বাঁকুড়ার পথে তৃণমূল প্রার্থী সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: অভিজিৎ সিংহ
“প্রার্থী ঘর গোছাচ্ছেন!”— ভোটের মুখে স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিত। তবে খটকা লাগে, যদি কল্পনার সঙ্গে চোখের সামনে থাকা দৃশ্যগুলো না মেলে! যেমন মিলছিল না কলকাতার বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ছেড়ে বাঁকুড়ার যোগেশপল্লির সাধারণ ফ্ল্যাটে ওঠা সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে।
এক দুপুরে গিয়ে দেখা গেল, বাঁকুড়ার তারকাপ্রার্থী যে ফ্ল্যাটে উঠেছেন, তার সামনের সরু রাস্তায় পর পর দাঁড়িয়ে গাড়ি। সবচেয়ে নজর কাড়ছে দু’টি লরি। লরির সামনে দাঁড়িয়ে এক জন সমানে বলে চলেছেন, “ডাম্বল আর ওয়েটপ্লেট এক দিকে রাখো। এক্সারসাইজ় বেঞ্চটা সবার আগে তোলো। আহ! ট্রেডমিলটা এখনও উপরে গেল না? ম্যাডামের চোখে পড়লে তুমি শেষ।” চাঁদিফাটা রোদে হাঁ করে দাঁড়িয়ে এই ঘর-গোছানো দেখে চলেছে গলির ভিড়। কয়েক মিনিটেই নতুন নির্দেশ এল ফ্ল্যাট থেকে। এ বার তৎপরতা একটা বাক্স নিয়ে। কী আছে ওতে? নিরাপত্তাকর্মী বললেন, “গিটার। ম্যাডাম বলেন, ওটাই অক্সিজেন।”
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের বিধানসভা ভিত্তিক ফলের নিরিখে জেলার অন্য ১১টা কেন্দ্রের মতো বাঁকুড়া বিধানসভাতেও পিছিয়ে ছিল তৃণমূল। ২০১৬ সালে বিধানসভা ভোটে রাজ্যজুড়ে ঘাসফুলের প্রবল হাওয়াতেও এই কেন্দ্রে হারতে হয়েছিল তৃণমূলকে। এ বার যুক্ত হয়েছে প্রতিপক্ষের প্রচার, “তারকাপ্রার্থী শুধু ভোট জিততে আসেন, বাঁকুড়াকে দেখিয়েছেন মুনমুন সেন!” এই নেতিবাচক আবহাওয়ায় বাড়তি অক্সিজেনের জন্যই কি ভরসা গিটার?
প্রচার থেকে ‘এক সন্ধ্যার ছুটি’ নেওয়া সায়ন্তিকা বললেন, “শুধু গিটার নয়, বাবার সঙ্গে কথা বলে জিমও তুলে নিয়ে এসেছি। প্রচারের পরে যত ক্লান্তিই থাক, গিটার নিয়ে আমি বসবই। আজ সন্ধ্যেটাই যেমন শুধু গিটার বাজিয়ে কাটিয়েছি। আমি তো এখানে দু’দিনের জন্য আসিনি। এসেছি বাঁকুড়ার মানুষের সঙ্গেই থাকব বলে।” এর পর তাঁর মন্তব্য, “কোনও কিছু যদি মনে করি করবই, তা হলে করবই। যে কোনও নেতিবাচক পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াইয়ের জোরটা পাই ভোর পাঁচটায় উঠে জিমে ঢোকার ফিটনেস শিডিউল থেকে।” বাঁকুড়া কেন্দ্রে এ বারের বিজেপি প্রার্থী নীলাদ্রিশেখর দানা যদিও বললেন, “ও সব শহুরে ফিটনেস মানুষ বোঝেন না। কে কী কাজ করবেন সেটাই বড় কথা।”
বাঁকুড়া শহরে হুডখোলা গাড়িতে প্রচার সারতে বেরিয়ে চালককে সরিয়ে নিজেই স্টিয়ারিংয়ে বসে পড়া সায়ন্তিকা বলছিলেন, “সবার আগে এখানকার মানুষের জলকষ্ট মেটাব। সঙ্গে গত ১০ বছরে যে কাজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার করেছে, সেটাকেই আরও এগিয়ে নিয়ে যাব।” কথা বলতে বলতেই গাড়ি পৌঁছেছিল একটি স্কুলের সামনে। বিশেষভাবে সক্ষম এক মহিলাকে দেখে ব্রেক চাপলেন তারকা। স্টিয়ারিং ছেড়ে লাফিয়ে নেমে জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে। তারকার ওড়নাতেই তারকার ঘাম মুছিয়ে দিয়ে মহিলা বললেন, “তোমায় খুব সুন্দর দেখতে গো। আমার সঙ্গে আবার দেখা করতে আসবে?” এক কথায় রাজি তারকা বললেন, “এখানকার মহিলাদের স্বনির্ভর হওয়ার আরও সুযোগ করে দিতে হবে। তাঁদের আত্মরক্ষার পাঠ দেওয়ার স্কুলও বানাব। শুধু মেয়েরা বলছি কেন, ছেলেদেরও এই সব প্রশিক্ষণ দরকার।” বাম-কংগ্রেস সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী রাধারানী বন্দ্যোপাধ্যায় যদিও বললেন, “এত কথা মানুষ বিশ্বাস করবেন বলে মনে হয় না। কারণ, তৃণমূলের আমলে যা কাজ হয়েছে তার চেয়ে বেশি চুরি হয়েছে।”
বাঁকুড়া রেল স্টেশনের কাছে সায়ন্তিকার সঙ্গী ভিড়টা এর পর জড়ো হয়েছিল চায়ের দোকানের সামনে। চায়ের চর্চায় পছন্দের অভিনেত্রীকে পেয়ে দোকানের মালিক সমীরণ ঘোষ বললেন, “দিদি, তুমি চিন্তা কোরো না। যে যা খুশি প্রচার করতে পারে, কিন্তু তৃণমূল সরকার যে বিনামূল্যে রেশন দিয়েছে এটা অস্বীকার করতে পারবে না।” সেখানেই হাজির এক বৃদ্ধের মন্তব্য, “আমার পাশের বাড়ির বৃদ্ধার চিকিৎসা গত সপ্তাহে স্বাস্থ্যসাথী কার্ডে বিনা পয়সায় হয়ে গেল। এই উপকার পাওয়ার পরে কেউ অন্য কাউকে ভোট দেবে?” এগিয়ে চলল তারকার হুডখোলা গাড়ি। বাঁকুড়া বাসস্ট্যান্ডের কাছে এক মহিলা ছুটে এলেন চন্দনবাটা হাতে। নায়িকার কপালে তিলক কেটে দিয়ে বললেন, “স্বামী-স্ত্রী এই হোটেল চালাই গো। চিন্তা কোরোনা, গ্যাসের দাম শুধু আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে নয়, বিজেপি-কেও ছ্যাঁকা দেবে এ বারের ভোটে।”
বাঁকুড়ার একটি স্কুলের শিক্ষক বছর ষাটেকের নীলাদ্রি পাঁজা বলছিলেন, “প্রার্থী কিন্তু একটা বড় ব্যাপার। বাসুদেব আচারিয়াকে হারিয়ে দেওয়া তারকা পরে যা করেছেন তাতে মানুষের মনে একটা ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল, কিন্তু এই নতুন তারকা অনেক বেশি প্রাণবন্ত। তা ছাড়া, বিজেপি-র প্রার্থী বাঁকুড়ার পরিচিত মুখ নন। বিজেপি যে সুযোগ খুঁজছিল তা বন্ধ করে জোট এমন এক জনকে প্রার্থী করে দিয়েছে, যিনি গত ২০ বছর ধরে একটি ওয়ার্ডে কংগ্রেসের হয়ে জিতছেন। বাঁকুড়া জুড়ে তাঁর সেই প্রভাব না থাকলেও তিনি নিজস্ব কিছু ভোট পাবেন। বামের সব ভোট বিজেপি-তে যাবে না। এতেই লাভ হবে বাচ্চা, প্রাণবন্ত এই মেয়েটার।”
দিনভর প্রচার শেষে নিজের বাঁকুড়ার ঠিকানায় ফেরা সেই মেয়ের অবশ্য এত হিসাব-নিকাশে মন নেই। তখন তাঁর মন কেমনের পালা বাড়ির পোষ্যগুলোর জন্য। বললেন, “কলকাতার কিচ্ছু মিস করছি না, শুধু আমার বাড়ির চারপেয়ে বাচ্চাগুলোকে ছাড়া। ওদের নিজের কাছে এনে রাখতেই পারি। কিন্তু কখন, কোথায় প্রচারে থাকছি নিজেই জানি না। ওদের দেখবে কে? জিতলে এখানে পোষ্যদের জন্য ভাল একটা হাসপাতাল বানাব।” এরপরেই চোয়াল শক্ত করে বলেন, “এখন আমার সব একাগ্রতা শুধু বাঁকুড়া ঘিরে। কোনও ভাবেই তাতে ব্যাঘাত ঘটতে দিতে পারব না।”
দুপুরে প্রচারের মাঝে এক বাড়িতে ডাল-আলুপোস্ত খেয়ে বেরিয়ে তারকাপ্রার্থী নিজেই বলছিলেন, “পুরনো প্রার্থীর নাম তুলে অনেকে পরিবেশ তেতো করে দিতে চাইছেন। আমি কিন্তু উচ্ছেও ভাল খাই। ফেল করা কিন্তু আমার ধাতে নেই।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy