দেওয়াল-ও-ওয়াল: প্রচারে রঙ্গরসিকতা।
দেওয়ালে দেওয়ালে উছলে পড়ছে বাঙালির রসবোধ। নেতানেত্রীদের পারস্পরিক আক্রমণ, কটূক্তি, বিষোদ্গারের বদলে মজাদার বুদ্ধিদীপ্ত কার্টুন এবং ছড়া নজর কাড়ছে ভোটারদের।
‘নেতা কিনতে লাগছে টাকা/ তেল কিনতে পকেট ফাঁকা/ মানুষ এ বার জবাব দেবে/ বন্ধু এ বার খেলা হবে’— হাবড়া বিধানসভার বহু দেওয়ালে ছড়া লিখে বিজেপির বিরুদ্ধে প্রচার করেছে তৃণমূল। পিছিয়ে নেই বিজেপি ও বামেরাও। তীর্যক বাণে একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়াই চলছে। যা নেতাদের মুখের ভাষার থেকে অনেক সুললিত এবং মার্জিত— এমনটাই মত ভোটারদের বড় অংশের। মূলত দলের তরুণ প্রজন্মই এই দায়িত্ব নিচ্ছে বলে জানা গেল।
গাইঘাটায় বিজেপি লিখেছে, ‘লুট হয়েছে কোটি কোটি/ কে নিয়েছে?/ হাওয়াই চটি।’ কোথাও লেখা হয়েছে, ‘দিদির পায়ে হাওয়াই চটি/ ভায়েরা সব কোটিপতি।’ বনগাঁয় সিপিএমের পক্ষ থেকে লেখা হয়েছে, ‘দেশটাকে যারা ডোবাতে বসেছে/ বাংলা গড়বে তারা? / করোনাকালে বাংলা দেখেছে/ মানুষের সাথী কারা।’ তৃণমূল লিখেছে, ‘রান্না ঘরে গ্যাসের দামে/ সবার পাচ্ছে কান্না/ তাই তো জনগণ বলছে/ এই বিজেপি আর না।’
বঙ্গের ভোট প্রচারে ছড়ার ব্যবহার নতুন নয়। তবে গত কয়েকটি ভোটে ছড়া, কার্টুনের ব্যবহার কমে গিয়েছিল। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে ফিরেছিল ছড়া। এ বার বিধানসভা ভোটে ডান-বাম সব রাজনৈতিক দলগুলিকেই দেখা যাচ্ছে, দেওয়াল লিখন ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ার মাধ্যমে প্রচার শুরু করেছেন জোর কদমে। সোশ্যাল মিডিয়ায় চটকদার মিমের ব্যবহার হচ্ছে। সেখানে রুচিবোধের ছাপ দেখে স্বস্তি পাচ্ছেন তরুণ ভোটারেরা। প্রবীণ মানুষেরা স্মৃতি হাতড়ে জানালেন, ১৯৭৭ সালের ভোটে কংগ্রেসের ভরাডুবি হয়। ইন্দিরা গাঁধী নিজেও ভোটে হেরে গিয়েছিলেন। তিনি কংগ্রেস (আই) তৈরি করেন। সেই দলের প্রতীক হয়েছিল হাত। পরবর্তী সময়ে হাত প্রতীককে কটাক্ষ করে বামেদের তৈরি ছড়া বিখ্যাত হয়ে রয়েছে। লেখা হয়েছিল, ‘ঝোঁকের মাথায় নিলি হাত/ ভোটে হবি কুপোকাত।’ ১৯৬৭ সালে কংগ্রেস ও সিপিআইয়ের মধ্যে জোট হয়েছিল। সিপিএম লিখেছিল, ‘দিল্লি থেকে এলো গাই/ সঙ্গে বাছুর সিপিআই।’ ভোট রাজনীতিতে ছড়ার এমন ব্যবহার ভুরি ভুরি। রাজনৈতিক দলগুলি মানছে, ছড়ার মাধ্যমে খুব সহজে মানুষের মধ্যে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরা যায়। ভাল ছড়া হলে মানুষের মুখে মুখে তা ঘোরে। ভারী ভারী শব্দের বদলে ছড়ার মাধ্যমে সহজে মানুষের মন ছুঁয়ে যাওয়া যায়। সঙ্গে কার্টুন বা ক্যারিকেচার থাকলে আরও ভাল।
বিজেপির বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি মনস্পতি দেব বলেন, ‘‘অমুক প্রতীকে ভোট দিন— এমন দেওয়াল লিখন এখন আর মানুষকে আকৃষ্ট করে না। ছড়ার মাধ্যমে দলীয় স্লোগান লেখা হলে মানুষ তা দাঁড়িয়ে পড়েন। ভাল লাগলে আলোচনা করেন। সে কারণেই এ বার দেওয়াল লিখন ও সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা ছড়ার ব্যবহার করছি।’’ উত্তর ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূলের কো-অর্ডিনেটর গোপাল শেঠ বলেন, ‘‘ছড়ার মাধ্যমে বিজেপি-সহ বিরোধী দলগুলির বিরুদ্ধে প্রচার আরও বেশি করে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজেকে চৌকিদার বলছেন এমন কথা অতীতে কেউ শোনেননি। বাস্তবে তিনি দেশের ধনসম্পদ রক্ষা করতে পারেননি। তাই চৌকিদার শব্দ নিয়ে ছড়া লিখলে মানুষের মধ্যে বেশি প্রভাব ফেলা যাচ্ছে। বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতির ঐতিহ্যও ধরে রাখা যাচ্ছে।’’ ছড়া নিয়ে কী বলছে সিপিএম? দলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা কমিটির সদস্য সত্যসেবী কর বলেন, ‘‘ভোটের প্রচারে ছড়ার ব্যবহার বামপন্থীরা দীর্ঘ দিন ধরেই করে আসছে। এর মাধ্যমে দলীয় বক্তব্য মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় করা যায়। এবার বামপন্থী ছাত্র-যুবরা আরও বেশি করে ছড়ার ব্যবহার করছেন। যা মানুষকে আকৃষ্ট করছে।’’
ভোটে ছড়া ব্যবহার সুস্থ সংস্কৃতির লক্ষণ বলেই মনে করছেন কবি-সাহিত্যেকেরা। কবি বিভাস রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘ভোটে ছড়ার ব্যবহার এ রাজ্যে বেশ প্রচলিত। ছড়া মানুষের মধ্যে দ্রুত প্রভাব ফেলে। ভোট নিয়ে কুকথা, নোংরামির মধ্যে এটা একটা সুস্থ সংস্কৃতি দেখা যাচ্ছে।’’
ভোটে ছড়া ব্যবহার সুস্থ সংস্কৃতির লক্ষণ বলেই মনে করছেন কবি-সাহিত্যেকেরা। কবি বিভাস রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘ভোটে ছড়ার ব্যবহার এ রাজ্যে বেশ প্রচলিত। ছড়া মানুষের মধ্যে দ্রুত প্রভাব ফেলে। ভোট নিয়ে কুকথা, নোংরামির মধ্যে এটা একটা সুস্থ সংস্কৃতি দেখা যাচ্ছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy