আবু তাহের।
ভাগ তাহের ভাগ!
এই তিনটি শব্দেই সর্ব ক্ষণ নিজেকে ছুটিয়ে চলেছেন নন্দীগ্রাম জমি আন্দোলনের অন্যতম প্রধান মুখ আবু তাহের। ছুটে চলা মানে পালিয়ে বেড়ানো। এমনিতেই গত কয়েক দিন ধরে তিনি বাড়িতে থাকছিলেন না। কিন্তু রবিবার কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)-র হাতে তৃণমূল নেতা ছত্রধর মাহাতো গ্রেফতার হওয়ার পর আর কোনও ঝুঁকি নিতে চাইছেন না তাহের। দিনের মধ্যে বেশ কয়েক বার ডেরা পাল্টাচ্ছেন। গতিপ্রকৃতির বাঁ হাতের খবর ডান হাতকেও জানতে দিচ্ছেন না। ঘণ্টা দুয়েকের আবু-সন্ধান শেষে তাঁকে কোনওক্রমে পাওয়া গেল তখনকার গোপন আস্তানায়। আনন্দবাজার ডিজিটালের হাতে ‘ধরা দিয়ে’ তাহের বলছিলেন, ‘‘ছত্রধরের মতো চালাক লোককেও ওরা যে ভাবে তুলে নিল! আর কোনও ঝুঁকি নিতে পারছি না। কোনও অন্যায় না করে এ ভাবে পালাতে হবে ভাবিইনি।’’
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রবিবার নন্দীগ্রাম এসেছেন। আগামী ১ এপ্রিল ভোট। অথচ নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় থেকে এই জনপদে তাঁর অন্যতম সৈনিক তাহের গত কয়েক দিন ধরে বাড়িছাড়া। নন্দীগ্রামের চৌরঙ্গিবাজার পেরিয়ে গোপীমোহনপুর গ্রামে তাহেরের বাড়ি। রবিবার সকালে সেখানে গিয়ে জানা গেল, তাহের বাড়িতে নেই। কোথায় গিয়েছেন কেউ জানেন না। বাড়ির ধূ-ধূ উঠোনে মমতা-তৃণমূলের বিশাল বিশাল দুই ব্যানার। কিন্তু তিনি নেই। মোবাইল ফোন দুটোও বাড়িতে রেখে গিয়েছেন।
শুরু হল আবু-সন্ধান।
প্রায় দু’ঘণ্টার চেষ্টায় খুঁজে পাওয়া গেল তাহেরকে। আসলে তিনিই দেখা করতে চাইলেন। সে কারণেই গাছপালা ঘেরা এক প্রান্তরে দেখা হল। গত ফেব্রুয়ারিতে তাঁর পা ভেঙেছিল ছিল। তাহেরের কথায়, ‘‘পা ভাঙার পর যা যন্ত্রণা পেয়েছিলাম। তার থেকে বেশি যন্ত্রণা পাচ্ছি এখন। ভাবতে পারেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নন্দীগ্রামে প্রার্থী। আর আমি তার প্রচার করতে পারছি না! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নন্দীগ্রামে এসেছেন। আর আমি দেখা করতে যেতে পারছি না। ১ তারিখে ভোটটাও দিদিকে দেওয়া হবে না। এটা যে কতটা যন্ত্রণার!’’ তাহের এখন নন্দীগ্রাম ১ নম্বর পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি। পরিবহণ দফতরের ডিরেক্টরও। মাসখানেক আগে রাজ্য সরকার তাঁকে ওয়াই ক্যাটেগরির নিরাপত্তা দিয়েছিল। কিন্তু গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হতেই ৯ জনের সেই নিরাপত্তাও তুলে নেওয়া হয়েছে।
নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় একাধিক মামলায় জড়িয়ে পড়েছিলেন তাহের-সহ স্থানীয় একাধিক নেতা। সেই তালিকায় মমতার নির্বাচনী এজেন্ট শেখ সুফিয়ান, স্বদেশ দাস, স্বদেশ দাস অধিকারীরাও ছিলেন। সেই মামলাগুলির বেশ কয়েকটা আগেই রাজ্য সরকার তুলে নেয়। শেষ ১০টা মামলা তুলে নেওয়া হয় মাস চারেক আগে। তাহেরের এককালের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা শুভেন্দু অধিকারী তখনও বিজেপি-তে যাননি। ডিসেম্বরে শুভেন্দু বিজেপি-তে যাওয়ার পর গত ৫ মার্চ কলকাতা হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা হয়। আদালতে অভিযোগ করা হয়, তাহেরদের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলি ‘অনৈতিক ভাবে’ তুলে নেওয়া হয়েছে। এর পর আদালত গত ১৫ মার্চ নতুন করে তাহেরদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। তার পর থেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তাঁরা। এর মধ্যে শুধু সুফিয়ান ২ সপ্তাহের ছাড় পেয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট থেকে। ছাড়ের কারণ, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়ার আগেই তাঁকে নির্বাচনী এজেন্ট করা হয়েছিল। কিন্তু তাহেরদের সেই সুযোগ মেলেনি। শনিবার আবার সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছেন। তবে তার শুনানি আগামী ৪ তারিখের আগে হবে না বলেই আদালত সূত্রে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে ১ তারিখ ভোট দিতেও যাবেন না তাহের।
ইতিমধ্যেই বেশ কয়েক বার বাড়িতে পুলিশ এসেছে। সঙ্গে কেন্দ্রীয় বাহিনী এবং নির্বাচন কমিশনের পর্যবেক্ষক। তাহের বলছিলেন, ‘‘শুক্রবার রাতে প্রায় ৪০ জন আমার বাড়ি ঘিরে ফেলে। আমি যদিও বাড়িতে ছিলাম না। টেনশনে রাতে ঘুমোতে পারছি না। শনিবার রাতে তো বুকে ব্যথা করছিল।’’ মোবাইল ব্যবহার করছেন না। পাছে কোথায় আছেন, ধরে ফেলে পুলিশ! বাড়িতেই দুটো মোবাইল রেখে গিয়েছেন। গোটাটার জন্য এককালের ‘সহযোদ্ধা’ শুভেন্দুকেই দায়ী করছেন তাহের। তাঁর কথায়, ‘‘আমি যাতে মাইক ধরে ওঁর মুখোশ খুলে দিতে না পারি, সে কারণেই শুভেন্দু’দা এটা করিয়েছেন। কিন্তু উনি জিতবেন না। নিজের রাজনৈতিক কেরিয়ারটা শেষ করলেন নিজেই। ধর্মের তাস খেলতে গিয়ে উনি বিপদে পড়ে গিয়েছেন নন্দীগ্রামে।’’
তাহেরকে বিজেপি-তে যাওয়ার অনুরোধ করেননি শুভেন্দু? ‘‘বলেছিলেন। কিন্তু আমি তো নন্দীগ্রামবাসী। আমার বিবেককে আঘাত করতে পারি না। নন্দীগ্রাম আন্দোলনে তো শুভেন্দু’দার রক্ত ঝরেনি। ঘরছাড়াও হননি। উনি আমাদের সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু আবেগের অংশাদীর হতে পারেননি। না হলে বিজেপি-তে যেতেন না। তাই দিদি যত দিন বেঁচে আছেন, তত দিন তৃণমূল ছাড়ার কোনও ইচ্ছাই নেই। তাতে যা হয় হবে। আবু তাহের ভয় পায় না,’’— বলছেন মমতার ‘অনুগত সৈনিক’।
কথা শেষে একটাই অনুরোধ, ‘‘ছবিটা ব্যবহার করবেন না। ওঁরা জায়গাটা চিনে ফেলবেন। বিপদে পড়ে যাব।’’ এর পরেই বাইকে। মনে মনে বোধহয় আবার বললেন, ‘‘ভাগ তাহের ভাগ!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy