মোগল সম্রাট আকবর
ভোটযুদ্ধের টানােহঁচড়ায় নানা ভাগে বিভক্ত বাঙালি! অতিমারির নতুন ঢেউয়েও তটস্থ। সব মিলিয়ে ১৪২৭-এর গোড়ার মতোই করুণ ১৪২৮-এর শুরুটাও।
পয়লা বৈশাখ তবু আয়নার মুখোমুখি দাঁড় করায়! করোনার জেরে লকডাউনে বুধবার ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ বন্ধ ছিল বাংলাদেশে। এই বঙ্গের এক দিন আগে নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ সেখানে নিচু তারেই বাঁধা। এ রাজ্যে আবার নতুন বছরকে নিয়ে কাটাছেঁড়ায় ঘুরপাক খাচ্ছে ভিন্নতর প্রশ্ন। আকাশের গায়ে টক টক গন্ধ না-ও থাকতে পারে! বছরের গায়ে কেউ কেউ ঠিক ধর্মের গন্ধ পাচ্ছেন! সমাজমাধ্যম তোলপাড়, পয়লা বৈশাখের প্রাক্কালে মঙ্গলবার বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষই সবাইকে ‘হিন্দু নববর্ষে’র শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
পয়লা বৈশাখে কারও কারও দক্ষিণেশ্বরে বা কালীঘাটে যাওয়ার অভ্যেস আছে। কেউ কেউ আবার যানও না। কিন্তু দোকানে হালখাতার পুজো, ময়দানের বড় ক্লাবের বার পুজো বা বইপাড়ার আড্ডার পেটপুজো নিয়ে আদতে বাঙালি পরিচয়েই দিনটার মহিমা। বাংলাদেশেও মৌলবাদীদের চোখরাঙানির বিরুদ্ধে ধর্মের ঊর্ধ্বে বাঙালি সত্তার প্রতীক হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত পয়লা বৈশাখ। অনেকেরই মত, এখানেও পয়লা বৈশাখ উদ্যাপনের নেপথ্যে বাংলাদেশ বা মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব রয়েছে।
দিলীপবাবুর রকমারি মন্তব্যে ইদানীং আকছার চমৎকৃত হয় বাঙালি! প্রশ্ন উঠছে, বঙ্গাব্দে ‘হিন্দু’ গন্ধটা তিনি পেলেন কোথায়? বাঙালির সঙ্গে তার সম্পর্কই বা কী? কারণ, ভাষাবিদদের মতে নববর্ষের ‘হালখাতা’ শব্দও আবার ফার্সি থেকেই আহৃত। মধ্যযুগ তথা ইসলামি ইতিহাসের অধ্যাপক অমিত দে বলছেন, “পয়লা বৈশাখ জনপ্রিয় করার পিছনে সম্রাট আকবরেরই অবদান। এটা লক্ষণীয় তিনি মুসলিম হয়েও হিজরি সালের মতো অভিন্ন কোনও ক্যালেন্ডার দেশ জুড়ে চাপিয়ে দেননি। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতাতেই বঙ্গাব্দের পরিচিতি বেড়েছে।”
১৫৭৫ নাগাদ বাংলা দখল করেন আকবর। হিজরি বছরের চান্দ্র মাসের সময় পাল্টে পাল্টে যায়। তাতে ফসলের খাজনা আদায়ের সমস্যা। বঙ্গাব্দ সূর্যসিদ্ধান্ত মতে রাজা শশাঙ্কের আমলে চালু হয়েছিল। খাজনা আদায়ের দিনক্ষণ হিসেবে বৈশাখকেই বেছে নেন আকবর।
দেশভাগের পরের পূর্ব পাকিস্তানে আবার এই বঙ্গাব্দ ঘিরে বাঙালির অন্য সংগ্রামের ইতিহাস। “ভাষা আন্দোলনের হাত ধরে দ্বিজাতি তত্ত্বকে অস্বীকার করে বাঙালি মুসলিম তখন ঘরে ফিরছে। রবীন্দ্রনাথের মতো, পয়লা বৈশাখও তখন সেই লড়াইয়ের হাতিয়ার”, বলছিলেন রাজশাহি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক আবুল কাশেম। পাকিস্তানি রাষ্ট্রের সঙ্গে টক্কর দিয়ে রবীন্দ্র শতবর্ষ পালনের মতোই ১৯৬৭তে ঢাকায় রমনার বটমূলে ‘ছায়ানট’ প্রতিষ্ঠানের পয়লা বৈশাখ উদযাপনও বাংলাদেশের স্বাধিকারের লড়াইয়ে অবিস্মরণীয় বলে মনে করেন কাশেম সাহেব।
আবার বছরের এই সময়টা, ভারতের বহুত্ববাদ উদযাপনেরও মরসুম। সদ্য মহারাষ্ট্রের নববর্ষ গুঢ়ি পড়বা, বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদের উগাড়ি বা পঞ্জাবের বৈশাখী পার হয়েছে। বুধবার ছিল অসমের বিহু, কেরলের বিষু। কেউ কেউ অবশ্য মনে করছেন, হিন্দু নববর্ষ বলতে দিলীপবাবু উগাড়ির কথাও বলে থাকতে পারেন। তাঁর কেন্দ্র খড়্গপুরে তেলুগুভাষীও কম নয়। কিন্তু তা হলে ফেসবুকে নিখাদ বাংলায় হিন্দু নববর্ষের বার্তা দেবেন কেন? দিলীপবাবুর নিজেরই পাদটিকা, এ হল বিক্রম সম্বতের দিন (মঙ্গলবার)। বিক্রমাদিত্যের প্রবর্তিত বছর। পুরাণে, ইতিহাসে খুব গুরুত্বপূর্ণ দিন। কলিযুগাব্দের মতো এই সব সনগুনতিতেও ভারতই না কি দুনিয়ায় পথিকৃৎ। পুরাণ আর ইতিহাস গুলিয়ে ফেলা এই ব্যাখ্যায় বিরক্ত পুরাণবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি। তিনি বলছেন, “কলিযুগাব্দ কেন পাঁজিতে যুধিষ্ঠিরাব্দও মিলবে। আর এই রাজা বিক্রমাদিত্যর (গুপ্ত রাজা নন) সময়টাও ধোঁয়াটে! দিলীপবাবুরা দেখছি অকারণে মোগলদের সঙ্গে যুদ্ধে নেমেছেন। কিন্তু আকবর যাকে জনপ্রিয় করেছিলেন, সেই পয়লা বৈশাখ ছাড়া অন্য নববর্ষের সঙ্গে বাঙালির যোগ নেই।”
বিক্রম সম্বতের মতো দেওয়ালির পরে গুজরাতিদের নববর্ষকেও কেউ কেউ হিন্দু নববর্ষ বলেন। দিলীপবাবু অতীতে তখনও শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। প্রাক্তন সংস্কৃতি সচিব, প্রাবন্ধিক জহর সরকারেরও মত, “নববর্ষের গায়ে এই ধর্মের তকমা বসানোটা রাজনীতি। ইতিহাস অস্বীকার করা। সব কিছুতে হিন্দু সত্তাটি দাগিয়ে মেরুকরণের চেষ্টা।”
তাই হিন্দু নববর্ষের হয়ে সওয়াল সমাজমাধ্যমে আমবাঙালির কড়া সমালোচনার মুখে পড়েছে। কারও প্রশ্ন, মুসলিম মৌলবাদীদের মতো হিন্দুত্ববাদীদেরও কি তবে পয়লা বৈশাখ না-পসন্দ! নেতাদের কাণ্ড দেখে ১৪২৮এও রসিক বাঙালির হাতের পেনসিল তাই কবি সুকুমার! ‘দিনগুলোকে করলে মাটি মিথ্যে পাজি পঞ্জিকাতে, মুখ ধোব না ভাত খাব না ঘুম যাব না আজকে রাতে’!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy