চক্রবর্তী কলিং চক্রবর্তী: উত্তর ২৪ পরগনার শিল্পাঞ্চলে কঠিন লড়াই তাঁর। জীবন শুরু করেছিলেন যেখানে, সেখানেই ফিরে গিয়েছেন জীবনের প্রথম ভোটযুদ্ধ লড়তে। জীবন শুরু হয়েছিল নৈহাটির হালিশহরে। সক্রিয় রাজনীতিকের জীবন শুরু হল তার অদূরে ব্যারাকপুরে। মূল প্রতিপক্ষ বিজেপি। কিন্তু সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থীও আছেন ময়দানে। ফলে বাইপাসের উপকণ্ঠে বহুতল আবাসনের ফ্ল্যাটে অভিনেত্রী স্ত্রী শুভশ্রী, মা এবং সদ্যোজাত সন্তানকে রেখে গত প্রায় এক মাস ধরে চক্রবর্তীপাড়ায় বাসা বেঁধেছেন। চক্রবর্তীপাড়ায় ফিরেছেন চক্রবর্তী রাজ। তবে স্বামীর হয়ে প্রচারে গিয়েছিলেন শুভশ্রীও।
মোমের পুতুল: মা আর স্ত্রী-র সম্পর্ক নিয়ে গর্বিত রাজ। মায়ের কাছে তাঁর স্ত্রী ‘মোমের পুতুল’। তাই শুভশ্রী কখনও রান্নাঘরে ঢুকলেই মা ছুট্টে যান! বউমাকে কোনও কাজ করতে দেবেন না শাশুড়িমা। একেবারে মেয়ের আদরে রেখেছেন।
লৌহমানবী: তবে রাজের শাশুড়ি, শুভশ্রীর মা-ও কম যান না। তাঁর সঙ্গে অবশ্য মোমের সম্পর্ক নেই। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর হামলার প্রতিবাদে বর্ধমানের বাজেপ্রতাপপুরে পথ অবরোধ করেছিলেন তৃণমূল সমর্থকরা। সেই কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছিলেন শুভশ্রীর মা বীণা এবং বাবা দেবপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়। লৌহমানবী বীণা নিশ্চিত— জীবনের প্রথম বিধানসভা ভোটে জামাইয়ের কপালে জয়তিলক আঁকা হবেই।
মিরাক্ল: এখন পরিচালক। হিট পরিচালকও বটে। কিন্তু ছবি পরিচালনার আগে জনপ্রিয় শো ‘মীরাক্কেল’-এ ক্যামেরার পিছনে কাজ করতেন। সাফল্য নিজের চোখে দেখার পর নিজে ধারাবাহিক পরিচালনায় আসেন। রাজের পরিচালিত বিভিন্ন ধারাবাহিকের মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় হয়েছিল ২০১১ সালের ‘প্রলয় আসছে’। কড়া পরিশ্রম করে নিজস্ব পরিচিতি তৈরি করেছেন।
চিরদিনই: পরিচালক রাজের প্রথম ছবি ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’। সে ছবি ভাল ব্যবসা করেছিল। তার পরেই বড় প্রযোজকের নজরে পড়েন তিনি। সেখান থেকেই রাজের টলিউড যাত্রা শুরু। এবং সাফল্য। হালিশহরে জীবন শুরু করা রাজ এখন বিএমডব্লু চড়েন। বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে থাকেন। চিরদিনই পরিশ্রমে বিশ্বাস করেন। জীবন তাঁকে দু’হাত তার উপহার দিয়েছে।
দু’টি দিকে গেছে বেঁকে: লড়াইয়ের দিনগুলোয় অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষের সঙ্গে একই ঘরে থাকতেন রাজ। দু’জনেই তখন ইন্ডাস্ট্রিতে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে সমান্তরাল পথে দৌড়োচ্ছেন। স্ট্রাগ্ল করে যে যাঁর মতো প্রতিষ্ঠিতও হয়েছেন। অনেক বছর পর আবার তাঁদের দৌড় শুরু হয়েছে। রাজনীতির ক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার দৌড়। রাজ লড়ছেন তৃণমূলের হয়ে। বন্ধু রুদ্রনীল বিপক্ষের বিজেপি শিবিরে। তফাত একটাই— একই ঘরে থেকে আর সেই লড়াই হচ্ছে না। লক্ষ্য জয় থাকলেও এখন তাঁর পরস্পরের বিরোধী শিবিরে। লড়াই শুরুর দিনে দুই বন্ধু দিনের শেষে ফিরে দু’জনের সাফল্য কামনা করতেন হয়তো। এত বছর পর তাঁরা জানেন, একের জয় আসবে অন্যের পরাজয়ে। দু’জনার দু’টি পথ দু’টি দিকে গেছে বেঁকে।
তেলুগু বিড্ডা: বাজারে রাজের অধিকাংশ ছবিই ভাল ব্যবসা করেছে। তা-ও নিন্দকেরা কটাক্ষ করতে ছাড়েনি। বারবারই বলা হয়েছে, দেশ এবং বিদেশের ছবি থেকে নকল করার প্রবণতা রয়েছে পরিচালক রাজের। তিনি নাকি মৌলিক ছবি বানাতেই পারেন না! কারণ, তিনি মৌলিক গল্প থেকে ছবি বানানোর ঝুঁকি নিতে চান না। শিওর সাকসেস ফর্মূলাতেই বেশি বিশ্বাস রাখতে চান। বস্তুত, তাঁর ‘হিতৈষী’রা এমনও বলে থাকেন যে, শ্যুটিংয়ের সময় বিভিন্ন হিট তেলুগু ছবি মনিটরে চালিয়ে রেখে ফ্রেম দেখে নিজের ছবির ফ্রেম ঠিক করেন রাজ। তিনি বাংলার ভোটে দাঁড়ানোর পর যাঁরা রসিকতা করে বলছেন, ‘‘রাজ তো দক্ষিণ ভারতেও ভোটে দাঁড়াতে পারে! ওর তো তেলুগু ভাষাটা জলের মতো আসে।’’ রাজ অবশ্য কোনওদিনই এসব কথায় গুরুত্ব দেন না। এখনও দিচ্ছেন না। বরাবর মনে করে এসেছেন এবং বলে এসেছেন, ‘‘বিনোদনটাই আসল!’’
কণ্ঠ ছাড়ো জোরে: ছোটবেলায় শান্ত এবং আবেগপ্রবণ ছিলেন। এখন তিনি অনেকটাই বাস্তববাদী। জীবন তাঁকে শিক্ষা দিয়েছে। বাস্তবের কঠিন শিক্ষা। যে বাস্তব তাঁকে বুঝিয়েছিল, পরিচালক হতে গেলে গলার মিনমিনে স্বরে কাজ দেবে না। একটা গোটা ছবির ইউনিটকে দায়িত্ব নিয়ে চালাতে গেলে গলায় ওজন আনতে হবে। গাম্ভীর্য আনতে হবে। দাপট আনতে হবে। গলা ভারিক্কি করতে একটা সময়ে নিয়মিত রেওয়াজ করেছেন। এমন নয় যে, তাতে কণ্ঠ একেবারে অমিতাভ বচ্চনের মতো ব্যারিটোন হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ওজনদার তো হয়েইছে।
রাজ-নীতি: দিদির সমর্থক তিনি বহুদিনের। একুশে জুলাইয়ের সভামঞ্চে তাঁকে দেখা গিয়েছে। দিদির আশীর্বাদের বরহস্ত তাঁর মাথায় সবসময় থেকেছে। যে বলে বলীয়ান হয়ে কলকাতা আন্তর্জাতিক ফিল্মোৎসবের চেয়ারম্যান হওয়ার মতো গুরুদায়িত্ব পেয়েও সামলে দিয়েছেন। বড়দের কাছে গিয়ে, ছোটদেবর ভালবেসে, সময়বয়সীদের কাঁধে হাত রেখে একসঙ্গে কাজ করতে এবং করিয়ে নিতে পেরেছেন। তিনি চলচ্চিত্র উৎসব কমিটির চেয়ারম্যান হওয়ায় অনেকেই নাক সিঁটকেছিলেন। তাঁরাও কিন্তু উৎসবের পর মেনে নিয়েছেন, রাজের রাজত্ব খুব একটা টাল খায়নি। এর পর বিধানসভা ভোটে দাঁড়ানোটা বোধহয় ভবিতব্যই ছিল। মার্চ মাসে আনুষ্ঠানিক ভাবে তৃণমূলে যোগদান এবং ভোট ময়দানে আবির্ভাব। এই য়ুদ্ধ তাঁর কাছে ধর্মযুদ্ধ তো বটেই। নিজেকে প্রমাণের। দিদির সিদ্ধান্তকে ঠিক প্রমাণ করারও বটে।
সফেদি কি চমকার: প্রচারের সময়ে ঢিলেঢালা সাদা পাজামা ও পাঞ্জাবি পরছেন। কারণ, সাদা পরলে গরম কম লাগে। সঙ্গে মাঝেমধ্যে গ্লুকন-ডি রাখছেন। ঘামতে ঘামতে শরীরের লবণ-চিনির পরিমাণ কমে গেলে তো বিপদ! রোজ সকালে একটু ফল আর পেট ভর্তি করে ডাবের জল খেয়ে প্রচারে বেরিয়ে পড়ছেন। দুপুরে একটা রুটি, ডাল, সবজি আর টক দই। রাতেও রিপিট টেলিকাস্ট— একটি রুটি, ডাল, সবজি আর টক দই। ভাষান্তরে, সাদা দই।
জিভে প্রেম: এখন শরীর-স্বাস্থ্যের কথা ভেবে খানিক কম খাওয়া অভ্যেস করেছেন। কিন্তু কে না জানে, বিরিয়ানি পেলে তাঁর জিভে জল আসে। মাছের পোকা বলে রাজকে কেউ কেউ আদর করে ‘বিড়াল’ বলেও ডাকেন।
শুভমস্তু: এখন রাজের জীবন তাঁর শুভ আর ইউভানকে নিয়ে ভরপুর। গত বছর করোনা কেড়ে নিয়েছে বাবাকে। আর তাঁদের যৌথ জীবনে এসেছে ইউভান। সম্প্রতি হালিশহরের বাড়িতে পুত্রের অন্নপ্রাশন করেছেন রাজ-শুভশ্রী।
সতীর পুণ্যে পতির পুণ্য: এখন অপেক্ষা ২২ এপ্রিলের। ওইদিনই ভোট ব্যারাকপুরে। শুভশ্রী অবশ্য ভয় পাচ্ছেন না। প্রচারে গিয়েছেন। ছ’মাসের পুত্রসন্তানকে সময় দেওয়া, সাংসার গোছানো, নিজস্ব কর্মক্ষেত্র সামলেও গিয়েছেন। শুভশ্রীর দৃঢ় বিশ্বাস— তাঁর স্বামীই জিতবেন। তাঁর আত্মবিশ্বাসে বাড়তি ভরসা পাচ্ছেন রাজও।
তথ্য: স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়, রেখাচিত্র: সুমন চৌধুরী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy