Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
Tollywood

Bengal Polls: দেশের রাজনীতি ও আইন দেখে মনে হচ্ছে এ বার এই সভ্যতা মৃত্যুবরণ করুক

সব সভ্যতার একটা শেষ থাকে। সেই সময়টায় পৌঁছে গিয়েছি। ‘বিগ ব্যাং’–এর মতো কিছু একটা ঘটুক। আর সবটা শেষ হয়ে যাক।

‘‘দল যা শেখায়, এঁরা তাই বলেন। নিজস্ব কোনও ভাবনাচিন্তা নেই এঁদের।’’

‘‘দল যা শেখায়, এঁরা তাই বলেন। নিজস্ব কোনও ভাবনাচিন্তা নেই এঁদের।’’

ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়
ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০২১ ২১:২৯
Share: Save:

এই যে সময়টার মধ্যে আমরা বাস করছি, সেটিকে কেবল একটি মাত্র শব্দ দিয়ে বোঝাতে হলে আমার মাথায় একটি ইংরেজি শব্দ আসছে। তা হল, ‘ডিসইলিউশনমেন্ট’। অর্থাৎ যেই মোহটা তৈরি করা হয়েছিল, তা ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া। আর তাই হয়েছে।

আমার বয়স এখন ২১। ছোট থেকে বাবার সূত্রে বহু মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি। তাঁদের মধ্যে বহু গুণী, শিক্ষিত মানুষের কাছ থেকে রাজনীতির রূপ-রস-গন্ধের আভাস পেয়ে বড় হয়েছি। আজ যখন তাঁদেরই দেখি যে নিজেদের রাজনীতি থেকে সরে যাচ্ছেন বা কথা রাখছেন না, তখন বড্ড কষ্ট হয়। মনে হয়, তা হলে কি আমি ভুল বুঝেছিলাম নাকি আমাকে ভুল বোঝানো হয়েছিল?

বিশেষ করে যাঁদের কথা আমি বলতে চাইছি, সেই তালিকায় কিন্তু রাজনৈতিক কর্মীরা নেই। ধরা যাক, বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ এমন বিভিন্ন মন্তব্য করেন, যা ভয়ঙ্কর। কিন্তু আমি এই মানুষগুলোকে নিয়ে একটুও ভাবিত নই। এঁরা জনসাধারণকে উস্কে দেওয়ার জন্যই টাকা পান। এক বার একটি মিছিলে অংশগ্রহণ করেছিলাম। শুনতে পেয়েছিলাম যে দিলীপ ঘোষ আমাদের উদ্দেশ্য করে বলছেন, ‘‘এখানে আসুক না, মেরে স্ট্রেচারে করে বাড়ি পাঠিয়ে দেব।’’ আমি হলফ করে বলতে পারি, এক বিন্দু রাগ হয়নি আমার। দল যা শেখায়, এঁরা তাই বলেন। নিজস্ব কোনও ভাবনাচিন্তা নেই এঁদের।

কিন্তু যাঁদের উপর আশা রেখেছিলাম, তাঁদের ধ্যানধারণা পালটে গেলে তখনই ‘ডিসইলিউশনমেন্ট’ তৈরি হয়।

আমার মনে আছে, আরএসএস-এর এক কর্মী সে সময়ে বলেছিলেন, ‘‘একটু মার খেয়েছে তো কী হয়েছে!’’

আমার মনে আছে, আরএসএস-এর এক কর্মী সে সময়ে বলেছিলেন, ‘‘একটু মার খেয়েছে তো কী হয়েছে!’’

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু মুখোশধারী ব্যক্তি এসে মারধর করে পড়ুয়াদের উপর। মুখে রুমাল বাঁধা গুণ্ডাদের অত্যাচারে কেউ শারীরিক ভাবে বিধ্বস্ত, কেউ আবার মানসিক ভাবে। মনুষ্যত্ব বলে কিছু থেকে থাকলে তখন একটাই কথা মাথায় আসবে, ‘পড়ুয়ারা যেন তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠেন’। আমার মনে আছে, আরএসএস-এর এক কর্মী সে সময়ে বলেছিলেন, ‘‘একটু মার খেয়েছে তো কী হয়েছে! আর আমাদের দিকে আঙুল তোলার আগে দেখতে হবে, যারা মেরেছে তারা আদৌ আমাদের লোক কিনা।’’ অবাক লাগে, তাঁর সন্তানসম ছাত্রছাত্রীরা ব্যথায় কাতরাচ্ছেন, আর তিনি তখন হিসেব করছেন কে তাঁর দলের আর কে নন। এঁদেরকে আমি আর মানুষের পর্যায়ে ফেলতে পারি না। এঁরা কীট! আমার সামনে যদি আজ এক ব্যক্তির মাথা ফেটে যায় এবং সে যদি আমাদের বিরোধী মতবাদের মানু্ষ হয়ে থাকে, তাতেও আমি আগে তাকে সাহায্য করব, সুস্থ করে তুলব, তার পর তার সঙ্গে তর্ক করব। সেই রিফ্লেক্সটুকুও নেই এই মানুষগুলোর।

‘‘আমার নিজস্ব রাজনীতি রয়েছে, যা কোনও দলের সঙ্গেই হুবহু মেলে না।’’

‘‘আমার নিজস্ব রাজনীতি রয়েছে, যা কোনও দলের সঙ্গেই হুবহু মেলে না।’’

বাংলার নির্বাচনের প্রসঙ্গে আসা যাক এ বারে। আমি কোনও দলীয় রাজনীতি করি না। আমার নিজস্ব রাজনীতি রয়েছে, যা কোনও দলের সঙ্গেই হুবহু মেলে না। তাই নির্দিষ্ট কাউকে অন্ধ ‌ভাবে বিশ্বাস করতে পারি না। কিন্তু কে একেবারে‌ই বিশ্বাসযোগ্য নয়, সেটুকু বুঝতে পারি। আর সেখান থেকেই বিজেপি-র রাজনীতি নিয়ে আমার সমস্যা রয়েছে। এই মুহূর্তে যাঁরা বিজেপি-তে যোগদান করছেন বা অন্য কোনও দল ছেড়ে বিজেপি-তে যাচ্ছেন, তাঁদের সবা‌ইকে বলতে শুনছি, ‘‘বাংলার দু্র্নীতির মধ্যে কাজ করতে পারছি না।’’ আমার এখানেই প্রশ্ন, নির্বাচনের আগে দুর্নীতি ছিল না? তখন দল পরিবর্তন করলেন না কেন? এই সিদ্ধান্ত কি নিজের আখের গোছানোর জন্য নয় তবে? শুধু তাই নয়, তাঁদের কথায় মনে হচ্ছে, ৪ বছর আগে সেখানে দু্র্নীতি ছিল না। বিষয়টা অনেকটা এ রকম, জেনে শুনে একটা দু্র্নীতি থেকে আর একটা দু্র্নীতির দিকে যাওয়া। আমি যদি আমার কর্মক্ষেত্রের কথা বলি, বেশ কয়েকটা নাট্যদলের কর্মীরা সম্প্রতি বিজেপি-তে নাম লিখিয়েছেন। তাঁদেরও একই কথা।

যাঁরা ‘মানুষের জন্য কাজ’ করবেন বলে দল বদল করছেন বা দলে যোগ দিচ্ছেন, তাঁদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য কেবল মাত্র একটি জায়গাতেই। আমরাও একাধিক নাট্যদলের কর্মীদের রোজগার থেকে শুরু করে পেট চালানোর ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু গর্বের সঙ্গে সেগুলো জাহির করার প্রয়োজন বোধ করিনি। কারণটা বোধ হয় খুব সহজ, আমরা মনে করি, এটা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের দায়িত্ব। আর সেই মানুষগুলি মনে করেন, এটা তাঁদের স্বার্থে লাগবে। তাই করার আগেই প্রায় চিৎকার করে বলে দেওয়াটা দরকার পড়ে তাঁদের।

নেটমাধ্যমে বিজেপি বিরোধী যদি কোনও পোস্ট করি, ইন্ডাস্ট্রিতে যাঁরা সেই দলের সদস্য, তাঁরা এসে সরাসরি হুমকি দেন। কখনও কখনও হয়তো মজার ছলেই বলেন, কিন্তু বলেন। যেমন ধরা যাক, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার সময়ে মেকআপ রুমে বসে বলা হচ্ছে, ‘‘যা হয়েছে বেশ হয়েছে।’’ এ ছাড়া আর এক দল শিল্পী রয়েছেন, যাঁদের কোনও বিষয়ে প্রশ্ন করলে, ঠিক দু’কথায় উত্তর দেওয়ার কাজ সেরে ফেলেন। কেউ বলেন, ‘‘আমি তো এ বিষয়ে কিছুই জানি না। তাই না বলাই ভাল।’’ কেউ বলেন, ‘‘আমি অরাজনৈতিক।’’ কেউ আবার আর একটু মুখ খোলেন, ‘‘এটা খারাপ। এ রকমটা না হওয়াই ভাল।’’ ব্যস, কিন্তু তাঁরা বোঝেন না যে এক জন শিল্পীর সব থেকে প্রয়োজনীয় কাজ হল চোখ-কান খোলা রেখে ঠিক-ভুলটা বোঝা। তা নিয়ে কথা বলা। আর এই গোছের মানুষের জন্য আমরা আজ এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছি। এঁদের দেখেই আমি প্রতিশ্রুতি নিয়েছি ছোট থেকে। নিজেকে বুঝিয়েছি, আর যাই হোক, বড় হয়ে এঁদের মতো নির্বাক ভূমিকায় অভিনয় করব না।

‘‘আমি জানতে চাই, এই বয়সের ছেলেমেয়েরা যদি ধর্ম নিয়ে রাজনীতির বিষয়ে প্রশ্ন না করে, তবে তারা কী করে?’’ 

‘‘আমি জানতে চাই, এই বয়সের ছেলেমেয়েরা যদি ধর্ম নিয়ে রাজনীতির বিষয়ে প্রশ্ন না করে, তবে তারা কী করে?’’ 

নাটক ও চলচ্চিত্র জগতের কথা বললে আমি দর্শকদের দিকেও আঙুল তুলব। যে ভাবে একটি মঞ্চাভিনয়ের আগে অভিনেতাদের প্রস্তুত হয়ে হয়, তেমনই আমাদের দেশের দর্শকেরও একটা পরিশ্রম থাকা উচিত। কী ভাবে ভাল দর্শক হওয়া যায়, সেই অনুশীলনটার প্রয়োজন সকলেরই।

আমার ভয় একটাই, এখনকার যুব সমাজের ভবিষ্যৎটা ঠিক কোন দিকে যাচ্ছে বুঝতে পারছি না। আমিও এঁদেরই এক জন। তাই সমস্যাটা আরও টের পাচ্ছি। আমাদের দেশের ১৮ থেকে ২৬ বছরের ছেলেমেয়েরা রাজনীতি নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবিত নয়। তারা কেবল নিজেদের ফোনে গোলাগুলি করতে ব্যস্ত। কেউ কেউ টিকটক ছেড়ে ইনস্টাগ্রাম রিলে মন দিয়েছে। এই বয়সটাই একটা মানুষের মানসিকতা তৈরি হওয়ার সময়। কিছু পুরনো শিক্ষাকে ভোলার সময়। নতুন কিছু শেখার সময়। ভাবা প্র্যাক্টিস করার সময়। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায়, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের পরে সাংবাদিক অর্ণব গোস্বামী তাঁর চ্যানেলে চিৎকার করে গর্বের সঙ্গে বলছিলেন, ‘‘আমাদের দেশের ১৮ থেকে ২৬ বছর বয়সের মানুষ রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামায় না। তারা কেবল এটাই দেখে যে, উন্নয়ন হয়েছে কিনা।’’ আমি জানতে চাই, এই বয়সের ছেলেমেয়েরা যদি ধর্ম নিয়ে রাজনীতির বিষয়ে প্রশ্ন না করে, তবে তারা কী করে? তারা কী ভাবে? কোন ছবি দেখে? কোন নাটক দেখে? কোন গান শোনে? কোন সাহিত্য পড়ে তারা? আমার তো মনে হয়, তারা এই না-জানাটাকে ভালবাসে। আর একের পর এক রাজনৈতিক দল এসে এই বয়সের মানুষগুলোকে শোষণ করে যাবে। আর তারা টেরও পাবে না।

আমি আমার ভাবনাচিন্তার একটা সময়রেখা তৈরি করতে চাই। নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, সে দিন থেকে আমি সব আশা ছেড়ে দিয়েছি যে দিন বম্বে হাইকোর্ট যৌন হেনস্থা নিয়ে ভয়াবহ রায়টা শোনাল। একটি ১২ বছরের মেয়ে যৌন হেনস্থার শিকার হল, কিন্তু যেহেতু সে জামা পরেছিল, তাই সেই ঘটনাটিকে নাকি আমরা ‘যৌন হেনস্থা’ বলতে পারব না। ঠিক সেই দিন থেকে আমার মনে হচ্ছে, ভারতবর্ষের সভ্যতা একেবারে খাদের কিনারে এসে গিয়েছে। এখান থেকে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করা ছাড়া এই সভ্যতার আর কোনও পথ নেই। সব সভ্যতার একটা শেষ থাকে। সেই সময়টায় পৌঁছে গিয়েছি। ‘বিগ ব্যাং’–এর মতো কিছু একটা ঘটুক। আর সবটা শেষ হয়ে যাক। আমার বোনের বয়সও ঠিক ১২। আমার এখন ভয় লাগে। ও যদি এ রকম কোনও পরিস্থিতিতে পড়ে, আমরা তখন কার সঙ্গে লড়াই করব? কার কাছে বিচারের জন্য আর্জি জানাব? কারণ এ দেশের আইন তো মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE