্ঠা রায়ও বলিউডে এই ধারায় অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছেন। দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে জায়েঙ্গে থেকে কভি খুশি কভি গম, কাল হো না হো থেকে বান্টি আউর বাবলি, তাঁরই করা।

বলিউডের আর এক বাঙালিনি স্নিগ্ধা বসু জানাচ্ছেন, তাঁদের সংস্থা ১৮ বছর বলিউডে কাজ করছে। যাদের ঝুলিতে রয়েছে গুজারিশ, রকস্টার, ভাগ মিলখা ভাগ, ককটেল, হাইওয়ে, কিক, ধুম থ্রি-র মতো ছবি। আমির খানের আগামী ছবি ‘পিকে’-র কাজও করেছেন তাঁরা। স্নিগ্ধার কথায়, “ধুম থ্রি-র সার্কাসের দৃশ্য দেখে অনেকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন এটা ম্যাকাওতে শ্যুটিং হয়েছিল কি না। এটাই আমাদের সাফল্য।” স্নিগ্ধার মতে, এখনকার দর্শক ছবি তৈরির খুঁটিনাটি নিয়েও যথেষ্ট আগ্রহী। নতুন প্রজন্মের এই সচেতনতার জেরেই এ কাজে ক্রমশ আগ্রহ বাড়ছে আর্ট কলেজ থেকে পাশ করা তরুণদের। আগ্রহ বাড়ছে বাঙালিদেরও।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy