Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
গ্রাম দর্শন
Khowai

‘হয় বদলাতে হবে, নয় চুপ যেতে হবে!’

লাভপুরের পথে দেওয়ালে এসএফআই— ‘রবীন্দ্রনাথের মাটিতে বিজেপির ঠাঁই নেই’।

নাক দিয়ে বাঁশি বাজান শান্তি বাগদি। কঙ্কালীতলায়। নিজস্ব চিত্র

নাক দিয়ে বাঁশি বাজান শান্তি বাগদি। কঙ্কালীতলায়। নিজস্ব চিত্র

সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
লাভপুর শেষ আপডেট: ০৫ মার্চ ২০২১ ০৭:১৫
Share: Save:

ভাতের হাঁড়িতে রাজনীতি থাকে। ঘ্রাণও থাকে। কিন্তু রাজনীতির আরশিতে কতটুকুই বা ধরা পড়ে সেই ঘ্রাণ, জীবনের আস্বাদ

খোয়াই-ঘেঁষা আদিবাসী গ্রাম। হাটে নিভন্ত ভিড়। পসরা গুছিয়ে ফেরার পালা। কেউ কেউ হ্যারিকেন জ্বেলেছেন। আচমকা ঝাঁকে ঝাঁকে আলোকসন্ধানী পতঙ্গ। অদূরের হোটেলের আলো নিভল। টিকটিকিদের বনভোজন শুরু। অস্থির লালমাটির কুকুরও। লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে পোকা খাওয়ার ধুম। হার-দুল-চুড়ি গোছাতে গোছাতে চুমকিবিবির চিন্তা— ‘‘শুনছি, হাট উঠিয়ে দেবে?’’ সাদ্দাম মোল্লা নিশ্চিত, ‘‘তৃণমূলেরই চান্স আছে।’’

রাজনীতি এখনও জমে ওঠেনি আদিবাসী গ্রামে। ‘‘ও সব বুঝি না’ লাস্যে কথা এড়ান বনেরপুকুর ডাঙার তরুণী, যিনি দুপুরে গোবরমাটি লেপছিলেন। পোকা-নিবিড় নর্দমার পাশে উবু হয়ে বসে রবিলাল কিস্কু। মধ্যবয়সি ভাগচাষি। তাঁকে বৃদ্ধ করেছে গরিবি। ‘পাঁচ ফুট ঘর তুলে ফেলে রেখেছে! ইন্ডিয়ার গ্রামে গ্রামে ঘর হল, আমাদের হল কই!’’ বিড়ি মাটিতে ঘষে ক্ষোভপ্রকাশ রবিলালের। স্কন্ধকাটা ঘরের সারি। কাদামাখা, শুয়োরচরা গ্রাম। দরমা-ঘেরা জায়গায় দিবানিদ্রায় এক জন। দাওয়ায় সোমনাথ দত্ত। কুটিরশিল্পী। এই জায়গাটায় টেলিসিরিয়ালের সেট হয়েছিল। তার পর থেকে ফাঁকাই। সেখানেই পসরা সোমনাথদের। হাওয়া কী? ‘‘অমিত শাহের রোড-শো’র পর পদ্ম মনে হচ্ছিল। তবে, হবে না! বীরভূম কৃষকদের ব্যাপার।’’ রূপপুরে ধান শুকোচ্ছিলেন বছর-পঁয়ত্রিশের শিবানী মান্ডি। কপালে ঘামের আলপনা মুছে তাকালেন। ঢুকলেন সুশীল লোহারও। বয়স ৬২। রাজমিস্ত্রীর ‘লেবার’। ‘হাওয়া বোলা যেছে না। সিপিএম করতাম। এখন তৃণমূল। চালডাল ঢের পাই!’’ পদ্ম এলে দল বদলাবেন? ‘‘হয় বদলাতে হবে, নয় চুপ যেতে হবে! সবাই তো জানে, আমরা দিদি করি!’’

‘হাওয়া’ উচ্চারণ করেছিলেন নামপ্রকাশে অরাজি আঠারো-উনিশ টোটোচালক। ‘শাস্তি’ গল্পের চন্দরা যেমন, ‘একখানি নূতন-তৈরি নৌকার মতো’। ‘‘বাবা চোলাই খেয়ে মরল! মা আছে। ভাই সাত ক্লাসে। আমি এই টোটো।’’ তিনি প্রেমেন্দ্র মিত্র পড়েছেন বলে মনে হয় না। কিন্তু ‘তরি ছেড়ে যদি তরু হও তবু/ঝোড়ো হাওয়া ডালে লাগবে’ পঙ্‌ক্তিটাই যেন বললেন— ‘‘হাওয়া খারাপ। তৃণমূলই করি। সরকার ভাল কাজই করেছে। কিন্তু সে-সব গ্রামে পৌঁছয়নি। নেতারা দল পাল্টাচ্ছে! লাভ নেই! মানুষের ঝাল ঠিক গায়ে লাগবে, সে যে-দলই করুক!’’

লাভপুরের পথে দেওয়ালে এসএফআই— ‘রবীন্দ্রনাথের মাটিতে বিজেপির ঠাঁই নেই’। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে সব দলেরই পতাকা। ফুল্লরা সতীপীঠের মাঠে মেলার তোড়জোড়। ভিক্ষুক, সাধু। গাছতলায় খঞ্জনি, কীর্তন। শালুতে গড়াগড়ি খাচ্ছে শ্রীখোল। গেরুয়াধারী একজন খঞ্জনিতে। অন্য জন প্রাতরাশের মুড়ি-তরকারিতে। তিনি চণ্ডী দাশ, খঞ্জনি মঙ্গল মুর্মু। আপনারা এখানকারই? খঞ্জনি বললেন, ‘‘পাশের গাঁয়ের। মন্দিরে মায়ের নিত্যপুজো, এখানে মায়ের নিত্যহরিনাম।’’ মুক্তাক্ষর খোলা খাতায়। চটিবই পড়ে শালুতে। মঙ্গল বললেন, ‘‘আমার বই। মায়ের গানই লিখি। রবীন্দ্রনাথ-তারাশঙ্করকে নিয়েও লিখেছি।’’ মঙ্গল ইলামবাজারের। ১৯৮০ সালে এখানে আসা। ‘‘হাঁসুলি বাঁকে একটা বাঁধি। আমার মতে বলছে গান। কবিতাও বলি মাঝেমধ্যে। ট্রাক চালাতাম। তারপর সব ছেড়ে এখানেই!’’ বউ-ছেলে-নাতি। জায়গা কিনে বাড়ি। ষোলো শতক জমিদান স্কুলের জন্য। ভোট দেন? ‘‘হ্যাঁ!’’ কাকে? ‘‘যারা জেতে, তাদের! ফুল্লরার দিব্যি, পদ্ম আসছে! দেখো, দত্তবাবু কোটিপতি হয়েও বিপিএল আর আমরা ভিখিরিরা এপিএল, এটা হয়? গুপ্তকথা বলি! আগে মন্দির থেকে ভোগ দিত, এখন বন্ধ! সাধুর জায়গায় সাধুরই খাবার নেই! জয়গুরু!’’ গুরুধ্বনি ছাপিয়ে তখন উপচে পড়ছে ‘দ্যান কিছু, ভাগ করে লিব’।

তারাশঙ্করের ভিটে। পনেরো বছর আগে সংস্কার। হেরিটেজ বাড়ির ছালচামড়া খসে মহেঞ্জোদাড়ো। হরপ্পা আঁকা কঙ্কালীতলার কঙ্কালসার শান্তি বাগদির সর্বাঙ্গেও। নাকে বাঁশি বাজান। রামপ্রসাদি সুরে ভাসে কোপাই। ‘‘সত্য বলি। মেলাতে এয়েচি। বাঁশি কিনে বলচি, মা, বাজাতে পারবনি? মা বাজায়ে দিল! নাকে! এখন মুখেও পারি!’’ বয়স? ‘‘৫০-৬০ হবে।’’ শান্তির স্ত্রীপুত্র, নিজবাড়ি। এবং ভোট দেন। কাকে দেবেন? অপাঙ্গে হেসে তুললেন সুর— ‘বল মা তারা, দাঁড়াই কোথা?’ বললেন, ‘‘মাকেই ভোট দিই! দিদিই আসবে, নিশ্চিত।’’ চাল পান? ‘‘মাসে হাজার টাকা পাই।’’ স্বাস্থ্যসাথী? ‘‘ওটা জানিনি।’’ স্থায়ী ভিখারিণী ভাদু হাজরার আক্ষেপ, ‘‘শান্তি তবু পায়! আমি পাইনি!’’ বৃদ্ধাও ভোট দেন। তাঁকে ‘নিয়ে যাওয়া’ হয়। কারা নিয়ে যান? ‘‘সে জানিনি।’’ পাঁচ বছর অন্তর ভিক্ষার্থী আর ভিক্ষাদাতার ছবিটা উল্টে যায় লহমায়!

ফেরার পথ। এতক্ষণ নীরব চালক বলে উঠলেন, ‘‘নাম লিখবেন না আমার। চারচাকায় ৩২ বছর কাটল। এ বারের মতো দেখিনি। যেই আসুক, গোলমাল হবে! যারা এ-দলে ছিল, তারাই তো ও-দলে যাচ্ছে! বামেদের সিদ্দিকির সঙ্গে হাত মেলানোটাও ভুল।’’ আপনার ভোট? ‘‘সিপিএমকেই দেব। তা সে যতই হারুক।’’

গাড়ি-জানলার বাইরে ‘চাষবাস হাটবাজার হাসিকান্না পৃথিবীর সমস্ত কাজ চলিতে লাগিল’।

অন্য বিষয়গুলি:

village Gram Darshan Khowai
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy