ভোটবাবা: ভোটগুরু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু ভোটবাবা দুলাল দাস। ভোটের যাবতীয় পরামর্শ দিচ্ছেন রত্নার বাবা মহেশতলার বিধায়ক দুলাল। বাবা-মেয়ে দু’জনেই তৃণমূলের প্রার্থী। ১০ এপ্রিল একসঙ্গেই ভোট মেয়ের বেহালা পূর্ব এবং বাবার মহেশতলা আসনে। সাহায্য করতে কর্মী-কাউন্সিলররাই যথেষ্ট। কিন্তু বড়সড় সমস্যা হলে বাবা মুশকিল আসান।
বেহালা নিজের বৌদি নয়, দিদিকে চায়: শোভন চট্টোপাধ্যায়ের ছেড়ে যাওয়া ১৩১ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্ব নেওয়ার সময় থেকেই তিনি আর বৌদি নন। ওয়ার্ডের কর্মী-সমর্থকদের কাছে তখন তিনি দিদি। এখন প্রচারে নেমে সার্বজনীন দিদি। ইমেজ বদলানোয় আপত্তি নেই। কিন্তু আসল দিদির আস্থার মর্যাদা দিয়ে ভোটে জিততে চান।
শাড়ি, স্যরি: প্রার্থী হিসেবে নাম ঘোষণার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন শাড়ি পরেই প্রচার করবেন। কিন্তু সকাল ৭টা থেকে রাত পর্যন্ত প্রচারে শাড়ি সামলানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তাড়াহুড়োর চোটে শাড়ি বাদ দিয়ে সালোয়ার-কামিজ পরেই প্রচারে বেরিয়ে পড়ছেন।
জয় হনুমান: বড় ভরসার জায়গা হনুমান’জি। মনোনয়ন দাখিল থেকে প্রচার— সবেতেই পবনপুত্রের শরণাপন্ন। শোভন-জায়ার বিশ্বাস— ভোটযুদ্ধে সঙ্কটমোচন করবেন তাঁর ইষ্টদেবতা। হনুমান’জির সঙ্গে মহাদেবের পুজোতেও মনের শক্তি পান। বেহালা পূর্ব কেন্দ্রে মন্দিরের ছড়াছড়ি। প্রচারে মন্দির দেখলেই ভক্তিভরে প্রণাম। সঙ্গে প্রতিশ্রুতি— জিতলে মন্দিরের আরও শ্রীবৃদ্ধি করবেন। প্রচার শুরুও করেছিলেন ১১৫ নম্বর ওয়ার্ডে সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে পুজো দিয়েই।
আইতে শাল, যাইতে শাল: বাপের বাড়ি ঘোর বাঙালি। আদি নিবাস বাংলাদেশের বরিশাল। ফলে খেতে এবং খাওয়াতে ভালবাসেন। একটা সময়ে হোটেল-রেস্তরাঁয় খাওয়া ছিল প্রথম পছন্দ। কিন্তু এখন জীবন বদলে গিয়েছে। গত কয়েক বছর ঘরের রান্নাই অমৃতসমান। এখন প্রিয় ভাত, ডাল, মাছের ঝোল আর অবশ্যই আলু পোস্ত। শোভনের পরিবার খাঁটি এদেশী।১৯৯৫ সালের ৯ ডিসেম্বর শোভনের সঙ্গে বিয়ে। দাস থেকে চট্টোপাধ্যায়। শ্বশুরবাড়ি এসেই আলু-পোস্তর সঙ্গে প্রেম। জীবনে শোভন আর নেই। কিন্তু আলু-পোস্ত আছে।
ভুলভুলাইয়া: জীবনস্মৃতির খাতা উল্টে বলেন, ‘‘বড় ভুলোমন ছিল শোভনের। কোনও কোনও সময় ঋষি কোনও ক্লাসে পড়ে, তা-ই ভুলে যেত। আবার কখনও মেয়ের ভাল নাম মনে থাকত না ওর।’’ আরও বলেন, ‘‘ঋষির জন্মদিন ১৯৯৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর। তখনও তৃণমূল হয়নি। ওইদিন কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাদিবস। সকাল সকাল বেরিয়েছিল শোভন। রত্নার অবস্থা দেখে শোভনের পরিবারের সঙ্গে রত্নার মা-বাবাও হন্যে হয়ে খুঁজতে শুরু করেন শোভনকে। কিন্তু শোভন তো ততক্ষণে সন্তানসম্ভবা স্ত্রী-র কথা ভুলেই মেরে দিয়েছেন! তখন সবে পেজারের যুগ শুরু। পেজারেই মেসেজ পাঠিয়েছিলেন শাশুড়ি কস্তুরী দাস। বার্তা যখন পৌঁছল, তখন শোভন বেহালা চৌরাস্তায় বক্তৃতা করছেন। বক্তৃতা শেষে নজর গেল পেজারে। মেসেজ দেখেই ছুট হাসপাতালে। ততক্ষণে ভূমিষ্ঠ হয়ে গিয়েছে পুত্র ঋষি। কিন্তু দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না।
গোয়েন্দাগিন্নি: গোয়েন্দাগিন্নিই বটে। শোভনের সঙ্গে বিয়ের দিন থেকে তাঁর বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া। দিনক্ষণ থেকে সময়— সবকিছুই কণ্ঠস্থ। প্রায় সাড়ে তিন বছর হয়ে গেল, শোভন বেহালার বাড়ি ছেড়ে গোলপার্কের বহুতলের বাসিন্দা। বিবাহবিচ্ছেদের মামলা চলছে। কিন্তু রত্না খবর রাখেন বিচ্ছিন্ন স্বামীর প্রতিটি পদক্ষেপের। একসুরে বলে গেলেন, ‘‘সারারাত নেটফ্লিক্সে সিনেমা দেখে। ভোরের দিকে ঘুমোতে যায়। দুপুর দুটোয় উঠে স্নান করে ব্রেকফাস্ট। আবার ঘুম দিয়ে বিকেল ৫টায় লাঞ্চ করে।’’
কোনা এক্সপ্রেস: সকাল সকাল বেহালা পশ্চিমের মহারানি ইন্দিরা দেবী রোডের বাড়ি থেকে স্করপিও চেপে বেহালা পূর্বের প্রচারস্থলে। সকাল ৭টা থেকে রাত ১১টা। কখনও কখনও রাত ১২টাও বেজে যাচ্ছে। বেহালা পূর্বের ১০ বছরের বিধায়ক ছিলেন শোভন। মেয়র, মন্ত্রী, জেলা সভাপতি— বিবিধ গুরুদায়িত্ব সামলেও নিজের নির্বাচনী কেন্দ্রের জন্য সময় দিতেন। গৃহত্যাগের পর তিন বছর বেহালা পূর্বের মানুষের কাছে আসেননি। একথা মনে আছে রত্নার। তাই কেন্দ্রের কোনায় কোনায় যাচ্ছেন।
হন্টন বন্টন: প্রচারের জন্য দলের তরফে একটি জিপের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। কিন্তু জিপে উঠে জনতার উদ্দেশে ফুল-ফুল হাত নেড়ে প্রচার না-পসন্দ রাজনীতিক পরিবার থেকে উঠে আসা রত্নার। ফলে পদব্রজেই বেহালা পূর্ব চষছেন। কর্মীরা অনেকেই বিস্মিত। কিন্তু রত্নার পায়ে হেঁটে প্রচারের কাছে হার মানছেন তাঁরাও।
মহারাজ-যুবরাজ: প্রিয় খেলা ক্রিকেট। ক্রিকেট ছাড়া আর কোনও খেলাই বোঝেন না। সবসময় সোজা ব্যাটে খেলায় বিশ্বাসী। হয় বল মাঠের বাইরে। নয় বোল্ড। মহারাজ অধিনায়ক থাকার সময় বেহালাবাসী হিসেবে নিয়মিত ক্রিকেট দেখতেন। কিন্তু পছন্দের ক্রিকেটার ছিলেন যুবরাজ। তবে মহারাজের রাজ্যপাট যাওয়ার পর ক্রিকেট খেলা দেখার পাটও চুকিয়ে দিয়েছেন। শোভন থাকাকালীন দু’একবার ইডেনে আইপিএল দেখতে গিয়েছেন বটে। এখন আর সেসব বালাই নেই।
এলাম তোমার কোলে: ১৩১ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়ার পর থেকেই নেত্রী হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু মায়ের দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকেননি। এখন বৃহৎ অঞ্চলের দায়িত্ব নেওয়ার সময় পুত্র ঋষি মায়ের সঙ্গী। মা নেটমাধ্যমে অত সড়গড় নন। তাই সেই দায়িত্ব সামলাচ্ছেন শোভনপুত্র। ভোটের খরচের হিসেবনিকেশ তিনিই সামলাচ্ছেন তাঁর মোবাইলের ক্যালকুলেটারে। দ্বাদশ শ্রেণিতে পাঠরত কন্যা রুহি আবার মা ভোটে দাঁড়ানোর আনন্দেই মশগুল। তিনি মনে করেন, মা ভোটে দাঁড়িয়েছেন মানেই জিতে গিয়েছেন! শুনে হাসছেন রত্না।
মিলে সুর মেরা তুমহারা: বাইরে থাকলেও বাবা ও স্বামীর সঙ্গে রাজনীতির পাশাখেলা বাইরে থেকে দেখেছেন। দেখতে দেখতেই শিখেছেন। সেই বিদ্যেই কাজে লাগাচ্ছএন এখন। তৃণমূলে বেহালা পূর্ব কেন্দ্রে একাধিক দাবিদার ছিলেন। কিন্তু দিদি বেছেছেন রত্নাকে। বুথ স্তরে কর্মীদের দ্বন্দ্ব রুখতে রত্না দায়িত্ব বন্টন করছেন স্থানীয় রাজনীতির সমীকরণ বুঝে। দশে মিলি করি কাজ, হারি-জিতি নাহি লাজ।
কথা ও কাহিনি: অল্পবয়সে গোয়েন্দা কাহিনি, উপন্যাস পড়ার দিকে ঝোঁক ছিল। কিন্তু এখন অবসরে পড়েন আধ্যাত্মিক গ্রন্থ ও জীবনী। জীবনের কঠিন পথ চলতে জীবনীগ্রন্থই অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। আধ্যাত্মিক বই পড়ে কেটে গিয়েছে মৃত্যুভয়।
তথ্য: অমিত রায়, রেখাচিত্র: সুমন চৌধুরী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy