যশ দাশগুপ্ত।
গন্তব্য ডানকুনি, চণ্ডীতলা। এর পর আর কোনও ঠিকানা নেই। জিপিএস ধরে এগোলেই নাকি দেখা যাবে তাঁকে। যিনি চণ্ডীতলার গ্রামে ‘অরণ্য সিংহরায়’ হয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন।
সকাল সাড়ে ৮টায় চণ্ডীতলা পৌঁছেও পাওয়া গেল না তাঁকে। তা হলে? গাড়ির জানালা দিয়ে কমবয়সী এক ঝাঁকদল মেয়ে বলল, ‘‘অরণ্যকে দেখতে এসেছেন? ধারাবাহিকের অরণ্য? এই তো, এই পথ দিয়ে চলে যান। পেয়ে যাবেন।’’ সঙ্গে মুখে ওড়না চাপা দেওয়া খিলখিলে সলজ্জ হাসি। জিপিএস বন্ধ। গাড়ি চলল বড়িঝাঁটির দিকে। গোটা গ্রাম রাস্তায়। কেউ কাউকে বোঝাচ্ছেন, ‘‘টিভিতে ও অরণ্য। বইয়ে যশ।’’
জব্বলপুরের ছেলে যশের আসল নাম দেবাশিস দাশগুপ্ত। সেটা বোধহয় হারিয়েই গেল বিনোদনের 'যশ'-এ। চণ্ডীতলা বিধানসভা কেন্দ্র থেকে ‘বিজেপির বাজি’ তিনি। বিধানসভা ভোটের অব্যবহিত আগে রাজনীতির ময়দানে অভিষেক ঘটিয়েই গেরুয়া শিবিরে নির্বাচনী টিকিট পেয়েছেন। ১০ এপ্রিল ভোটবাক্সে তাঁর ভাগ্যগণনা।
কিছু দূর এগোতেই মুদির দোকানের সদাশিব এগিয়ে এসে বললেন, ‘‘যশ’দা তো? ওই তো, ও দিক দিয়ে গেল। একেবারে ঘরের ছেলে। বলেছিলাম, আমাদের নেতাকে ভোট দেব। মেয়ে তো শুনে কান্নাকাটি! যশকেই দিতে হবে...দেখি।’’ বিজেপি-র প্রার্থী তালিকায় যশের নাম ঘোষণা হতেই নিন্দকেরা বলেছিলেন, ‘‘যশ আর কী প্রচার করবে! ও তো ঠিক করে কথাই বলতে পারে না!’’ কিন্তু কথা বলারও কি খুব দরকার? যশের সঙ্গে সেলফি তুলে ১৬ বছরের মৌসুমী দাস তো বলছিল, ‘‘আমি তো ওকে ভোট দিতে পারব না। তবে ও বলেছে, কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় করে দেবে। জড়িয়েও ধরেছি ওকে।’’
আরও একটু যেতেই শোনা গেল ড্রামের আওয়াজ। মানুষের লম্বা মিছিল, বাইক আর দলের গাড়ির সারি পেরিয়ে দেখা গেল তাঁকে। কোথায় গেল তাঁর বিএমডব্লিউ! যশের বাহন হুডখোলা অটো। গলায় কমলা গাঁদাফুলের মালা। সূর্যের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছেন যশ। জ্বর গায়ে প্রচার চালাচ্ছেন। মুখে হাসি। মেদিনীপুর থেকে সারা রাত হেঁটে এসেছে তাঁর এক ভক্ত। হাতে মালা, ডালায় পুজোর ফুল। বললেন, ‘‘আমাদের ওখানে তো ওকে দেখতে পাব না। শুনলাম, এখানে সকলের বাড়ি যাচ্ছে। চোখের দেখাটা দেখতে এলাম।’’ যশ ফেরাননি ভক্তকে। মালা গলায় পরে সেই মালা আবার ভক্তের হাতেই ফিরিয়ে দিয়েছেন।
কাউকে ফেরাচ্ছেন না যশ। মারিকপাড়া গ্রামের ম্যাক্সি-পরা, ওড়না গায়ে গৃহবধূর দল মাঠ পেরিয়ে দলে দলে ছুট দিচ্ছে তাঁকে দেখতে। কেউ কেউ অটোয় উঠে যশকে জড়িয়ে ধরে বলছেন, ‘‘অরণ্য, তোমায় জিততেই হবে। তুমি হারতে পার না। বলো, তুমি জিতবে।’’ দূর থেকে বাচ্চা কোলে নিয়ে তাঁর স্বামী তখন নির্বাক দর্শক। যাঁরা জড়িয়ে ধরতে পারছেন না, তাঁরা যশের হাত ধরে আছেন। হাতের ওপর হাত রাখা যে এত সহজ, না দেখলে বিশ্বাস হত না! টানাটানিতে একটা সময় যশের হাত গেল কেটে! তবে খুব একটা বিচলিত হলেন না। গ্রামের মানুষই মলমের ব্যবস্থা করে দিলেন। আনন্দবাজার ডিজিটালকে বিজেপি-র চণ্ডীতলার প্রার্থী বললেন, ‘‘দেখলেন তো, মানুষ কত সাহায্য করছেন আমায়! আমি তো শুধু সেলফি তুলছি। আর ওঁরা তো গাছ থেকে ডাব পেড়ে আনছেন। গ্লুকন-ডি দিচ্ছেন। কোত্থাও বাইরে খেতে হচ্ছে না আমায়। রোজ কারও না কারও বাড়িতে নেমন্তন্ন। ভাত, ডাল, শাক যে এত সুস্বাদু হতে পারে, জানা ছিল না!’’
কথা শেষ করতে পারলেন না যশ। একদল মহিলা শাঁখ বাজাতে বাজাতে, ফুল ছুড়তে শুরু করলেন। সকলের আব্দার, একবার জড়িয়ে ছবি তুলবেন। একজন প্রশ্ন করলেন, ‘‘অ্যাই অরণ্য, তোমার পাখি কই? একবার আনো তাকে। তোমায় মেয়েমানুষ ছাড়া দেখতে ভাল লাগে না।’’ হেসে উঠলেন যশ। মনে হল, চন্ডীতলার মানুষ আর কোনও নেতা চান না। ৭০ বছরের লক্ষ্মীরানি অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘‘ভোটে আমার ছেলেকে খেয়ে নিল। এই যশের মতোই বয়স ছিল। ও বাড়িতে আসায় মনে হল, ছেলেটাই ফিরল। এখানে কোনও দলের কোনও নেতাই আর কিছু করতে পারবে না। আমরা শুধু গরিবই থেকে যাবো। তার চেয়ে এই ছেলেটা পাঁচ বছরে মাঝেমাঝে এসে দাঁড়াক। বুকটা জুড়িয়ে যাবে।’’
প্রচারেই যশের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তাঁর এক প্রতিদ্বন্দ্বীর। বড় নেতা। যশ বলছিলেন, ‘‘মহম্মদ সেলিম আমার গুরুজন। দেখা হতেই প্রণাম করেছিলাম। উনি আমায় আশীর্বাদ করেঠেন। এই সৌজন্যই তো পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসে ছিল। ওঁর দলের লোকেরাও তো সেলফিও তুললেন আমার সঙ্গে।’’
তবে যশকে ঘিরে চণ্ডীতলার জনতার উচ্ছ্বাস নজর কাড়ার মতো হলেও তাঁর প্রতিপক্ষরাও কিন্তু দুঁদে। একদিকে পোড়খাওয়া সিপিএম নেতা সেলিম। আর তৃণমূলের প্রার্থী এলাকার দু’বারের বিধায়ক স্বাতী খোন্দকার। প্রসঙ্গটা তুলতে যশ বলছিলেন, ‘‘প্রার্থিতালিকা ঘোষণার পর থেকে এখানে আছি। চণ্ডীতলায় ফ্ল্যাট নিয়েছি। সকাল ৭টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত প্রচার চলছে। মাঝে শুধু খাওয়ার বিরতি। এর পরে মানুষ যা ঠিক করবেন। তবে মানুষ এখানে আর নেতা চান না। ঘরের ছেলেকে চান।’’
অসম্ভব রোগা হয়ে গিয়েছেন। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। পাশ থেকে এক বান্ধবী জলের বোতল এগিয়ে দিয়ে বলছিলেন, ‘‘একটু জল খাও। শরীরটা খারাপ ’’ যশের সঙ্গে থাকতে এসেছেন তাঁর মা। পুত্রের শরীর নিয়ে উদ্বিগ্ন তিনিও। রাজনীতিতে অভিজ্ঞ বান্ধবী নুসরত জাহানের থেকে কোনও টিপ্স নিচ্ছেন না? ‘‘একেবারেই না’’, বললেন যশ। মিমি বা দেবের কাছ থেকেও নয়? ‘‘কী মুশকিল! ওরা আমার বন্ধু অন্য জায়গায়! আর নুসরত তো রাজনীতিতে আমার বিরোধীপক্ষ। ওর থেকে টিপ্স নিতে যাব কেন? মিমির ক্ষেত্রেও তাই। রাজনীতি নিয়ে ওদের সঙ্গে কোনও কথাই বলব না।’’ ঠিকই তো। বিরোধী শিবিরে কেন। যশের হয়ে তো প্রচারে আসার কথা মিঠুন চক্রবর্তীর। দেখা যেতে পারে যোগী আদিত্যনাথকেও।
সন্ধে নামছিল চণ্ডীতলায়। তুলসীতলায় শাঁখ। ডানকুনির মোড়ের চায়ের দোকানে রবি উনুনের আগুনটা বাড়িয়ে দিচ্ছিলেন। ‘দাদা আসবেন চা খেতে। বলছিলেন, ‘‘'রোজ দাদা আমার কাছেই জিরোতে আসেন।’’ চণ্ডীতলায় কি নতুন ঘর পাবেন ‘ঘরের ছেলে’?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy