ছবি: সুদীপ আচার্য
পয়লা বৈশাখ দূর অস্ত্, আসন্ন জুন মাস অবধি আমার ছুটি নেই। কখনও সিনেমার শুটিং, কখনও স্ক্রিপ্ট নিয়ে বসা, কখনও টেলিভিশন কিংবা স্টেজ শো... প্রতি দিনই টানা পরিশ্রম। মাঝে ছেলে তৃষাণজিৎ হস্টেল থেকে ফিরল। বাবা হিসেবে কষ্ট হচ্ছিল। এক-দু’ দিন কাজ বন্ধ রেখে ওর সঙ্গে খেলাধুলো, গল্প করলেই তো ভাল হত। কিন্তু তখনই মস্তিষ্কের ধূসর পদার্থে কী যেন কিলবিল করে উঠল। কাজ বন্ধ মানেই প্রযোজকের এতগুলি টাকা, অনেক মানুষের খাটাখাটনি, শিডিউলের হেরফের। তার চেয়ে আউটডোরে বরং ওকে নিয়েই যাই। পরিশ্রম না থাকলে বিশ্রাম শব্দটাই অর্থহীন।
তা হলে বাঙালি পরিশ্রমবিমুখ, স্বভাব-অলস, এমন ধারণা তৈরি হল কী ভাবে? মুম্বই, চেন্নাইতেও অনেকে বলেন, ‘দাদা, আপলোগ তো সুস্থ হ্যায়।’ মানে, আপনারা শান্ত মেজাজে মন্দ্রমন্থর গতিতে ধীরেসুস্থে চলেন। প্রতি বারই মনে মনে প্রতিবাদ করেছি। বাঙালি মোটেই এ রকম নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাশি রাশি কবিতা, গল্পের পাশাপাশি অজস্র চিঠি, ছবি, মায় শান্তিনিকেতন নামে একটা আশ্রমিক স্কুল তৈরি করে গিয়েছেন। তাঁকে আমি চোখে দেখিনি ঠিকই। কিন্তু চরিত্র নিয়ে উত্তম জেঠু কী পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, পরিচালক ‘ওকে’ বলার পরেও ক্ষান্ত হচ্ছেন না, আরও পাঁচ ভাবে সংলাপ বলছেন, কিংবা ‘একটি জীবন’ ছবির জন্য সৌমিত্র জেঠু পাঁচ ঘণ্টা ধরে মেক আপ নিচ্ছেন, সে সব নিজের চোখে দেখা। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী যে স্ট্যামিনায় উদয়াস্ত পরিশ্রম করে যান, অনেকের কাছে শিক্ষণীয়। বাঙালির পরিশ্রমবিমুখতা তাই রিয়েলিটি বা বাস্তব নয়, পারসেপশন বা কল্পিত ধারণামাত্র। শিক্ষিত বাঙালি লেখাপড়া ভালবাসে, ফলে দৌড়ঝাঁপের বদলে ডেস্কে বসার ‘হোয়াইট কলার জব’ পছন্দ করে। খেতে ভালবাসে, ফলে টেবিলে দু’চার রকম চর্ব্যচোষ্য না হলে তৃপ্ত হয় না। এই সব জায়গা থেকেই হয়তো পারসেপশনটা তৈরি হয়েছে।
পারসেপশন তৈরির আরও কারণ আছে। জীবনের অভিজ্ঞতা একটু শেয়ার করি! আমার বাবা-মা আমার জন্য বাড়ি তো দূরের কথা, একটা ইটও রেখে যাননি। আমাকে পরিশ্রম করে বাড়ি বানাতে হয়েছে। এই ব্যাপারটায় আমি ব্যতিক্রম নই। পৈতৃক সম্পত্তিহীন অনেক বাঙালির অভিজ্ঞতাই আমার মতো। কিন্তু একটা স্তরের পর গল্পটা বদলে যায়। যে ভদ্রলোক এ ভাবে প্রাণপাত পরিশ্রমে দুটো বাড়ি তৈরি করলেন, তিনি থমকে গেলেন। হয়তো তাঁর মনে হয়, অনেক খাটুনি, দৌড়ঝাঁপ গেল। এ বার একটু আরামে থাকা যাক। তাঁর পরিশ্রমটা কিন্তু আর ‘ভিজিব্ল’ হল না।
এই আরামে থাকাটা আমার ধাতে সয়নি। সিনেমার পাশাপাশি কখনও জি-টিভিকে বাংলায় আনার চেষ্টা করেছি, কখনও বা ফিল্ম সিটি তৈরির স্বপ্ন দেখেছি। একটা সময় দিনে প্রায় কুড়ি ঘণ্টা কাজ করতে হত। টানা শুটিং। তারই মধ্যে স্টেজ শো, পোস্টারের জন্য ফোটো-শুট ইত্যাদি। এখনও ১৮ ঘণ্টা পরিশ্রমের সেই রুটিনটা বিন্দুমাত্র বদলায়নি। ধরনটা বদলেছে। আগে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোটাই ছিল সব। এখন তার পাশাপাশি অফিস চালানো, টিভি প্রোগ্রামের জন্য ‘সফ্টওয়্যার’ তৈরি, মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি নিয়ে মিটিং করা ইত্যাদি। আগে রাত আটটায় একটা ছবির শুটিং শেষ করে অন্য ফ্লোরে ঢুকতাম। এখন অন্য ফ্লোরে আর ঢুকি না। বরং অফিসের ছেলেদের বলে দিই, ‘রাত ন’টায় পৌঁছচ্ছি। মিটিং-এ বসব। একটু থাকিস।’ টিভি সিরিজ ‘তুমি যে আমার’-এর জন্য সে দিনও প্রায় ১৩ ঘণ্টা শুট করেছি। শো-টায় বসা যায় না, টানা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
হিতৈষীরা অনেকেই আমাকে বলেন, ‘এত পরিশ্রম কেন কর? এখন তো রিল্যাক্সড থাকার সময়।’ কেউ কেউ তো ‘ওয়ার্কাহলিক’ তকমা দিতেও ছাড়েন না। কিন্তু আমার জীবনদর্শন অন্য। আজ স্বপ্ন দেখুন, পেট পুরে ডাল-ভাত খাব। স্বপ্ন সত্যি হলে আগামী কাল ভাবতে হবে, রোজ মাছ-ভাত খাব। মাছ-ভাত জুটে গেলেও স্বপ্ন থামে না। তখন ভাবতে হবে, রোজ মাংস-ভাত খাব। মাংস-ভাত জুটে গেলে তখন চিন্তা হবে, রোজ মাংস-ভাত? বিরিয়ানি, পিৎজা, পাস্তাই বা কেন নয়? সেই স্বপ্নটাও পূরণ হয়ে গেলে ভাবতে হবে, এতেই থেমে থাকব? পিৎজা খেতে গেলে বরং ইতালি থেকে আনাব, বিরিয়ানি খেতে বসলে লাহৌর থেকে। জীবনে দুটো রাস্তা আছে। এক, কিছু দূর এগিয়ে যাওয়ার পর থমকে যাওয়া, রিল্যাক্স করা। দ্বিতীয়টা অন্য রকম। স্বপ্নের গণ্ডিটা রোজ একটু-একটু করে বাড়িয়ে যাওয়া। সেই অনুযায়ী কাজ করা। আমার স্বপ্নটা গত তিরিশ বছর ধরে প্রতি দিন বিভিন্ন ভাবে বদলে গিয়েছে। কখনও ভেবেছি, সবাইকে টপকে আমিই হব ব্যস্ততম, সেরা নায়ক। সেই স্বপ্ন পূরণের পর মনে হয়েছে, এ বার আর ব্যস্ততম নায়ক নয়, হতে হবে অন্য রকম নায়ক। সে দিনও ‘জাতিস্মর’-এর জন্য তিন সপ্তাহে ১৫ কেজি ওয়েট কমাতে হয়েছে। এখন পরমের ‘লড়াই’ ছবির জন্য রোজ ওয়েট ট্রেনিং, ফুটবল নিয়ে দৌড়। লক্ষ্যটা আরও একটু বেড়ে গিয়েছে। ইন্ডাস্ট্রিতে পরের প্রজন্ম যেন বলতে পারে, বুম্বাদাকে দেখে অনেক কিছু শিখেছি! প্রতিটি বাঙালি যদি আজ বড় করে স্বপ্ন দেখতে শেখে, তার পর সেই অনুযায়ী দৌড়য়... ইতিহাস বদলে যাবে। আমার যেমন নতুন স্বপ্ন, কলকাতায় বসে হিন্দি ভাষায় ছবি পরিচালনা করব। আগেও ‘পুরুষোত্তম’ ছবি পরিচালনা করেছি, কিন্তু এখন ছবির ভাষা এত বদলে গিয়েছে! এই বদলে-যাওয়া সময়েও নিজেকে নিয়ে বড় করে স্বপ্ন দেখব না? চেষ্টা করব না নতুন কিছু করার? খেয়াল করলে দেখবেন, বাঙালি আসলে পরিশ্রমবিমুখ নয়। বরং স্বপ্নের গণ্ডি বাড়াতে বিমুখ।
সংশয়ীরা অবশ্য পালটা প্রশ্ন তুলতে পারেন, স্বপ্নের গণ্ডি বাড়তে বাড়তে সেটা গ্যাস বেলুনের মতো ফেটে যাবে না তো! আমার উত্তর: না। স্বপ্ন দেখাটা শিখতে হবে। পঁচিশ বছর আগে আমি যেমন সারা বছর রোদে পুড়ে, জলে ভিজে টানা তিন শিফ্ট শুট করতে পারতাম, এখন নিশ্চয় সেই ধকল নিতে পারব না। ফলে আরও নানা কাজ, কখনও টিভি সিরিজ, কখনও বা দুঃস্থ টেকনিশিয়ানদের সাহায্য করার জন্য মিটিং। কায়িক শ্রমটাই সব নয়। তার সঙ্গে ব্যালান্স করে নিয়ে আসতে হবে মানসিক শ্রম। আগে মেনস্ট্রিম ছবিতে নায়কোচিত অভিনয়ে লাফঝাঁপ, নাচগান, অ্যাকশন... প্রচুর কায়িক পরিশ্রম যেত। এখন ক্যারেক্টার স্টাডি করতে হয়। বাউল কী ভাবে একতারা ধরছেন, তাঁর বডি ল্যাংগোয়েজ তখন কেমন! কিংবা হাই পাওয়ার লেন্সের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে বইপোকা কুশল হাজরা কী ভাবে মৃগী রোগীর মতো ছটফট করতে করতে নিজের অজান্তে ফিরে যেতে পারে পূর্বজন্মে! এখানে কায়িক শ্রমের থেকে মানসিক শ্রম অনেক বেশি। স্বপ্ন দেখতে শিখুন, ঠিক বুঝে যাবেন, কখন কায়িক শ্রম থেকে মানসিক শ্রমে, আবার কখন মানসিক থেকে কায়িক শ্রমে শিফ্ট করতে হয়। বাঙালি দুটোই জানে। হয়তো ব্যালান্সটা অনেক সময় করে উঠতে পারে না। কিন্তু সে জন্য গোটা জাতিকে পরিশ্রমবিমুখ আখ্যা দেওয়ার কিছু নেই।
অধিকাংশ বাঙালিই পরিশ্রমী, কিন্তু শেখেনি শক্তি সঞ্চয়ের কলাকৌশল। এনার্জিরও পরিমাপ আছে, সেটাকে স্টোর করে রাখতে হয়। অমিতাভ বচ্চনকে দেখেছি, পাশে বসে বাবা, কাকার মতো সস্নেহে কথা বলছেন। মনেই হবে না উনি বিশেষ কেউ। অথচ ক্যামেরা চালু হলেই অন্য মূর্তি। অফুরান এনার্জিতে ভরপুর, তাঁর সঙ্গে একটি সংলাপে টক্কর দিতে গেলেও ভাবতে হয়। এই এনার্জি স্টোর করে রাখার ব্যাপারটা প্রবল ভাবে রয়েছে সৌমিত্র জেঠুর মধ্যে। আজও মঞ্চে রাজা লিয়ারের মতো চরিত্র পেলে প্রবল শক্তিমত্তায় অন্যদের ছাপিয়ে যান। আগে নাটক, স্টেজ শো, টানা শুটিং-এ অনেক সময় ক্লান্ত লাগত। রবিকাকু (রবি ঘোষ) আমাকে বলেছিলেন, ‘দুটো শটের মাঝে দশ মিনিট সময় পেলেও চোখ বুজে একটু গড়িয়ে নিবি। ঘুমোনোর দরকার নেই, নিঃশব্দে চোখ বুজে শুয়ে থাকা।’ উপদেশটা আজও কাজে লাগে। গুরুজনদের পরামর্শ, নিজস্ব অভিজ্ঞতা সব কিছুই আমাকে তাই বারংবার নিঃশব্দে জানায়, বাঙালি চেষ্টা করলেই পারে। পারে স্বপ্ন দেখতে, স্বপ্নের পিছনে পরিশ্রম, উদ্যম এবং অধ্যবসায় নিয়ে লেগে থাকতে। বাঙালির পরিশ্রমবিমুখতা স্রেফ মিথ-কল্পনা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy