Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪

দুই দাদার লড়াই

আপনি যখন এটা পড়ছেন, তখন মেলবোর্ন থেকে কমেন্ট্রি করছেন একজন। অন্য জন শীতের সকালেও জিমে। তিন দিন আগের কলকাতার দুপুরে যদিও দু’জনে আড্ডা মারলেন একসঙ্গে। জীবনের চড়াই-উতরাই সামলে কী ভাবে ওপরে উঠতে হয় সেই সব গল্প! শুনলেন ইন্দ্রনীল রায়।আপনি যখন এটা পড়ছেন, তখন মেলবোর্ন থেকে কমেন্ট্রি করছেন একজন। অন্য জন শীতের সকালেও জিমে। তিন দিন আগের কলকাতার দুপুরে যদিও দু’জনে আড্ডা মারলেন একসঙ্গে। জীবনের চড়াই-উতরাই সামলে কী ভাবে ওপরে উঠতে হয় সেই সব গল্প! শুনলেন ইন্দ্রনীল রায়।

শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:০০
Share: Save:

দুপুর আড়াইটে। ল্যান্ড রোভার গাড়ি থেকে নেমে সোজা নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন তিনি।

অন্য জন ‘দাদাগিরি’র এপিসোডের শ্যুটিং সেরে নিজের ঘরে সেক্রেটারির সঙ্গে অফিসের কাজ সারছেন।

প্রথম জনের শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি বক্স অফিসে একেবারেই সাফল্য পায়নি। তাই ফুটবল কোচের চরিত্রে তাঁর পরের ছবি ‘লড়াই’-এর মুক্তির আগে একটু হলেও চাপে তিনি।

অন্য জন তিন বছর আইপিএল খেলার পর হঠাত্‌ একদিন বাদ পড়েছিলেন। সেই মানুষটাই কামব্যাক করলেন আইএসএল-এ। জিতল তাঁর টিম অ্যাটলেটিকো ডি কলকাতা। সেই টিম যেটা কিনতে চেয়েছিলেন শাহরুখ খান।

প্রথম জন প্রসেনজিত্‌ চট্টোপাধ্যায়। বুম্বাদা।

দ্বিতীয় জন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। দাদা।

দু’জনের জীবনেই চূড়ান্ত উত্থানের পাশপাশি চোরাস্রোতে বয়েছে হতাশা, গ্লানি, আর পরাজয়।

কিন্তু কোনও এক জাদুমন্ত্রে তাঁরা বারবার ফিরে পেয়েছেন তাঁদের হারানো জায়গা। এই ‘লড়াই’, এই কামব্যাক... কীসের জাদুকাঠিতে খাদের ধার থেকে তাঁরা বারবার ফিরে আসেন? ‘বাপি বাড়ি যা’ করে দেন তাঁদের প্রতিপক্ষদের...

সামনে ব্ল্যাক কফি। দূরে শীতকালের পড়ন্ত বিকেল। শুরু হল দুই দাদার কথোপকথন। উঠে এল জীবনের নানা ‘লড়াই’য়ের কথা...

প্রসেনজিত্‌: তুমি তো কালকে চলে যাচ্ছ?

সৌরভ: হ্যাঁ, মেলবোর্ন আর সিডনি টেস্ট ম্যাচটার কমেন্ট্রি করতে যাচ্ছি।

প্রসেনজিত্‌: ফিরছ কবে?

সৌরভ: ফিরছি জানুয়ারির ১১ তারিখ।

প্রসেনজিত্‌: ওকে ওকে। প্রথমেই আইএসএল জেতার জন্য অনেক শুভেচ্ছা তোমাকে সৌরভ। কী জিতলে! আমার ছেলে মিশুক কিন্তু প্রথম দিন থেকে বলছিল তোমরা জিতবে।

সৌরভ: আরে সলিড টেনশন ছিল মুম্বইয়ের ফাইনালে। আর সল্ট লেকে যে দিন প্রথম সেমিফাইনাল হল, যে দিন তুমি মাঠে ছিলে বুম্বাদা, সে দিন তো আমার মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। মাঝে মধ্যেই ডিজে চেঁচাচ্ছে: ‘জিতবে কে? এটিকে।’ আমি বললাম ওকে স্লোগান চেঞ্জ করতে বলো। ‘জিতবে কে ছেড়ে’ বলুক ‘গোল করবে কে? এটিকে।’ গোল পাওয়াটাই টেনশনের কারণ ছিল আমাদের।

আপনারা দু’জনে সুপার অ্যাচিভার। জীবনের নানা রং দেখেছেন খুব কাছ থেকে। ‘স্ট্রাগল’, ‘লড়াই’— এগুলো শুনলে কি আজও রক্ত গরম হয়?

সৌরভ: রক্ত গরম হয় কি না জানি না। তবে জীবন মানেই তো নানা স্ট্রাগলকে অতিক্রম করা।

প্রসেনজিত্‌: একদমই তাই। আমরা যারা লাইমলাইটে থাকি, তাদের স্ট্রাগলগুলো মানুষ দেখতে পায়। কিন্তু প্রায় প্রত্যেকটা মানুষ নিজের নিজের জীবনে ছোট বড় লড়াই কিন্তু ক্রমশ করে চলেছে। সেগুলো কিন্তু সমানভাবে অনুপ্রেরণা দেয় আমাকে বা আমাদের। কী স্ট্রাগল এক একজনের!

আচ্ছা দাদা, এই যে আপনারা আইএসএল জিতলেন...

সৌরভ: (প্রায় কথা থামিয়ে) হ্যাঁ, জিতলাম কিন্তু তার পরের দিন কাগজে পড়লাম আমি নাকি একে প্রুভ করতে, ওকে মেসেজ দিতে জিতেছি। এ ভাবে জীবন চলে না।

স্পোর্টস হোক কী সিনেমা কাউকে প্রুভ করতে চাওয়ার চিন্তা নিয়ে কোনও পারফর্মার মাঠে নামে না। মাঠে নামে, কারণ সে জিততে চায়।

আর শুধু একবার জিতলে তো হবে না, বারবার জিততে হবে। রিপিটেড সাকসেস হলেই না তুমি সাকসেসফুল হবে। একটা ম্যাচে সেঞ্চুরি কী একটা সিনেমা হিট হলে হবে না। বুম্বাদা তিরিশ বছর কাজ করে তবে আজকে এই জায়গায় রয়েছে।

জেতার এই খিদেটা কী ভাবে আজও জিইয়ে রাখেন প্রসেনজিত্‌?

প্রসেনজিত্‌: আরে খিদেটা চলে গেলে তো আর খেলাই উচিত না। প্রত্যেক দিন নিজেকে একটু একটু করে চ্যালেঞ্জ জানাই। প্রত্যেক দিন স্টুডিয়োতে ঢোকার সময় আমার তিরিশ বছর আগের এক্সাইটমেন্টটাই থাকে। ফ্লোরে ঢুকলে নিজেকে বলি, কী ভাগ্যবান আমি যে এই সুযোগটা পাচ্ছি।

কিন্তু আপনাদের জীবনে সাকসেসের পাশাপাশি ফেলিওরও রয়েছে প্রচুর।

সৌরভ: খুব মন খারাপ হয়েছে তখন। চেষ্টা করে গিয়েছি কী ভাবে সেটা থেকে বেরোনো যায়। চেষ্টা করেছি কী ভাবে আরও ইমপ্রুভ করা যায়।

প্রসেনজিত্‌: আর ফ্লপের কথা যখন বললেন, তখন বলি, কিছু কিছু ছবির শ্যুটিং করতে করতেই বুঝতে পারি কোথাও একটা তাল কেটে যাচ্ছে। সেই ছবিগুলো না চললে খারাপ লাগে নিশ্চয়ই, কিন্তু অতটা নয়। কিন্তু কিছু ছবি আছে যেগুলোর শ্যুটিং করতে করতে মনে হয়, এটা একশো পার্সেন্ট চলবে। যখন দেখি চলল না, সাঙ্ঘাতিক খারাপ লাগে।

তখন কী করেন? ধরুন, আজ শুক্রবার রাত। ছবি চলেনি বলে রিপোর্ট এসেছে চারিদিক থেকে...

প্রসেনজিত্‌: প্রথমেই ভাবি, কোথায় ভুল করলাম। আগের ভুলগুলো যেন না হয় সেটা নিজেকে বোঝাই। এবং বিশ্বাস করবেন না, পরের দিন সকালে কিন্তু নতুন জোশে শ্যুটিং করতে বেরোই।

আপনার আগের ছবি ‘ফোর্স’ তো একেবারেই চলেনি!

সৌরভ: খুব সারপ্রাইজিং। আমি দেখতে গিয়েছিলাম ছবিটা। সেকেন্ড হাফ দেখতে পারিনি কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, বুম্বাদার ওয়ান অব দ্য বেটার ফিল্মস্‌ ছিল ‘ফোর্স’। দর্শক যে কী চায় বোঝা যায় না...

প্রসেনজিত্‌: আমি নিজেও ‘ফোর্স’ না চলা নিয়ে অনেক ভেবেছি। নিশ্চয়ই আমার কোনও ভুল হয়েছিল। হয়তো দর্শকদের সঙ্গে ঠিক মতো কমিউনিকেট করতে পারিনি।

ফেলিওরটা ভুলে যাওয়াও তো শক্ত হয় মাঝে মাঝে।

সৌরভ: অবশ্যই শক্ত হয়। অত সহজে ভোলা যায় নাকি! এখানে আমি একটা কথা বলব। বুম্বাদার ছবি যদি না চলে, তা হলে পরের ছবির শ্যুটিং, তার স্ক্রিপটিং, তার পাবলিসিটি— সব মিলিয়ে পুরো ব্যাপারটা এক বছর কিন্তু পিছিয়ে গেল। আমার সুবিধা হল, যদি একটা ম্যাচে আমি রান না পাই, তা হলে তিন দিন পরেই আমি আবার সুযোগ পেয়ে যাই পাবলিককে ফেস করার। এটা স্পোর্টস আর এন্টারটেনমেন্টের মধ্যে বড় তফাত।

আর পারফর্ম তো করে যেতেই হবে। মনের মধ্যে হেরে যাওয়ার ভয়টা যেন সর্বক্ষণ থাকে। ফিয়ার অব ফেলিওরটা খুব বড় মোটিভেশনাল ফ্যাক্টর। ওটা না হলে, থ্যাঙ্ক ইউ, বাই বাই। অন্য কেউ এসে নিয়ে নেবে তোমার জায়গা। আমি পনেরো বছর ইন্ডিয়ার হয়ে খেলেছি কারণ প্রত্যেক সিজনে রান করেছি।

এই যে আইএসএল জিতলেন...

সৌরভ: তার আগে আর একটা কথা বলি। তুমি জিতবে তখনই... মোটিভেট করতে তখনই পারবে... যখন কোনও জিনিসকে খুব মন থেকে ভালবাসবে। বুম্বাদার ক্ষেত্রেও আমার তাই মনে হয়।

হ্যাঁ, একটা বইয়ে লেখাও হয়েছিল, বাথরুমে বসেও প্রসেনজিত্‌ বাংলা সিনেমা নিয়ে ভাবেন।

প্রসেনজিত্‌: হ্যাঁ, ওই প্যাশনটা, ওই ভালবাসাটা না থাকলে তুমি সাকসেসফুল হবে না। ‘লড়াই’ ছবিটা আমরা পঞ্চাশ ডিগ্রি গরমের মধ্যে পুরুলিয়াতে শ্যুট করেছি। করতে পেরেছি কারণ আমরা সবাই সিনেমাটা ভালবাসি। পরিচালক হিসেবে পরমও দারুণ কাজ করেছে।

সৌরভ: যখন ভালবাসা, প্যাশনের কথা বলা হচ্ছে, আমি বলি ক্রিকেট ছাড়া আমার জীবনে কিছু নেই। ইট ইজ মাই ফার্স্ট লাভ। যতই ফুটবল টিম চালাই, যতই জিতি, আমি সবচেয়ে খুশি হব যদি আমি একটা আইপিএল টিম কিনতে পারি।

আচ্ছা, বেশির ভাগ মানুষের কাছে সাকসেসের থেকে বেশি ফেলিওর আসে জীবনে। আপনারা কী ভাবে ডিল করতেন ফেলিওরের সঙ্গে? রান না পেলে কী ছবি ফ্লপ করলে, কি বাড়িতে এসে বলতেন আজ ভাল লাগছে না, খাবারটা ঘরে দিয়ে দাও...

সৌরভ: না, ও রকম হয় না। দ্যাখো, তুমি যদি কোনও বিষয় খুব মন দিয়ে ভালবাসো, তা হলে এটাও যেন মাথায় থাকে যে এই ব্যাপারটাই আমাকে করে যেতে হবে কুড়ি বছর ধরে।

তাই ফেলিওর এলে নিজের ঘরে নিজেকে আটকে রেখে তো কোনও লাভ নেই। তোমাকে একটা ব্যালেন্স রাখতেই হবে। জিতলাম আর বাড়িই ফিরলাম না যেমন ভুল, হারলাম আর বাড়ির লোককে এসে মেজাজ দেখালাম তেমনই ভুল।

প্রসেনজিত্‌ও কি একই কথা বলবেন?

প্রসেনজিত্‌: একদমই তাই। সংসারের খুঁটিনাটি দেখতে হবে। আমার হয়তো ছবি চলল না, কিন্তু বাড়িতে এসে গ্যাসের বিল, কী ইলেকট্রিসিটির বিলটা তো দিতে হবে। সেই দায়িত্বগুলো এড়ালে চলবে কী করে? ওই কাজগুলো করার মধ্যেই হারার দুঃখটা ভুলে যেতে হবে। আর সৌরভের কথা ধরেই বলছি, ব্যালেন্সের সঙ্গে সঙ্গে আর একটা জিনিস থাকতে হবে— ধৈর্য। আজকে আমরা যেখানেই পৌঁছেছি সেটা সম্ভব হয়েছে কারণ আমাদের ধৈর্য ছিল।

কিন্তু বাইশ বছর বয়সের যে ছেলেটা বা মেয়েটা ফেলিওর দেখছে, তাকে কী করে বলবেন ধৈর্য ধরতে? সে তো সেই বয়সে ন্যাচারালি ইমপেশেন্ট।

সৌরভ: যদি ইমপেশেন্ট থাকে, তা হলে অন্য কেউ তার জায়গাটা নিয়ে নেবে।

প্রসেনজিত্‌: কেন? সৌরভেরও তো বাইশ বছর বয়স ছিল কোনও দিন। ও কি ধৈর্য দেখায়নি? আমি তো কেরিয়ার শুরু করেছিলাম যখন আমার বয়স সাড়ে ষোলো। ধৈর্য দেখাইনি? ওটা তোমাকে নিজেকেই ডেভেলপ করতে হবে। তবে এটাও বলব, সৌরভ আমাদের সবার কাছে বিরাট ইন্সপিরেশন। আমার কাছে তো বটেই।

আপনি কিছু জিজ্ঞেস করতে চান সৌরভকে?

প্রসেনজিত্‌: যদি জিজ্ঞেস করতে হয়, তা হলে ওকে জিজ্ঞেস করতে চাই— ১৯৯২য়ে অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে ওর মানসিক অবস্থাটা কী ছিল?

সৌরভ: অনেকেই ভাবে, মাই ওয়ার্ল্ড কেম ক্রাশিং ডাউন। আমার পৃথিবীটা কিন্তু একই রকম ছিল বুম্বাদা। আমি চার মাস অস্ট্রেলিয়াতে ছিলাম। ম্যাচ পাচ্ছিলাম না, একদম ভাল লাগছিল না অস্ট্রেলিয়া। বাড়ি ফিরে বেঁচেছিলাম। আর কী জানো বুম্বাদা, বিভিন্ন বয়সে মানুষের চিন্তাধারাগুলো আলাদা আলাদা থাকে।

তুমি উনিশে যে রকম ভাবছ, ছাব্বিশে সে রকম ভাবে ভাববে না। তুমি জানুয়ারিতে যেটা ভাবছ, দেখবে ডিসেম্বরে সেই একই ভাবনা অন্য ভাবে ভাবছ। তোমাকে একটা উদাহরণ দিই। আমি বেহালাতে বলতে পারো একটা প্যালেসে থাকি। অত বড় বাড়ি আমাদের, যদিও আমার কোনও কনট্রিবিউশন নেই, পুরো কৃতিত্বটাই আমার বাবা-কাকা-জেঠুদের। কিন্তু আজকে আমি বেহালা ছেড়ে অন্য কোথাও থাকতে চাই।

কী বলছেন?

সৌরভ: হ্যাঁ, গত বছর আমার বাবা মারা যান...

সেই স্মৃতিগুলো থেকে বেরোবার জন্যই কি বেহালার বাড়ি ছাড়তে চান?

সৌরভ: না, সেই রকম কিছু না। আমি শহরের আরও কাছে থাকতে চাই। এয়ারপোর্টের কাছে থাকতে চাই। এয়ারপোর্ট থেকে বেহালা যাওয়া মানে আর একটা ফ্লাইট। ট্র্যাফিকের যা অবস্থা। মা এখনও ওই বাড়ি ছেড়ে যেতে চান না। কিন্তু আমি মাকে নিয়েই শিফ্ট করব। মা, মাই ওয়াইফ, মাই ডটার। তা এই মানসিকতা তো আমার আগে ছিল না। আজকে হয়েছে। আমি সবাইকে বলেছি, আমার একটা কুড়ি-বাইশ কাঠা জমি দরকার যেখানে নিজের একটা বাড়ি বানাব। আগে তো জমির দামও কম ছিল। কিন্তু তখন আমি ভাবিনি। বললাম না, ভাবনাগুলো চেঞ্জ হতে থাকে ধীরে ধীরে। তখন জমির দাম ছিল দু’লাখ টাকা কাঠা।

আজকে আশি লাখ টাকা কাঠা।

সৌরভ: আশি লাখ... কী বলছেন... দেড় থেকে দু’কোটি টাকা কাঠা... তাই না বুম্বাদা? আর আজকে আমি বেহালা থেকে বেরিয়ে নিজের বাড়ি করতে চাইছি কিন্তু দশ বছর পর মেয়ে বড় হবে, মেয়ের বিয়ে হবে। তখন হয়তো আমার মনে হবে মেয়ের শ্বশুরবাড়ির পাশেই আমি থাকব। তাই চিন্তাগুলো বদলে বদলে যায়।

প্রসেনজিত্‌: আরেকটা ব্যাপার কী হয়, জানো সৌরভ? বয়স বাড়লে একই সিচ্যুয়েশনের সঙ্গে রিঅ্যাকশনগুলো বদলে যায়। আগে ছবি হিট হলে আমি খুব খুশি হতাম। আজ ছবি সুপারহিট হলে বাড়ি ফিরে আলো নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। বুঝতে পারি দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেল, আরও ভাল কাজ করতে হবে।

সৌরভেরও কি তাই হয়?

সৌরভ: হ্যাঁ, দায়িত্ব তো বাড়তেই থাকে। আসলে জীবনটা অদ্ভুত। ধরো আমি ডিসেম্বরে একটা সেঞ্চুরি করলাম, তার মানে কিন্তু এই নয় যে, ডিসেম্বরে ভাল খেলেছি বলেই সেঞ্চুরিটা পেলাম। ওই সেঞ্চুরিটা জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পরিশ্রমের ফল। তোমার প্র্যাকটিস, তোমার ট্রেনিং সবের রেজাল্ট হল এই সেঞ্চুরিটা। তাই দেখবে যারা রিয়েল অ্যাচিভার, তারা একটা স্টেজের পর জিতলেও উচ্ছ্বাসে গা ভাসায় না। ফেলিওরেও ভেঙে পড়ে না।

বুঝলাম।

সৌরভ: বুম্বাদা পাশে বসে আছে। একটা কথা বলি, আমি যখন খেলতাম তখন কিন্তু কন্টিনিউয়াসলি মনে মনে ভাবতাম আমি মাঠে কী ফেস করব?

কী দেখতেন আপনি?

সৌরভ: ধরুন, সামনের ডিসেম্বরে আমার অস্ট্রেলিয়া সফর। আমি কিন্তু বছরের শুরু থেকে দেখতে শুরু করতাম আমাকে ওয়াসিম আক্রম কী গ্লেন ম্যাকগ্রা কী ওয়ার্ন বল করছে। প্রচুর বাউন্সার, প্রচুর শর্ট বল ফেস করছি, কিন্তু রানও পাচ্ছি।

এই ফ্রেম অব মাইন্ডটা যদি না থাকে, যদি তুমি মনে মনে জেতার দৃশ্যগুলো না দেখো তা হলে কিন্তু তুমি সফল হবে না।

যদি ধরেই নাও আক্রম-ওয়ার্ন তোমাকে আউট করছে, তা হলে ধরেই নিতে পারো ওদের দু’টো বল খেলার পরই তুমি গ্যারান্টেড আউট হয়ে যাবে।

তোমাকে নিজের মনের ভয়গুলোকে পজিটিভ ভাবনা দিয়ে বদলে ফেলতে হবে। এই পুরো চিন্তাটা, মনে মনে এই দেখাটা যেন তোমার সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে যায়। তা হলে সাফল্য আসবেই।

আচ্ছা ‘লড়াই’য়ের পরিচালক পরমব্রত-র একটা প্রশ্ন ছিল। আপনাদের নিজেদের মনের ভিতরও তো অনেক আশঙ্কা, অনেক ভয়-ভীতি থাকে। এই ইনার ডেমনস্‌গুলো কী ভাবে কাটান আপনারা?

প্রসেনজিত্‌: আমি কাটাতে পেরেছি শুধু নিজেকে বলে যে, আমি সিনেমাটা ভালবাসি, কাজটা অনেস্টলি করি। সাফল্য আসবেই। কোনও দিনই শ্যুটিং ফ্লোরে ফাঁকি দিইনি। ভগবান আমাকে ঠিক সাফল্য দেবে।

দাদা, কখনও মনে হয়েছে আপনার, এই সিরিজটা বোধহয় গেল, মনে হচ্ছে রান পাব না?

সৌরভ: মনে আবার হয়নি! বহু বার হয়েছে। প্রথম বার অস্ট্রেলিয়া গিয়ে ব্রিসবেনে প্র্যাকটিস করতে নেমেছি। বলের বাউন্স দেখে বুঝেছিলাম, এটা লম্বা ট্যুর হতে চলেছে...

পরে সেই ব্রিসবেনে সেঞ্চুরিও তো করলেন।

সৌরভ: হ্যাঁ ঠিক। আর একবার হয়েছিল যখন আমি ইন্ডিয়া ক্যাপ্টেন। ২০০২-এর ইংল্যান্ড সিরিজ। তখন সানা ছোট। লর্ডসে প্রথম ইনিংসে ফ্লিনটফকে উইকেট দিয়েছি। পরের ইনিংসে হগার্ডকে। সে বার আমরা সেন্ট জেমস কোর্ট হোটেলে উঠেছিলাম। আমার পুরো ফ্যামিলি ছিল আমার সঙ্গে। বিশ্বাস করবে না বুম্বাদা, দু’রাত ঘুমোতে পারিনি। খালি মনে হচ্ছে, পরের টেস্ট নটিংহ্যামে আমি একটা রানও পাব না। দু’রাত এ ভাবে কেটেছে। তৃতীয় দিন সকালে হাঁটতে হাঁটতে লর্ডসের নেটে গেলাম। দু’জন নেট বোলারকে ডাকলাম। বললাম, তোরা আমাকে শুধু বাউন্সার দে। আমি যদি ওই পরীক্ষাটা না দিতাম, তা হলে সেই ভয়টা ওভারকামই করতে পারতাম না। ভয় তো থাকবেই। তোমাকে তার সামনাসামনি দাঁড়িয়ে মোকাবিলা করতে হবে।

প্রসেনজিত্‌: খুব ভাল বললে এটা তুমি। মনে ভয় জমতে দিলেই তুমি শেষ।

আর এই রিয়েলাইজেশনটা হঠাত্‌ করে হয়। একদিন সকালে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখবে আয়নার মানুষটা তোমাকে বলছে, কী রে এত ভয় পাচ্ছিস কেন? যা মাঠে নাম। এত ভয় কীসের তোর? ওই আয়নার মানুষটার কথা বলাটাই যে কোনও মানুষের জীবনের টার্নিং পয়েন্ট হয়। এবং নিজের কাজের প্রতি সত্‌ থাকলে আয়নার মানুষটা একদিন না একদিন কথা বলবেই।

আচ্ছা দাদা, আইএসএল জেতার পর শাহরুখ খান কি মেসেজ করেছিলেন আপনাকে?

সৌরভ: না, শাহরুখের মেসেজ আসেনি। কিন্তু কেকেআর জিতলে আমি করি... মেসেজ করে ওকে কনগ্র্যাচুলেট করি।

আর অ্যাটলেটিকো-র কোচ হাবাসের সঙ্গে কোথাও কি গ্রেগ চ্যাপেলের মিল পান?

সৌরভ: (হেসে) না মিল নেই। গ্রেগ চ্যাপেল ইজ ডিফারেন্ট। হাবাস ইজ ডিফারেন্ট।

কিন্তু হাবাস তো ফিকরু-গার্সিয়াকে টিমে না নিয়ে অনায়াসে ফাইনাল ম্যাচে টিম নামিয়ে দিতে পারেন...

সৌরভ: ওটা তো হতেই থাকে খেলায়। একটা ম্যাচে যদি মনে হয় কোনও প্লেয়ারকে আমার দরকার নেই তাকে কোচ বাদ দিতেই পারে। কিন্তু পরের ম্যাচে যদি তাকে দরকার হয়, তখন তাকে না নিলে সেটা ভুল। কোনও প্লেয়ারকে নিয়ে মেন্টাল ব্লক কোনও কোচের থাকা উচিত নয়।

থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ, আপনাদের দু’জনকেই।

সৌরভ: থ্যাঙ্ক ইউ বুম্বাদা। বেস্ট অব লাক ফর ‘লড়াই’...

প্রসেনজিত্‌ তো ‘লড়াই’য়ে ফুটবল কোচ...

সৌরভ: হ্যাঁ, জানি। বুম্বাদা দারুণ কোচ হবে।

প্রসেনজিত্‌: হা হা হা হা।

ছবি: কৌশিক সরকার;
লোকেশন সৌজন্য: পার্পল মুভিটাউন

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy