Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
গত সংখ্যার পর

ঋতুর যন্ত্রণা ছিল পুরুষের শরীরে নারীর মন

আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে মারা যান ঋতুপর্ণ ঘোষ। তাঁর স্মৃতি মন্থনে ভ্রাতৃবধূ দীপান্বিতা ঘোষ মুখোপাধ্যায়।আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে মারা যান ঋতুপর্ণ ঘোষ। তাঁর স্মৃতি মন্থনে ভ্রাতৃবধূ দীপান্বিতা ঘোষ মুখোপাধ্যায়।

শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০১৪ ১৯:৪৩
Share: Save:

শুরুতে ‘আর একটি প্রেমের গল্প’য় শিল্প নির্দেশনার কাজটা আমার স্বামী চিঙ্কুরই (ইন্দ্রনীল ঘোষ) করার কথা ছিল। শেষ পর্যন্ত আগে থেকে বলে রাখা একটা ছবির সঙ্গে ডেট ক্ল্যাশ করায় করে উঠতে পারেনি। দু’জনেই যেন কোথায় নিশ্চিন্ত হয়েছিল। চিংকুু তো ঠিক ওর বাবার মতো। ওর খুব ভাল লাগবে না। এক দিকে ভালই হয়েছে। তুই আসবি? ‘হিরের আংটি’র পর এই প্রথম ঋতু আমাকে কোনও শ্যুটিংয়ে আসতে বলেছিল। আমি যাইনি। সময়ের যে কোনও বিন্দুতে দাঁড়িয়ে যা করি, অনন্তে তার পরিপ্রেক্ষিতে একটা করে দাগ পড়ে। এমনি করে সারা জীবনের মূল্যায়ন আবর্তিত হতে থাকে নিজের কাছে। না যাওয়াটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল, এমনটা নয়। তবে কি না স্বতঃপ্রণোদিত হয়েও যাইনি তো! আমি আর ঋতু অবশ্য ওর বেয়াল্লিশ ইঞ্চি স্ক্রিনে একসঙ্গে বসে ছবিটা দেখেছিলাম। ছোট ঘরটায় মাথা কুটে মরেছিল ‘পর জনমে রাধা’ হওয়ার অভিশাপ সেই পুরুষদের উদ্দেশে যারা নির্দ্বিধায় ভালবাসাহীন প্রেমের দিন কাটিয়েছে ওর সঙ্গে।

চিংকু, মানে আমার স্বামীর সঙ্গে ওর সম্পর্কটা ঠিক সাধারণ দাদা বা ভাইয়ের মতো ছিল না। খুব ছোট থেকেই ও অনেক নিষিদ্ধ কথা ইন্দ্রাণী পার্কের লাল গোলবারান্দায় বসে চুপি চুপি চিংকুকে বলত, যা ছেলেদের বললে চার অক্ষরের শব্দ শুনবে, আর মেয়েদের বললে হাসির কলরোল। দু’জনেই দু’জনের ভয়াবহ রকমের সমালোচক ছিল। বাইরে থেকে দেখলে বেশির ভাগ লোকই ভুল বুঝবে এবং বুঝতও। ঋতুর মনে হয়েছিল আমাদের বিয়েতে ও আলাদা করে দু’টো মানুষকে হারাল। এ কথার উত্তরে যাঁরা বলেন তা কেন? উল্টোটাও তো হতে পারত! তাঁদের জন্য আমার কাছে কোনও ব্যাখ্যা নেই। কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে আমি ঋতুর বেদনা বুঝতাম। আজও বুঝি।

২০১০-এর ফেব্রুয়ারিতে ‘আর একটি প্রেমের গল্প’ মুক্তি পায়। একটা বিশেষ অ্যাঙ্গেল থেকে সত্যি সত্যিই ওকে রেখার মতো দেখাচ্ছিল। ‘মিশন অ্যাকমপ্লিশড’ লিখে পাঠানোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ফোন বেজেছিল। আলেকজান্ডারের মতো বিজয়মুকুট পেয়েছিল ও। কেবল সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কারটাই ওকে ফাঁকি দিয়েছিল। তত দিনে কোনও কিছু না পাওয়ার অভ্যেসটা একেবারেই চলে গিয়েছে। অমন সুইপিং ভিকট্রি সত্ত্বেও অ্যাওয়ার্ড না পাওয়ার ক্ষোভটা কিন্তু রয়েই গেল। ২০১০-এর ২৯ জুলাই ঋতুর বাবা চলে গেল।

যা কিছু শুভ, যা কিছু সত্যি, যা কিছু সুন্দর সেই সব শিকড় একযোগে ছিন্ন হয়ে গেল ঋতুর। ‘আর একটি প্রেমের গল্প’-র জন্য লাইপোসাকশন করিয়ে এক অতি নিষ্ঠুর উপায়ে রোগা হয়েছিল। ডায়েট, যোগব্যায়াম বা নিয়মমাফিক জীবনচর্যা বড় লম্বা সময় নেয়। ওর চাই দু’মিনিটের ম্যাগি নুডলস। শুরু হল প্রতিমা গড়ার কাজ। ঋতুর ওপর সওয়ার সিন্দবাদের দৈত্য। ঈশ্বরদত্ত দেহকে মনের মতো করে তোলার জন্য বিচিত্র আর বেদনাদায়ক উপায় খুঁজে বের করল শল্য চিকিৎসা। সামনে শুধু পাখির চোখশ্রেষ্ঠ অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার। ছবির বিষয় একটাই। থার্ড জেন্ডার। তত দিনে আমাদের দীর্ঘ দিনের হাউস ফিজিশিয়ান ডা. সেনগুপ্ত বা পরিবারের বহু সংকটহরণ ডা. টি কে বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিকিৎসা ম্যাড়মেড়ে, অর্থহীন ঠেকেছে। জীবনটা তো ফিল্ম হয়ে গিয়েছে। সত্যি রং ঢাকবার জন্য একটু গ্লস চাই যে। কত বন্ধু ওর! কেউ ডাক্তার, কেউ ডায়েটিশিয়ান, কেউ বিউটিশিয়ান, কেউ শুধুই গুণমুগ্ধ। তারা ঋতুর কথা মতো ওকে সঙ্গ দেবে, পিৎজা খাওয়াবে, পুতুল নাচাবে, জাপটে ধরবে বা বাতাস করবে। ওদের পরিবার বাস্তবিক মিষ্টি। প্রত্যেকের রক্তে চিনি। তাই অপারেশন, স্টেরয়েড, সাইকিয়াট্রিক ড্রাগের বিচিত্র এবং ভয়াবহ মিশ্রণ ওকে দাঁড় করালো অতলগহ্বর এক খাদের কিনারায়। মতান্তর, মনান্তর, এক প্রকার দূরে সরে আসা ছাড়া আর তো কোনও রাস্তা রইল না। আমাদের না বলে বিশু (ওর পরিচারক) এবং ঠিক বিশেষণ ব্যবহার করলে ভাগ্যবান স্তাবকবৃন্দের মধ্যে থেকে কারওকে বেছে নিয়ে চলে যেত অপারেশন করাতে। অনেক সময় জানতেও পারতাম না। শেষ পর্যন্ত ‘চিত্রাঙ্গদা’র জন্য ২০১২-র শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার জিতেই নিল। ‘চিত্রাঙ্গদা’ দর্শক নেয়নি। তাই পুরস্কারও সে ভাবে আলোড়ন তোলেনি। একা, বিমর্ষ, হতোদ্যম, নতশির মনের ওপর আঘাত ভুলের ভারে জর্জরিত শরীরটা মেনে নিল না।

তার পর সেই ফেলে যাওয়া শরীর আর ইমেজের জন্য সমবেদনার হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছিল শুনেছিলাম। আমরা এক মাস কোনও কাগজ দেখিনি, টিভি চালাইনি। শুনেছি কেউ ওর ভাই ছিল, কেউ ওর বোন ছিল, কেউ ওর দিদি ছিল, কেউ ওর ব্যাসানিও, কেউ বা ওর আত্মার আত্মীয়। কোনও না কোনও আলোকোজ্জ্বল রাতে জীবনের হাতছানি অগ্রাহ্য করে কেউ ওর হতাশা কাটাতে সঙ্গ দিয়েছে। কেউ ইলিশ মাছ রান্না করে পাঠিয়েছে। তো কেউ টেস্টি ব্ল্যান্ড ডায়েট। কে যে আগে ইন্টারভিউ দেবে, কে বা ছবি তুলবে, কে কী ভাবে কাঁদবে, কী ভাবে হাসবে, এমনকী ওর বাড়িটা সর্বজনীন ফিল্মের হবে কিনা, তা নিয়েও চিন্তার অন্ত রাখেনি। মানুষটা তো আর শুধু এক জন অবিবাহিত পুরুষ ছিল, তা নয়। জিনসের সঙ্গে কালীঠাকুরে ভক্তি, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কোসোফস্কি, ন্যাড়া মাথা, চোখে কাজল, ঝোলা দুল, শারীরিক সম্পর্কের বাস্তব ধরনটা ঠিক কেমনতরো মিলেমিশে এক অপার প্রহেলিকা।

দু’চোখের ধারে দু’হাত চাপা দিয়ে আছি আমরা। অর্ধেকেরও বেশি সত্যি ঢাকা পড়ে আছে প্রচলিত ধারণার আড়ালে, ঢাকা পড়ে আছে মানবিকতা, ঢাকা পড়ে আছে বিজ্ঞান। ক্রোমোজোমের গঠনের ওপর আমাদের লিঙ্গ নির্ধারণ হয়। সেই ক্রোমোজোম যদি আর পাঁচ জনের থেকে আলাদা হয়, তাতে অন্যথাচরণ হতে পারে। বিকলন নয়। ক্রিস্টোফার মার্লোকে বোধহয় আমরা ভুলে গিয়েছি। ভুলে গিয়েছি শেক্সপিয়রের আঠেরো বা বাহান্নতম সনেট। ভুলে গিয়েছি অস্কার ওয়াইল্ডের কথা। মহাভারতে সমস্ত বিধবার কান্না ছাপিয়ে সবাইকে কাঁদিয়েছিল মোহিনী। সে ছিল স্বয়ং কৃষ্ণ, নারীবেশে মাত্র এক রাত্রির জন্য মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত ইরাবানের বিবাহিতা স্ত্রী। শুধুমাত্র শরীরী মানুষ তো পশুর নামান্তর। আসল মানুষ ঘুমিয়ে আছে চেতনায়। বুকের মধ্যে সে চেতনা যদি অবিরত ধাক্কা মেরে জানান দেয় আমি পুরুষদেহী, তাতে কী? আমি একজন পুরুষকেই আমার প্রেমিক পেতে চাই তা হলে বুঝি আমি অচ্ছ্যুৎ?

যাঁরা ঋতুকে ভালবেসেছেন তাঁদের অনুরোধ, বড় ঝুলপাঞ্জাবি, দোলানো হাতে কথা বা এক আঙুলে নেলপলিশ পরা ছেলে দেখলে হাসবেন না। ‘লেডিস’ বলবেন না।

আজন্ম পুরুষ শরীরে নারীর মন, নারীর কামনা বাসনা বয়ে চলার অবহ বেদনা নিয়ে ঋতু চলে গিয়েছে। থার্ড জেন্ডার যাঁরা তাঁদের জন্য ঋতুর একান্ত এবং সব কাছের লোকেদের তরফ থেকে আন্তরিক বার্তা রইল ওঁর প্রিয় গানে ‘নিবিড় ঘন আঁধারে জ্বলিছে ধ্রুবতারা/ মন রে মোর পাথারে হোস নে দিশাহারা...’।

(শেষ)

অন্য বিষয়গুলি:

rituparno ghosh dipanwita ghosh mukhopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy