ফার্স্ট বয়: তিনি নাকি তৃণমূলের ফার্স্ট বয়? নিজে অবশ্য মনে করেন না। শুধু বলেন, ‘‘এটা ঠিক যে, আমিই তৃণমূলের প্রথম বিধায়ক। নতুন দল তৈরির সময় প্রয়োজনে কংগ্রেসের বিধায়ক পদ ছেড়ে আমাকে উপনির্বাচনে দাঁড়াতে হয়েছিল। কিন্তু ‘ফার্স্ট বয়’ বলাটা অনেকাংশেই অতিশয়োক্তি। তবে দলের নেতারা জানেন, প্রথম বিধায়ক হয়েও সেভাবে গুরুত্ব পাননি। প্রথমবার দল ক্ষমতায় আসার পর মন্ত্রীও করা হয়নি। দ্বিতীয় সরকারে অবশ্য সফল মন্ত্রী থেকেছেন।
বদ্রুনাথ: ডাকনাম। তাঁর জন্মের পর কয়েক বছর বাবা কাশীনাথ এবং মা কনকপ্রভা কাটিয়েছিলেন দেওঘরে। সেখানেই অন্নপ্রাশন হয়েছিল ছোট্ট শোভনদেবের। হিন্দি মানুষ বাঙালি দম্পতির ছোট্ট ছেলেকে আদর করে ‘বুতরু’ বলে ডাকা শুরু করেন। কলকাতায় সেই নামের অপভ্রংশ হয়ে দাঁড়ায় ‘বদ্রু’। তবে সেই নামে ডাকার কেউ এখন আর ধরাধামে নেই। তাই নামটাও বিস্মৃতির আড়ালে।
নক আউট: সদা নম্রস্বভাবের সত্তরোর্ধ্ব শোভনদেবকে এখন দেখলে ভাবা কঠিন যে, একদা একেকটি পাঞ্চে বিরোধীদের রিং থেকে নক আউট করে দিতেন। ছয়ের দশকের গোড়ায় জাতীয় স্তরের বক্সার ছিলেন। ১৯৬২-’৬৪ সাল বক্সার জীবনের সোনার সময়। কলেজ থেকে জাতীয় পর্যায়ের বক্সার হন। ছিলেন ভারতীয় যুব বক্সিং দলের অধিনায়কও। আন্তর্জাতিক আসরে শ্রীলঙ্কার বক্সারকে হারিয়ে জিতেছিলেন খেতাব। বয়সের ভারে নিজে আর রিংয়ে নামতে পারেন না। কিন্তু বাড়ির কাছে ভবানীপুর বক্সিং অ্যাসোসিয়েশনের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষক।
গুরুবাদী: পাঁচের দশকে ভবানীপুর এলাকায় সুরেশ বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক কংগ্রেস নেতা ছিলেন। তখন ‘মণ্ডল’ বলা হত ব্লক সংগঠনকে। ভবানীপুরের একটি মণ্ডলের সভাপতি ছিলেন সুরেশবাবু। যুবক শোভনদেবকে ছাত্র রাজনীতিতে নিয়ে আসেন তিনিই। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। মন্ত্রী হয়েও গুরুকে ভোলেননি শোভনদেব।
লম্বা রেসের ঘোড়া: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন যোগমায়া দেবী কলেজের দামাল ছাত্রনেত্রী, তখন থেকেই পরিচিতি। কিন্তু ঘনিষ্ঠতা মমতা জেলা যুব কংগ্রেসের সম্পাদক হওয়ার সময় থেকে। মেয়েটির লড়াকু মানসিকতা চোখ টেনেছিল। বুঝেছিলেন, রাজনীতির ময়দানে মমতা লম্বা রেসের ঘোড়া। কিন্তু একদিন যে তাঁর নেতৃত্বেই রাজনীতি করতে হবে, তা বোঝেননি। তাতে অবশ্য সমস্যা হয়নি। তাঁর ব্যাখ্যায় মমতার নেতৃত্ব অন্য নেতাদের থেকে ভিন্ন।
বিধানস্মৃতি: যে বছরে শোভনদেবের রাজনীতিতে আগমন, সে বছরই মারা যান তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়। সালটা ১৯৬২। সে বছর ফেব্রুয়ারিতে ভোট হয়েছিল। বিধানবাবু কলকাতার বৌবাজার ও বাঁকুড়ার শালতোড়া থেকে প্রার্থী হয়েছিলেন। বৌবাজারের ভোটে খুব কম ব্যবধান জিতেছিলেন। শালতোড়ে বিরাট ব্যবধানে। শেষে বৌবাজার রেখে শালতোড়া ঢাড়েন তিনি। মুখ্যমন্ত্রীও হন। ১ জুলাই তাঁর জন্মদিনেই চলে যান দুনিয়া ছেড়ে।
নেত্রীই যখন স্ত্রী: সাতের দশকে যুবনেত্রী সুপ্রিয়া সেনগুপ্তের সঙ্গে আলাপ মহাজাতি সদনে। তার আগে ১৯৬৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন সুপ্রিয়া জয় পান ইতিহাস বিভাগে। তখন নকশালদের দাপটে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠন করার সাহস পেত না। সেই সময় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে দাঁড়িয়ে জয় বিশাল কৃতিত্বের বিষয় ছিল। সেই বছরেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জিতেছিলেন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ১৯৭২ সালে মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের রাজনৈতিক সচিব হন সুপ্রিয়া। এমন দাপুটে নেত্রীর সঙ্গেই প্রেম ও বিবাহ। ২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল তাঁকে ছেড়ে পরপারে পাড়ি দিয়েছেন সুপ্রিয়া। মৃদু হেসে শোভনদেব বলেন, ‘‘নিজের নেত্রীকে ক’জনই বা স্ত্রী করতে পারে!’’ তার পর ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলেন, ‘‘এখনও সন্ধ্যো হলেই মনে হয়, বাড়ি এসে ওর সঙ্গে দুটো কথা বলি। পরে ভাবি, ও তো আর নেই।’’
হাইটেকে হোঁচট: ১৯৯১ সাল থেকে ধারাবাহিক ভাবে বিধানসভা ভোটে প্রার্থী। কিন্তু প্রচার কৌশল বদলে গিয়েছে আমূল। এই হাইটেক প্রচারের যুগে বড় বেমানান তিনি। পদে পদে হোঁচট খেতে হয়। বিষয়টা অসাধ্য বলে বিবেচনা করে নেটমাধ্যমে যাবতীয় প্রচারের দায়িত্ব ছোট ছেলে সায়নদেবের উপর ছেড়ে দিয়েছেন। চমৎকৃত হয়েছেন, যখন ভবানীপুরে প্রচারে বেরিয়ে আচমকা শ্যালিকার মেয়ের ফোন পান মুম্বই থেকে— ‘‘মেসো, তুমি এখন ভবানীপুরের ৭৩ নম্বর ওয়ার্ডে প্রচার করছ তো?’’ বিস্মিত শোভনদেব আরও শুনতে পান, ‘‘তোমার প্রচার সরাসরি দেখছি তো!’’
উত্তরাধিকার: দুই পুত্র ঈশানদেব ও সায়নদেব। ঈশানের রাজনীতিতে আগ্রহ নেই। সায়ন রাজনীতিতে এসেই নিজের জায়গা করে নিয়েছে। যোগেশচন্দ্র চৌধুরী ল’ কলেজে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ করেই রাজনীতির ময়দানে আগমন শোভনদেবের কনিষ্ঠপুত্রের। নেত্রী মমতার নির্দেশেই পুত্রকে রাজনীতিতে আসার সবুজ সঙ্কেত দিয়েছেন। সায়ন তৃণমূল যুব কংগ্রেসের রাজ্য সম্পাদক। স্বজনপোষণ? নাহ্, সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে রাজনীতিতে উত্তরণ হলে আপত্তি নেই পিতার। বলেন, ‘‘কেউ যদি লড়াই-সংগ্রাম করে রাজনীতিতে নিজের জায়গা তৈরি করলে স্বজনপোষণের কথা আসে কোথা থেকে।’’
বইপোকা: অবসর নেই বললেই চলে। পেলেই পড়াশোনায় মন দেন। রাজনৈতিক প্রতিবেদন লেখার প্রতিও ঝোঁক রয়েছে। নিজের পড়াশোনার জন্য পৃথক তিনটি গ্রন্থাগার রয়েছে তাঁর। কাঁসারিপাড়ার ফ্ল্যাট এবং অফিসের গ্রন্থাগার। টালিগঞ্জে সমবায় দফতরের অফিসে তৃতীয় গ্রন্থাগার। অত বই একসঙ্গে রাখার জায়গা নেই বলেই তিন-তিনটি গ্রন্থাগার। নিজের রাজনৈতিক জীবন নিয়ে বই লেখা শুরু করেছেন। ভোটের জন্য সাময়িক বিরতি আছে। ভোট মিটলেই আবার লেখা শুরু করবেন।
অনুতপ্ত: নিজের একটি মন্তব্য নিয়ে এখনও অনুতাপ করেন। বামজমানায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে আক্রমণ করতে গিয়ে বলে ফেলেছিলেন, ‘‘ওঁর চুল কার্বাইড দিয়ে পাকানো!’’ নিজের সেই মন্তব্যের জন্য এখনও অনুতাপ রয়েছে। মনে করেন, ভুল বলেছিলেন। ওই মন্তব্য করা উচিত হয়নি।
বারুই থেকে ভবানী: পদবি বদল নয়। কেন্দ্র বদল। ১৯৯১ সালে প্রথমবার বারুইপুর কেন্দ্র থেকে বিধায়ক কংগ্রেসের প্রতীকে। ১৯৯৬ সালেও বারুইপুর থেকে জয়ী। কিন্তু ১৯৯৮ সালে তৃণমূল গঠনের সময় দলবদল। ওই বছর মারা যান রাসবিহারীর কংগ্রেস বিধায়ক হৈমী বসু। বারুইপুর থেকে পদত্যাগ করে রাসবিহারীর উপনির্বাচনে প্রার্থী হয়ে জয়ী। ১৯৯৮, ২০০১,২০০৬, ২০১১ এবং ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে ধারাবাহিক জয় রাসবিহারী থেকেই। ২০২১ সালে নেত্রীর নির্দেশে প্রার্থী ভবানীপুরে।
ভবানীপুর চ্যালেঞ্জ: একটাই— নেত্রীর আস্থার মর্যাদা দেওয়া। সপ্তম দফায় তাঁর ভোট। তবু ঢিলেমি নেই। নিয়ম করে দু’বেলা প্রচারে যাচ্ছেন নতুন প্রার্থীর ঢঙেই। ভবানীপুরের আদি বাসিন্দা হয়েও। বলছেন, ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের নিরিখে ভবানীপুর বিধানসভার আটটি ওয়ার্ডের মধ্যে ছ’টিতেই পিছিয়ে তৃণমূল। শোভনদেব চান আটটি ওয়ার্ডেই জিতে নেত্রীকে ভবানীপুর উপহার দিতে।
তথ্যসূত্র: অমিত রায়, রেখাচিত্র: সুমন চৌধুরী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy