Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
ভোট-নজরে পুরুলিয়া
purulia

Bengal Polls: পুনর্গঠিত পুরুলিয়াতেও চিন্তায় রাখছে ‘চক্রব্যূহ’

মাওবাদীদের বাড়বাড়ন্তের সময় যে গ্রামে শোনা যেত, ‘রাষ্ট্র দেখে না’, বলরামপুরের সে মাহালিটাঁড় গ্রামের লধে হেমব্রম, শুকদেব টুডুরা জানাচ্ছেন, দু’টাকা কিলোর চাল মিলেছে।

অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০২১ ০৬:৪৪
Share: Save:

এ জেলার মাটি লড়াই দেখেছে অনেক। বঙ্গভুক্তির মরিয়া চেষ্টার, ভাষা-আন্দোলনের। বিধানসভা ভোটেও নানা ঘাত-প্রতিঘাতের জমি তৈরি পুরুলিয়ায়। সে লড়াই কোনও দলের অন্দরের হোক বা বাইরের।

এক যুদ্ধ ছিল লোকসভার। তাতে জেলার ন’টি বিধানসভার মধ্যে আটটিতে (মানবাজার ছাড়া) বিজেপির কাছে পিছিয়ে পড়ে রাজ্যের শাসক দল। পর্যবেক্ষকদের মতে, ২০১৯-এর মে মাসের সে ফলাফলের পরে, শুরু হয় ‘পুনর্গঠন’। তৃণমূল নয়, প্রশাসনের তরফে।

প্রশাসনের কর্তাদের একাংশের উপলব্ধি ছিল, এ জেলায় ভূপ্রাকৃতিক কারণে জল থাকে না। জমির উপরিভাগের মাটি সরে যায়। চাষ করা দুষ্কর। মানুষ চলে যায় অন্যত্র, কাজের খোঁজে। জল, মাটি আর মানুষকে ভিত্তি করে তৃণমূল স্তরে পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে প্রশাসন নেয় একাধিক কর্মসূচি। শাসক এবং একাধিক বিরোধী নেতার পর্যবেক্ষণ, প্রশাসনের সে উদ্যোগের সুফল বিধানসভা ভোটে পাওয়ার কথা ছিল তৃণমূলের। কার্যত তা-ই হবে, এমন অবশ্য বুক বাজিয়ে বলতে পারছে না শাসক দল।

বান্দোয়ানের ভালু গ্রামে ‘ডুংরি’র (টিলা) গায়ে ‘মাটির সৃষ্টি’ প্রকল্পে ধাপ কেটে ফলের গাছ বসানোর প্রকল্প নিয়েছিল প্রশাসন। লক্ষ্য ছিল ভূমিক্ষয় রোধ, এলাকার জলস্তরের উন্নতি এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের ১০০ দিনের প্রকল্পে কাজ দেওয়া। তিনটে কাজই হয়েছে তবে আংশিক, দাবি সুপার্জিত মাহাতোর মতো প্রকল্পে কাজ করা স্থানীয়দের।

মাওবাদীদের বাড়বাড়ন্তের সময় যে গ্রামে শোনা যেত, ‘রাষ্ট্র দেখে না’, বলরামপুরের সে মাহালিটাঁড় গ্রামের লধে হেমব্রম, শুকদেব টুডুরা জানাচ্ছেন, দু’টাকা কিলোর চাল মিলেছে। নতুন নলকূপ হয়েছে। ‘জয় জোহার’ প্রকল্পে টাকা এসেছে। ‘বাংলার আবাস যোজনা’য় ঘর হয়েছে। তবে সে সব কাজের জন্য তাঁরা নেতাদের নয়, প্রশাসনের কর্তাদের দেখেছেন এলাকায়।

একই দাবির শরিক মানবাজারের পরিযায়ী শ্রমিক নেপাল বাউরি, তুলসি বাউরিরা। জানাচ্ছেন লকডাউনে পূর্ব বর্ধমান, বাঁকুড়ার ইটভাটায় কাজ হারিয়ে বাড়িতে ফিরেও অসুবি‌ধায় পড়তে হয়নি প্রশাসনের দৌলতে ১০০ দিনের প্রকল্পে ‘পর্যাপ্ত’ কাজ মেলায়। বাঘমুণ্ডির ভূপতিপল্লির বীরহোড় তরুণী বা বান্দোয়ানের আত্মসমর্পণ করা প্রাক্তন মাওবাদী (সরকারি চাকরি না মেলায় ক্ষুব্ধ) এক কথায় মেনে নিচ্ছেন— কাজ করেছে প্রশাসন।

‘‘প্রশাসন মানুষের কাছে পরিষেবা পৌঁছে দিয়েছে। সুফল পাব আমরা’’, বলছেন বলরামপুর ব্লক তৃণমূল সভাপতি অঘোর হেমব্রম।

তাই কি?

পঞ্চায়েত ভোটে বলরামপুরের যে নেতার বিরুদ্ধে ওঠা নানা দুর্নীতির অভিযোগ কার্যত তুরুপের তাস হয়েছিল বিজেপির, এখনও তৃণমূলে থাকা সেই প্রাক্তন জেলা সভাধিপতি সৃষ্টিধর মাহাতো কিন্তু ভিন্ন মত। তাঁর বক্তব্য, প্রশাসনের পদক্ষেপ যদি কিছুটা জমি ‘পুনরুদ্ধার’ করে থাকে, তা হলে নেতাদের ‘দ্বন্দ্বের’ জেরে এবং তাঁদের একাংশের বিরুদ্ধে ‘কাটমানি’ নেওয়ার অভিযোগ ওঠায় তা খুইয়েছে তৃণমূল।

• ভোট ২৭ মার্চ

• বিধানসভা আসন ৯

• ২০১৬-র ভোটে: তৃণমূল ৭, কংগ্রেস ২

• লোকসভা ভোটে: বিজেপি এগিয়ে ৮টিতে, তৃণমূল ১টি কেন্দ্রে

সৃষ্টিধরের ‘তত্ত্ব’ না মানলেও, বিজেপির টিকিটে জিতে তৃণমূলে এসে বলরামপুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি নিতাই মণ্ডলের অঙ্ক কিন্তু পুরোপুরি ‘প্রশাসনিক উন্নয়ন’ নির্ভর নয়। তিনি নির্দেশ করছেন বিজেপির অন্দরের ‘ফাটলের’ দিকেও।

পঞ্চায়েত ভোটের ঠিক পরেই সুপুরডি গ্রামে তরুণ ত্রিলোচন মাহাতোকে বিজেপি করার ‘অপরাধে’ খুন করে গাছে ঝুলিয়ে দেওয়ায় অভিযুক্ত ‘তৃণমূল-আশ্রিত’ দুষ্কৃতীরা। সে মামলা আদালতে বিচারাধীন। বিজেপি প্রার্থী করবে ভেবে মনোনয়ন পত্র তুলেছিলেন ত্রিলোচনের দাদা, যুব মোর্চার জেলা সম্পাদক বিবেকানন্দ মাহাতো। বলছেন, ‘‘মনোনয়ন জমা দিইনি দলকে ভালবাসি বলে। আরও অনেকে আছেন, যাঁরা এখানে শহিদ পরিবারের দুঃখ বোঝেন। তেমন এক নেতা নির্দল হয়ে এখানে ভোটেও দাঁড়িয়েছেন।’’ বিজেপির জেলা সভাপতি বিদ্যাসাগর চক্রবর্তী অবশ্য বলেছেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নামে সবাই এক। যাঁরা ভুল বুঝেছেন, তাঁরাও দলেই আছেন।’’ তাঁর প্রত্যয়, ‘‘জেলায় সব আসনেই জিতব।’’

‘‘বাঘমুণ্ডিতে তা হলে ওঁরা ‘কলা’কে (বিজেপির তরফে লড়া অল ঝাড়খণ্ড স্টুডেন্টস ইউনিয়নের নির্বাচনী প্রতীক) টিকিট দিলেন কেন’’, জিজ্ঞাসা কংগ্রেস কর্মীদের। জয়পুর আসনে পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে তৃণমূল প্রার্থীর মনোনয়ন খারিজ হওয়া এবং পরে দলেরই এক ‘বিক্ষুব্ধ’কে তৃণমূল ভোটে সমর্থন করবে জেনে হাসছেন জেলা কংগ্রেস সভাপতি তথা বাঘমুণ্ডির প্রার্থী নেপাল মাহাতো। সাহেববাঁধের পাড়ের কার্যালয়ে পুরুলিয়া আসনে কংগ্রেস প্রার্থী পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ছেলেদের পরিচয় করাতে আনা বৃদ্ধ বলে যান, ‘‘প্রার্থী বাছাই ভাল হয়েছে আমাদের।’’ পার্থপ্রতিমের প্রতিপক্ষ তৃণমূল থেকে কংগ্রেস হয়ে বিজেপিতে আসা সুদীপ মুখোপাধ্যায়ের অবশ্য দাবি, ‘‘কংগ্রেস বেশি ভোট পেলে, ৫০ হাজারেরও বেশি ভোটে জিতব।’’

অন্য পক্ষের ভোটের দিকে তাকিয়ে তৃণমূলও। বলরামপুরের প্রার্থী তথা দলের জেলা চেয়ারম্যান শান্তিরাম মাহাতোর মতো অনেকে মনে করেন, বান্দোয়ান, মানবাজার এবং কাশীপুরে বামেদের ভোট এ বার অটুট থাকলে (বিজেপিতে না গেলে), সুবিধা হবে তাঁদের। বাম-ভোট শুধু অটুট থাকবে নয়, লকডাউনের সময়ে নিম্নবিত্ত মানুষের পাশে দলীয় কর্মীরা থাকায় এবং তুলনায় কম বয়সীদের (২৭-৪৮) প্রার্থী করায় ভাল ফলের আশা করছেন সিপিএমের জেলা সম্পাদক প্রদীপ রায়। প্রাদেশিকতায় বিশ্বাস করেন না জানিয়ে তাঁর প্রশ্ন, স্বাস্থ্য বা শিক্ষা ক্ষেত্রে কেন ভিন‌্ জেলার লোক নিয়োগ পাবেন তুলনায় কম চাকরির জেলা পুরুলিয়ায়! ভোট অন অ্যাকাউন্টে রঘুনাথপুর মহকুমায় শিল্পনগরীর জন্য রাজ্য সরকারের ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করার পিছনে ভোটের জন্য জমি তৈরির অঙ্ক কাজ করছে, ধারণা তাঁর।

শিল্পের জন্য প্রায় দেড় দশক আগে জমি দিয়েও তাতে শিল্প না হওয়া বা চাকরি না মেলার ক্ষোভে ফুটছেন পাড়া বিধানসভার রায়বাঁধ বা রঘুনাথপুর বিধানসভার নতুনডি এলাকার বাসিন্দারা। তাঁদের হতাশা, ‘‘প্রতি ভোটের আগে এলাকার কিছু নেতা নিজেদের ছকে স্থির করে নেয় ক্ষমতায় কারা আসবে। বাম আমল থেকে তৃণমূলের জমানা হয়ে ওরা এ বার অন্য দিকে তাকিয়ে। শিল্প-চাকরি পেতে গেলে, নিজেদের মতো করেই লড়তে হবে।’’

নিজের মতো করে লড়তে হচ্ছে তাঁকেও, জানাচ্ছেন পুরুলিয়া আসনে তৃণমূল প্রার্থী তথা জেলা সভাধিপতি সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায়। পুরুলিয়া আসনের অনেক দাবিদার ছিল দলে। সুজয়বাবুর দাবি, তিনি টিকিট পাওয়ার পরে, কিছু লোক ‘অন্তর্ঘাত’ করছে। বলেছেন, ‘‘অভিমন্যু নয়, এখানে অর্জুন আছে। যে চক্রব্যূহে ঢুকতেও জানে, বেরোতেও।’’

সে লড়াইও দেখা বাকি পুরুলিয়ার।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy