Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪

“আগে রুখেছি আবার রুখব”

সাত মাস আগে সল্টলেকের পুরভোটে ঋদ্ধ চৌধুরী মার খেয়েছিলেন। কিন্তু পিছু হটেননি। আবাসনের মেয়েরা-কাকিমারাও লাঠি-ঝাঁটা হাতে বাইরের গুন্ডাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। সল্টলেক এ বারও তৈরি হচ্ছে রুখে দাঁড়াবার জন্য।রুখে দাঁড়ালে গুন্ডারা যে পিছু হটে, সেটা সাত মাস আগে নিজের চোখে দেখেছিলাম। আবার দেখলাম শুক্রবারের আনন্দবাজারে। জামালপুরের মহিলারা যে ভাবে ভোট লুটেরাদের ঠেকিয়েছেন, সে কথা পড়ে গর্ব হচ্ছিল। তার চেয়েও বেশি আশ্বস্ত লাগছিল। বিধাননগরের পুরভোটে আমাদের ফাল্গুনী আবাসন যে রাস্তা দেখিয়েছিল, দিকে দিকে মানুষ তবে সেই পথেই হাঁটছেন!

ফের রুখে দাঁড়ানোর প্রতিজ্ঞা (বাঁ দিকে)। ঘুষিতে ফেটেছে ঠোঁট। গত অক্টোবরে ভোটের দিন ঋদ্ধ (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।

ফের রুখে দাঁড়ানোর প্রতিজ্ঞা (বাঁ দিকে)। ঘুষিতে ফেটেছে ঠোঁট। গত অক্টোবরে ভোটের দিন ঋদ্ধ (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।

ঋদ্ধ চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:৪৩
Share: Save:

রুখে দাঁড়ালে গুন্ডারা যে পিছু হটে, সেটা সাত মাস আগে নিজের চোখে দেখেছিলাম। আবার দেখলাম শুক্রবারের আনন্দবাজারে। জামালপুরের মহিলারা যে ভাবে ভোট লুটেরাদের ঠেকিয়েছেন, সে কথা পড়ে গর্ব হচ্ছিল। তার চেয়েও বেশি আশ্বস্ত লাগছিল। বিধাননগরের পুরভোটে আমাদের ফাল্গুনী আবাসন যে রাস্তা দেখিয়েছিল, দিকে দিকে মানুষ তবে সেই পথেই হাঁটছেন!

গত বছর তেসরা অক্টোবর ছিল বিধাননগরের ভোট। ফাল্গুনী আবাসনের মধ্যেই ২২১ নম্বর বুথ। সকাল থেকে কিন্তু শান্ত ভাবেই শুরু হয়েছিল সব কিছু। আবাসনের সকলে বেশ আনন্দ করে লাইনে দাঁড়িয়ে গল্প করতে করতে ভোট দিচ্ছিলেন। সবার ধারণা ছিল, প্রতিবারের মতো এ বারেও নির্বিঘ্নেই কেটে যাবে দিনটা। যদিও কানাঘুষো খবর আসছিল, এলাকার অন্যান্য বুথে অশান্তি শুরু হয়ে গিয়েছে।

ফাল্গুনীর ভোটগ্রহণ কেন্দ্রটি কমিউনিটি হল-এর মধ্যে। এখানে আমাদের আবাসনের লোকজন ছাড়াও পাশের সৌরভ আবাসন আর বিধান আবাসনের বাসিন্দারাও ভোট দিতে আসেন। এখানকার ভোটাররা প্রায় সকলেই সরকারি কর্মচারী বা তাঁদের পরিবারের সদস্য।

বেলা ১টা নাগাদ যখন বুথ একটু ফাঁকা হয়েছে, দেখা গেল একদল বহিরাগত বেশ পেশিবহুল গুন্ডা আবাসনে ঢুকে লাইনে দাঁড়ানো ভোটারদের ভয় দেখাতে শুরু করল। তাদের মুখের ভাষা যেমন অশ্রাব্য, তেমনই অভব্য তাদের আচরণ। বয়স্কদের মানসম্মানের তোয়াক্কা না করেই গায়ের জোরে সকলকে বুথ থেকে বার করে দিতে লাগল ওরা। বোঝাই গেল, শাসক দলের হয়ে ছাপ্পা মারাই ওদের উদ্দেশ্য। বুথে উপস্থিত বামপন্থী এজেন্ট কোনও রকমে ইভিএম আগলানোর চেষ্টা করছিলেন। তাঁকে অসংখ্য কিল-চড়-লাথি-ঘুষি মারতে লাগল গুন্ডারা।

অবস্থা দেখে আমরা পুলিশকে ফোন করলাম। পুলিশ এল। তাড়াতাড়িই এল, বহিরাগতদের বুথ থেকে বারও করে দিল। কিছু ক্ষণ অপেক্ষা করে চলে যাওয়ার আগে আমাদের সকলকে আশ্বস্ত করে গেল, এই ঘটনা আর ঘটবে না।

আসল গল্পটা কিন্তু শুরু হল পুলিশ চলে যাওয়ার পরমূহূর্ত থেকে। সেই ছেলের দল শুধু ফিরেই এল না, আরও ভয়ঙ্কর ভাবে ফিরে এল। আমাদের আবাসনের মধ্যে একটা ধোপার দোকান আছে। এসেই সেখান থেকে একটা গরম ইস্ত্রি তুলে নিয়ে আবাসনের এক কাকিমার গায়ে ছুড়ে মারল। আবাসনের আর এক বাসিন্দা, এক জন উচ্চপদস্থ সরকারি আধিকারিক ওদের হাতে মার খেলেন। আমাদের সহ্যের বাঁধ ভাঙল। আবাসনের যুবকদের নেতৃত্বে মেয়েরা-কাকিমারা এ বার লাঠি-ঝাঁটা যে যা পারলেন, হাতে নিয়ে বহিরাগতদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। তাড়া করে ওদের একেবারে আবাসনের বাইরে বার করে দেওয়া হল। ওরা ঢিল ছুড়ছিল। আমি একটা ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে ঢিল আটকাচ্ছিলাম। আবাসনের গেট দিয়ে বেরনোর আগে ওরা মুখে ঘুষি মেরে আমার ঠোঁট ফাটিয়ে দিল।

গুন্ডাদের ভূমিকা এই পর্যন্তই। আসল বিস্ময়ের তখনও বাকি ছিল। এবং সেই বিস্ময়টা এল এ বার উর্দিধারী পুলিশের কাছ থেকে। দ্বিতীয় বার উত্তেজনার খবর পেয়ে বিধাননগর দক্ষিণ থানার এক অফিসার বিশাল বাহিনী নিয়ে উপস্থিত হলেন। পুলিশ হিসেবে যে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা দরকার, তার ছিটেফোঁটাও অবশ্য ছিল না তাঁর কাজকর্মে। তিনি ঘটনার এফআইআর নেওয়ার পরিবর্তে আবাসিকদের কাছ থেকে আমি কী করেছি, কেন করেছি, কেন গুন্ডাদের আটকেছি, তার খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেন।

আমাকে খুঁজে না পেয়ে বলে যান যে, আমার বিরুদ্ধে কড়া কেস দেবেন। পরবর্তী কালে পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ তুলে আমার নামে সত্যিই জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা দেওয়া হয়। যদিও তা নিয়ে আমি চিন্তিত নই। কারণ, আমি কোনও অন্যায় করিনি। ভোট গণনার পরে বরং দেখা গিয়েছিল যে, একমাত্র ফাল্গুনীর এই বুথেই বিরোধী দলের প্রার্থী ১০০ ভোটে এগিয়ে ছিলেন। এর পুরোটাই ছিল মানুষের ভোট। ভূতের ভোট নয়। এ বারও এখানে কোনও ভূতের নৃত্য হতে দেব না। এক বার যখন ওদের রুখেছি, বারবার রুখব।

যারা অন্যায় করে তাদের শিরদাঁড়া দুর্বল হয়। মানুষ ঘুরে দাঁড়ালে তারা লেজ গুটিয়ে পালায়। এ বারের বিধানসভা ভোটে বিভিন্ন জায়গায় এই ছবি বারবার ফুটে উঠছে। ফাল্গুনীর প্রতিরোধও সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল।

লেখক কলকাতা ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক, ফাল্গুনী আবাসনের আবাসিক।

অন্য বিষয়গুলি:

Assembly Election 2016
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy