বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় ও শোভন চট্টোপাধ্যায়।
আর বিজেপি নয়। গেরুয়াশিবিরের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করতে চান শোভন চট্টোপাধ্যায়-বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়। জুটিতে এসেছিলেন বিজেপি-তে। এখন দল ছাড়ার সময়ও জুটি বেঁধেই সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁরা। সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই নিজেদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে রাজ্য বিজেপি-র সভাপতি দিলীপ ঘোষকে চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছেন তাঁরা। ‘রাগ’ একটাই। প্রার্থিত আসন বেহালা পূর্ব থেকে প্রার্থী করা হয়নি শোভনকে। যেটাকে ‘চক্রান্ত’ ও ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ বলে মনে করেছেন বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়।
বেহালা পূর্ব। তৃণমূলের টিকিটে পর পর দু’বার এই কেন্দ্র থেকে বিধায়ক হয়েছেন শোভন চট্টোপাধ্যায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারে মন্ত্রীও হয়েছেন। এই বিধানসভা এলাকার ১৩১ নম্বর ওয়ার্ডে থেকে কাউন্সিলর হয়েই কলকাতার মেয়র হয়েছেন। বিজেপি এ বার শোভনের দাবি মেনে নিলে ওই আসনে স্ত্রী রত্না চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গেই লড়াই হত কাননের। কিন্তু সেই লড়াই হচ্ছে না। বিজেপি ওই আসনে প্রার্থী করেছে অভিনেত্রী পায়েল সরকারকে। সেই ঘোষণার পরে পরেই ফেসবুকে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বৈশাখী। তবে শোভন এখনও পর্যন্ত প্রকাশ্যে কিছু বলেননি। বৈশাখী তাঁর নিজের সঙ্গে শোভনের ছবি পোস্ট করে ফেসবুকে ইংরেজিতে লিখেছেন, ‘তুমি সব সময় আমার বিগ্রহ। আজ যে ভাবে অসম্মান করা হল সেটা আমাদের ‘স্পিরিট’ নষ্ট করে দিতে পারবে না। আমরা আবার লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে ফিরে আসব। চক্রান্ত ও বিশ্বাসঘাতকতা বেশি দিন স্থায়ী হয় না। বেহালা পূর্বের মানুষ তোমায় ভালবাসে আর সেটাই তোমার সবচেয়ে বড় শক্তি’।
শোভনের বান্ধবী ফেসবুকে এই পোস্ট করার মধ্য দিয়েই নিজেদের ক্ষোভ জানিয়ে দেন। পরে আনন্দবাজার ডিজিটালের পক্ষে যোগাযোগ করা হলে বৈশাখী জানান, ফেসবুকে তিনি যা লিখেছেন সেটাই ওঁর প্রতিক্রিয়া। অন্য দিকে, বিজেপি-র পক্ষ থেকে এ নিয়ে কেউ কোনও প্রতিক্রিয়া দেননি। জানা গিয়েছে, শোভন-বৈশাখী প্রার্থী তালিকা প্রকাশিত হওয়ার পরে দলীয় নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগও করেছিলেন কিন্তু গেরুয়াশিবির যে অনমনীয় সেটা বুঝতে পেরেই দলের যাবতীয় দায়িত্ব ছেড়ে দিতে চান তাঁরা। প্রসঙ্গত রাজ্য বিজেপি-র সাংগঠনিক কলকাতা জোনের পর্যবেক্ষকের দায়িত্বে রয়েছেন শোভন। জোনের সহ-আহ্বায়ক বৈশাখী। বিজেপি-র রাজ্য কমিটিতেও রয়েছেন শোভন-বৈশাখী।
দলে যোগদানের অনেক পরে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর প্রথম শোভনকে বিজেপি রাজ্য কমিটিতে নেয়। ব্রাত্য থাকেন বৈশাখী। এ নিয়ে ঘনিষ্ঠমহলে শোভন ক্ষোভ প্রকাশ করায় পরে রাজ্য কমিটিতে ঠাঁই হয় বৈশাখীর। নীলবাড়ির লড়াইয়েও দু’জনেই প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। তাঁরা প্রকাশ্যে তা বলেও ফেলেন। কিন্তু অতীতে অনেক দাবি মেনে নেওয়া হলেও এ বার আর বৈশাখীকে প্রার্থী করতে চায়নি বিজেপি। গেরুয়া শিবির সূত্রে খবর, বৈশাখীর শর্ত না মানা হলেও শোভনকে প্রার্থী করা হবে বলেই ঠিক ছিল। কিন্তু বিজেপি সূত্রে খবর, শনিবার দিল্লিতে বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিটির বৈঠকে শোভনের নামও বাদ দেওয়া হয়। কারণ, শোভনকে প্রার্থী করা হলে বেহালা পূর্বের বিজেপি কর্মীদের বড় অংশ কাজে না-ও নামতে পারেন বলে আশঙ্কা ছিল নেতাদের। শোভনকে মেনে নেওয়া গেলেও বৈশাখীকে নিয়ে কর্মীদের আপত্তি ছিল বলে জানা যায়।
শোভন-বৈশাখী জুটিকে নিয়ে বিজেপি-র অস্বস্তি নতুন নয়। অনেক মান-অভিমান পর্বও গিয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি তাঁর দলীয় মঞ্চে পারিবারিক ‘কেচ্ছা’ টেনে আনেন। শোভনের একটি মন্তব্যের জন্য গত ৬ ফেব্রুয়ারি আলিপুর আদালতে মামলা করতে গিয়েছিলেন রায়দিঘির বিদায়ী বিধায়ক অভিনেত্রী দেবশ্রী রায়। তখন তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘‘শোভন চট্টোপাধ্যায় মতো মানুষেরা সামাজিক অস্বস্তি। পরিবার, সন্তানের কাছে, স্ত্রী-র কাছে যে আপন নয়, সে কত বড় নেতা! সে কি জনপ্রিয় নেতা হতে পারে! মানুষের সামনে দাঁড়াতে পারে?’’ সেই দিনই দক্ষিণ ২৪ পরগনার মহেশতলায় বিজেপি-র রোড শোয়ে যোগ দেন শোভন-বৈশাখী। দলের ট্যাবলোয় দাঁড়িয়েই দু’জন আক্রমণ করেন দেবশ্রীকে। তাঁর পরিবার নিয়ে দেবশ্রী যে প্রশ্ন তুলেছেন, তার জবাবে শোভন বলেন, ‘‘উনি সন্তানের মা নন। আর সংসার? ওঁর যে সংসার ছিল, তার কী পরিণতি হল, সেটা যেন মানুষের কাছে খোলসা করেন। আমি তো নির্দিষ্ট অভিযোগ এনে বিবাহবিচ্ছেদের মামলা করেছি। সেই মামলা চলছে...। মায়ের থেকে মাসির দরদ বেশি! কথায় বলে, সে কে? ডাইনি।’’ নিজের স্ত্রী রত্না সম্পর্কেও শোভন বলেন, ‘‘রত্নাদেবী দিনে একবার আমায় টেলিফোন করতেন। আর একশোবার কাকে ফোন করতেন, তার খোঁজ নিয়ে দিন দুলাল দাস (শোভনের শ্বশুরমশাই)!’’ এ সবকে যে দল ভাল চোখে দেখছে না তা এর পরে পরেই বুঝিয়ে দেন রাজ্য সভাপতি দিলীপ।
শোভন-বৈশাখীকে নিয়ে নানা রসিকতা দলের ভাবমূর্তিতে আঘাত করছে বলেও মনে করছিল বিজেপি। ওই জুটি সম্পর্কে প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করা থেকেও বিরত থাকতেন রাজ্য নেতারা। মঞ্চ ভাগ করার ক্ষেত্রেও অনেকের অনীহা দেখা গিয়েছে। এ বার তাঁরা বিজেপি ছাড়তে চান এমন সিদ্ধান্ত শোনার পরে রাজ্য বিজেপি-র এক প্রথম সারির নেতার বক্তব্য, ‘‘অনেক হয়েছে। প্রেম, ভালবাসা নিয়ে ওঁরা থাকুন। রাজনীতি করতে হবে না। আমরা হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy