ছবি: সুমন বল্লভ
আমরা চমকপ্রদ কিছু শুনলেই বিস্ময়ে বলতে থাকি, যাহ্, কী বলছ তুমি, এ রকম আবার হয় না কি! তুমি বাজে কথা বলছ, না কি সত্যি! আসলে, এটাই আমাদের মনের কথা প্রকাশের ধরন। বাঙালি বড় আবেগপ্রবণ তো! পাশাপাশি ইংরেজদের দেখুন, ঠোঁট টিপে কথা বলে, বিস্ময়কর কিছু শুনলে বড়জোর বলবে:‘ও রিয়েলি!’ এক-একটা জাতির এক-একটা ধরন। বাঙালির যেমন অতি-আবেগের ধরন, তার প্রকাশভঙ্গিকে তাই অতিনাটকীয় মনে হতেই পারে। এটাই বাঙালির ধর্ম, আবার অধর্মও বটে। বা একটু ঘুরিয়ে বলতে পারেন এটাই বাঙালির স্বভাব, একই সঙ্গে বদ স্বভাবও।
প্রথমে ধর্ম বা স্বভাবের কথাটাই বলি। মনে আছে, আমাদের শ্যামবাজারের বাড়িটায় ওপরের দুটো ঘরে আমরা সাত-আট ভাইবোন ভাগাভাগি করে থাকতাম। আগে চারটে ঘর ছিল, তো বড়দা হঠাৎ উদারচরিত হয়ে তাঁর সহকর্মীকে থাকার জন্য গোটা দুয়েক ঘর দিয়ে দিলেন, আমাদের কিছু না জানিয়েই। প্রায় একটা ঘরেই আমাদের থাকতে হত। কেউ খাটের ওপর, কেউ নীচে, কেউ বা বারান্দায়। সেজদা আবার প্রতিবাদী বামপন্থী ছিলেন, তিনি তাঁর কমরেডদের মাঝে মাঝেই নিয়ে এসে ঠাঁই করে দিতেন ওই বারান্দাটায়। এক দিন রাত দুটোর সময় ওইটুকু বারান্দায় শুয়ে আছি, হঠাৎ টের পেলাম আমার পায়ের ওপর একটা ভারী পা এসে পড়ল। ঘুম ভেঙে যেতে দেখি ট্রাম কোম্পানির এক কন্ডাক্টর— সেজদার কমরেড। সেজদার শ্যালকরাও এসে এখানে পড়াশোনা করত, তখন ছাদে চলে যেতাম শুতে। ভারী মজা লাগত, এক দিন হয়তো তুমুল বৃষ্টি, গায়ের ওপর তেরপল খাটিয়ে শুয়েছি, জল চুঁইয়ে শরীর ভিজিয়ে দিচ্ছে, বাধ্যত সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে এসে শুলাম।
কিন্তু কোনও দিন খারাপ লাগেনি, কোনও দিন আমরা কেউ কাউকে বলিনি— কেন এ সব, বা কেন আমাদের এ ভাবে থাকতে হবে। আসলে বাঙালি এ রকমই। এই যে আশ্রয় দেওয়া অপরকে, আবাহন করে নেওয়া, এটা বাঙালির ধর্ম। এটাকে অতি-আবেগ বলে মনে হতে পারে, বাড়াবাড়ি বা অতিনাটকীয়ও মনে হতে পারে, কিন্তু বাঙালির মধ্যে এ স্বভাবটা ভীষণ ভাবেই আছে। যেটা কষ্টকর, সেটাকে সে দামি বা নাটকীয় করে তুলবেই নিজের কাছে। অসম্ভব কষ্ট করে জীবন যাপন করতে ভালবাসি আমরা, যেন এটা আমাদের একটা দায়, এই কৃচ্ছ্রসাধন, সকলকে এই জায়গা ছেড়ে দেওয়া। পশ্চিমবঙ্গে আমার তো মনে হয় এখন পঞ্চাশ ভাগ বাঙালির বাস, বাকি পুরোটাই ভারতের অন্যান্য ভাষার সম্প্রদায়। এটা যদি মহারাষ্ট্র বা গুজরাত হত, তা হলে কী ঘটত আপনারা সবাই জানেন, কিন্তু সে সব বাঙালির কাছে অতীব বাজে ঘৃণ্য ব্যাপার।
এই যে উদার হওয়ার মানসিকতা, প্রলোভনও বলতে পারেন, এটা আমাদের সংস্কৃতির ভিতরেই আছে। বাংলা যখন দু’ভাগ হয়ে গেল, স্বাধীনতার পর যখন পশ্চিমবঙ্গ হল, তাতে জায়গা কত কমে গেল, অথচ পূর্ববঙ্গ থেকে কত মানুষ এখানে চলে এল। সাধ্য সীমিত হয়ে গেল বলে কি এক বাঙালি আর এক বাঙালিকে ঠাঁই দেয়নি? নাটকীয়তার শুরু তো এখান থেকেই। শুধু বাঙালি কেন, বাংলার বাইরে আমার নাটকের বন্ধুবান্ধব থেকে বিদেশের ইন্ডোলজিস্ট পর্যন্ত কলকাতায় এসে আমার বাড়িতে থেকেছেন, উদাহরণ হিসেবে বলছি। বন্ধুকে জায়গা দিতে, পরকে আপন করে নিতে আমার কষ্ট হচ্ছে, বাস্তবিকই কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু সে কষ্টটাকে কষ্ট হিসেবে না দেখে সেটাকে অনেক বড় করে দেখছি, সেই কষ্টটায় মহত্ত্ব আরোপ করছি। কোনও কিছুতেই বিরক্ত হচ্ছি না, মনকে বড় করে রাখছি, এ ভাবে নিজেকে নিজের থেকে ছাপিয়ে নিয়ে যেতে প্রয়োজন হয়ে পড়ে অতি-আবেগের, অতিনাটকীয়তার।
আমার বিদেশি বন্ধুবান্ধবরা প্রায়ই আমাকে বলেন যে আমরা কোনও প্রশ্নের সোজা উত্তর দিই না। এক বার এক ইংরেজ আমায় বললেন: ‘তোমরা প্রশ্নের উত্তরে অনেক সময় পালটা প্রশ্ন করো। ধরো, তোমায় শুধোলাম, কেমন আছ? তুমি উত্তর না দিয়ে আমায় শুধোলে— তুমি কেমন আছ?’ সেই কথাটা নিয়ে ভাবলাম ক’দিন, তার পর আবিষ্কার করলাম যে এর ভিতরে একটা প্রবল বিনয় আছে। আমি কেমন আছি, এটা বড় কথা নয়, আমি এখানে গুরুত্বপূর্ণ নই, তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে তুমি কেমন আছ। এই যে নিজেকে প্রচ্ছন্ন করে ফেলা, পাত্তা না দেওয়া, এই humility বা the quality of being humble— এটা বাঙালির স্বভাব বা ধর্ম। এর মধ্যে যতই আবেগের অতিরেক কিংবা অতিনাটকীয়তা থাক, আমি এর মধ্যে বাঙালির মহান সংস্কৃতির শিকড় খুঁজে পাই।
এ বারে এই আবেগ বা অতিনাটকীয়তা যখন আর গুণ থাকে না, দোষ হয়ে যায়, তখন বাঙালির অধর্ম বা বদ স্বভাবের দিকটার কথা একটু বলি। রাজনীতিকরা আমায় মার্জনা করবেন, এটা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় রাজনীতি চর্চাকারীদের মধ্যেই। আমাদের বেদনা বা বিদ্রোহ ফোটাতে তাঁরা এত বেশি কথা বলেন... আর শুধু তো বেশি কথা নয়, হাত-পা নেড়ে কথা বলেন। দেখলেই মনে হয় যেন বাঙালি এক সদা-উত্তেজিত সম্প্রদায়। সহজ কথাগুলোকে গভীর ভাবে না বলে এত চেঁচাতে থাকেন তাঁরা, যে দরিদ্র নিপীড়িত শোষিতদের জন্য চেঁচান, তারাই বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে দেখেছি অতিনাটুকে ভঙ্গিতে এত বেশি কথা বলছেন বক্তারা, শ্রোতারা অধৈর্য, উসখুস করছেন, কখন বাড়ি ফিরবেন বা ফিরে গিয়ে সংসার সামলাবেন তা নিয়ে। সাধারণ মানুষ রাজনীতিকদের কথা মিটিংয়ে দাঁড়িয়ে শোনেন কেন, নিশ্চয়ই ফলের আশায়। অতএব ফল নিয়ে কথা বললেই তো হয়, অথচ রাজনীতিকরা ফলের কথায় অনেক পরে আসেন, গোটা গাছটার কথাই বলে চলেন, গাছের ফুল-পাতা-শিকড়-পোকামাকড় ইত্যাদি। আর এমন ভাবে বলতে থাকেন, বলা ভাল চেঁচাতে থাকেন, মনে হয় যেন আমাদের মাথায় মগজ বা বুদ্ধি বলে কিছু নেই। বাঙালি রাজনীতিকদের নিজেদের এই বাড়িয়ে দেখা আর বাকি বাঙালিকে খাটো করে দেখার মধ্যে অতিনাটকীয়তার বদ স্বভাবটাই ধরা পড়ে।
আর এই অতিনাটকীয়তা থেকে বাঙালির রাজনীতিতে একটা বিশ্রী ফাটাফাটি চিৎকার চেঁচামেচির আমদানি হয়েছে। কেউই আর এখন শান্ত স্থিতধী হয়ে নিজের মতটা পেশ করেন না, অপরকে খুব খারাপ ভাষায় আক্রমণ করাটাই যেন দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনও দল যেন অন্য কোনও দলকে সহ্য করতে পারছে না এখন... ঘর জ্বালিয়ে দেব, গর্তে পুরে দেব— এ ধরনের ভাষা ব্যবহার হয়ে চলেছে ক্রমাগত। দুর্ভাগ্যজনক! বাঙালি ভুলে গেছে ভারতবর্ষ গাঁধীজি, রবীন্দ্রনাথের দেশ, সমাজকল্যাণের রাজনীতিতে হিংস্র অতিনাটুকেপনা চলে না।
এই অতিনাটুকেপনার জেরে polemics বা রাজনৈতিক তর্কও ভুলতে বসেছে বাঙালি। নরেন্দ্র মোদীকে কেবল অতিনাটুকে তিরস্কার করে ‘ভিলেন’ বানানোর চেষ্টা করে চলেছে বাম-ডান সব বাঙালি দলগুলিই। কিন্তু মোদীর উন্নয়নের গপ্পোটাকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার জন্য তো অজস্র তথ্য মজুত... গুজরাতে মেয়েদের রক্তাল্পতার হার সবচেয়ে বেশি, শিশুশ্রমের হারও খুব বেশি। যিনি নিজের রাজ্যের মেয়েদের-শিশুদের উন্নয়নের দায়িত্ব নিতে পারেন না, তিনি দেশের দায়িত্ব নেবেন কী করে? আবেগপ্রবণ হয়ে মোদীকে শুধু ‘হিন্দুত্ববাদী’ বলে গাল না পেড়ে বরং তথ্যগুলোয় ভর করে, যুক্তি দিয়ে তাঁকে রাজনৈতিক আক্রমণ করা উচিত।
সব শেষে আমাদের থিয়েটারের কথায় আসি। আবেগের আতিশয্য বা অতিনাটকীয়তা সত্ত্বেও বাংলা থিয়েটার রীতিমত স্বাবলম্বী। এখনকার থিয়েটার করছে যে নবীন প্রজন্ম, তাদের মধ্যে কয়েক জন বেশ বুদ্ধিমান, লেখাপড়া করে, তাদের কাছ থেকে চমৎকার নাট্যপ্রয়োগ পাচ্ছি কিছু কাল যাবৎ। আমাদের নান্দীকারেই তো রয়েছে দেবশংকর, পার্থ, সোহিনী। আর আছে সুমন, গৌতম, ব্রাত্য, কৌশিক, দেবেশ, বিপ্লব, মলয়, আশিস, মনীষা, এ রকম আরও কেউ কেউ, অনবধানতাবশত তাদের নাম বাদ পড়ে গেল। এদের মধ্যে যে আবেগ সময়ের স্পন্দনে স্পন্দিত হচ্ছে তা থেকে নিশ্চয়ই সুসৃষ্টিই হচ্ছে, তবু বলব এরা যদি সময়কে মেনেই সময়ের অতিরিক্ততে পৌঁছত, তা হলে আরও বেশি কিছু আমরা পেতাম, এদের সে ক্ষমতা ছিল। সমসাময়িকতার আবর্ত থেকে বেরিয়ে এদের আরও বড় জায়গায় পৌঁছনো দরকার, না হলে এদের ভিতরের আবেগকে আমাদের অতিনাটকীয়তা বলে ভ্রম হবে। এরা চাইলেই পারে সাম্প্রতিকতা থেকে আধুনিকতায় পৌঁছতে। এটা আসলে আধেয়-আধারের সম্পর্ক, কী বলতে চাই আর তা বলার জন্য কী হবে প্রকাশভঙ্গি— এ দুয়ের সম্পর্ক।
তবে ঠিকই আছে, বাঙালি আবেগ, অতিনাটকীয়তা নিয়েই বাঁচুক। ‘স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ, পরধর্মো ভয়াবহঃ।’ তবু সে বাঁচার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের গানটা যেন আমাদের জীবনচর্যায় নিয়ে আসতে পারি: ‘অনেক কথা যাও যে বলে কোনো কথা না বলি।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy