নদীর গায়ে গায়ে চলতে থাকা ঢালাই করা রাস্তায় জ্বলজ্বল করছে আলো। যোগ্য সঙ্গত করছে সপ্তাহান্তের ছুটি কাটাতে আসা পর্যটকদের উপস্থিতি। ইছামতীর জল বলছে, ‘টাকিতে স্বাগত’।
বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রের অধীনে বসিরহাট (দক্ষিণ) কেন্দ্রের মধ্যে রয়েছে টাকি। সারা রাত রাস্তায় আলো জ্বলে। পর্যটকের ভিড় স্থানীয় এলাকার বহু যুবকের রোজগারের রাস্তা খুলে দিয়েছে। কেউ খাবারের দোকান চালান, কেউ টোটোয় চাপিয়ে পর্যটকদের আশপাশ ঘুরিয়ে দেখাতে নিয়ে যান। হাতে রোজগার এসেছে ধরে নিয়েই টোটোচালক রাজু তপাদারের কাছে প্রশ্ন ছিল, হাওয়া কোন দিকে?
উত্তরে হেঁয়ালি, ‘‘সামনেই নদী, তবুও যে গুমোট কমতেছে না। ঝড় আসতি পারে।’’
যেখানে টাকি পুরসভার একটি মাত্র অতিথিশালা ছিল, সেখানে পর্যটনে চোখে পড়ার মতো উন্নতি, চওড়া রাস্তা, কন্যাশ্রী-সবুজ সাথী থেকে শুরু করে দুয়ারে সরকার কিংবা স্বাস্থ্যসাথীর কার্ড, তার পরেও গুমোট?
কৌতূহল খানিক নিরসন করলেন চৌরঙ্গীর মোড়ে ওষুধের দোকানের মধ্যবয়স্ক মালিক। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক। বললেন, ‘‘যে আগে ভ্যান চালাত, সে এখন একাধিক হোটেল আর বাগানবাড়ির মালিক। জোর করে জমি-বাড়ি লিখিয়ে নেওয়া হচ্ছে। সরকারি প্রকল্প না পাওয়াদের তালিকা প্রাপকদের চেয়ে ছোট নয়। দিদি প্রকল্প পাঠিয়েছেন, ভাইয়েরা খেয়েছে।’’
গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি বসিরহাট কেন্দ্রে প্রায় ১৫ হাজার ভোটে পিছিয়ে ছিল। শতাংশ হারে সংখ্যালঘু ভোটও এই লোকসভা কেন্দ্রে সাধারণ ভোটারের প্রায় সমান। তা সত্ত্বেও উল্টো হাওয়া না কি ‘চাপ’ বাড়িয়ে চলেছে বসিরহাট (দক্ষিণ), হিঙ্গলগঞ্জ—এই দুই বিধানসভা কেন্দ্রে। সেই হাওয়ায় ধর্মীয় মেরুকরণও যে মিশেছে, টের পাওয়া গেল বসিরহাটের স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলেই। বসিরহাটের দুই বিধানসভা কেন্দ্র ছাড়াও হিঙ্গলগঞ্জ, মিনাখাঁর মতো জায়গায় বসবাসকারী পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশার কথাও চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে।
এলাকার খবর, শাসকদলের স্থানীয় নেতাদের দাপট ও দুর্নীতির অভিযোগের পাশাপাশি বসিরহাট (দক্ষিণ) কেন্দ্রের আগের বিধায়ক দীপেন্দু বিশ্বাসকে তৃণমূল টিকিট না দেওয়া, দলীয় প্রার্থী সপ্তর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে পছন্দ-অপছন্দের বাতাবরণও তৈরি হয়েছে। সপ্তর্ষির অবশ্য পাল্টা দাবি, ‘‘দীপেন্দুকে নিয়ে আবেগ ছিল। কিন্তু উনি বিজেপিতে চলে যাওয়ায় মানুষ আমাকে এখন আপন করে নিয়েছেন।’’
দেবী মোড়ে মুরগির মাংসের বিক্রেতা এক মহিলা হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘‘মেয়েটার বিয়ের জন্য অনেকগুলো টাকা জমিয়েছিলাম। চিটফান্ডে সব খেয়ে নিল।’’ বসিরহাটে এক সময়ে চিটফান্ডের বেশ কয়েক জন এজেন্ট আত্মহত্যা করেছিলেন। অনেকেই জানালেন, আমপানের দুর্নীতির আড়ালে চিটফান্ড কেলেঙ্কারিতে সর্বস্বান্ত হওয়ার ক্ষত নিম্নবিত্ত এলাকায় এখনও টাটকা। জানা গেল, চিটফান্ডের দুর্নীতিতে অভিযুক্ত স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের কেউ কেউ এখন বিজেপিতে। প্রচারে বেরনোর ফাঁকে বিজেপির বসিরহাট (দক্ষিণ) কেন্দ্রের প্রার্থী তথা বারাসত সাংগঠনিক জেলার সভাপতি তারকনাথ ঘোষ শুধু বললেন, ``মানুষকে আলাদা করে বোঝাতে হচ্ছে না। দুর্নীতি, সন্ত্রাস, পরিযায়ী শ্রমিকদের বেহাল দশার কথা প্রচারে মানুষই আমাকে বলছেন।``
দেবী মোড় ছাড়িয়ে বনবিবি সেতু পার করেই শুরু হিঙ্গলগঞ্জ। ঝাঁ চকচকে নীল-সাদা সেতু পেরিয়ে জোড়া বোলতলা গ্রামের মোড়। গ্রামের ভিতরে চলে গিয়েছে ঢালাই করা রাস্তা। জলকষ্টের সমাধানে বাড়ি বাড়ি জলের লাইন পৌঁছনোর কাজও চলছে। এলাকার নতুন জলের ট্যাঙ্ক।
তবে স্থানীয় রঞ্জিত মণ্ডল, জগদীশ বসাকদের ক্ষোভ, ‘‘বিধায়ক দেবেশবাবুর পার্টি অফিস আমরাই তৈরি করেছিলাম। আজ উনি আমাদেরই চেনেন না। প্রকল্প প্রচুর এসেছে। কিন্তু বিরোধী দলের লোকজনের কাছে পর্যাপ্ত হারে পৌঁছয়নি।’’ এলাকায় ক্ষোভ বিধায়ক দেবেশ মণ্ডলকে না কি খুব কমই দেখা গিয়েছে। সাংসদ নুসরত জাহানকেও ভোটের প্রচার ছাড়া খুব একটা দেখা যায় না। এলাকার খবর, গত বিধানসভা নির্বাচনে ৩০ হাজারের বেশি ব্যবধানে জেতা হিঙ্গলগঞ্জ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে তৃণমূল নেতৃত্বেরই।
যদিও দেবেশবাবুর দাবি, ‘‘সবার পাশে থাকি। অনেক সময়ে পারি না। কারও ক্ষোভ থাকলে মেটানোর চেষ্টা করব।’’ হিঙ্গলগঞ্জ লঞ্চ ঘাটের কাছে তৃণমূলের দলীয় অফিসে বসা কর্মীদের যুক্তি, ‘‘বিধায়ক, সাংসদ—এঁদের ব্যস্ততা থাকে। দৈনন্দিন প্রয়োজনে আমরা তো রয়েছি। বিরোধীরা প্রকল্প নিতে না এলে কী করব। তবে এটাও ঠিক যিনি দল করছেন, তিনি অগ্রাধিকার পাবেনই।’’
শোনা গেল বসিরহাট (উত্তর) আসনে কাঁটায়-কাঁটায় টক্কর হতে পারে। সিপিএমের বিদায়ী বিধায়ক রফিকুল ইসলামকে ছিনিয়ে নিয়ে প্রার্থী করেছে তৃণমূল। যিনি ইতিমধ্যে স্থানীয় চাঁপাপুর গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে প্রায় আড়াই হাজার লোককে তৃণমূলে যোগদান করিয়েছেন। আর বিজেপি এখানে দলীয় প্রার্থীকে পার করানোর দায়িত্ব চাপিয়েছে জোড়াফুল ছেড়ে পদ্মে যাওয়া ফিরোজ কামাল গাজি ওরফে বাবু মাস্টারের কাঁধে।
এলাকার খবর, রফিকুল এবং বাবু মাস্টারের সম্পর্ক বরাবরই আদায়-কাঁচকলায়। দু`জনেই না কি হাঁক পাড়লে পাঁচ-দশ হাজার লোক জড়ো হয়ে যায়। রফিকুলের দাবি, ‘‘চাঁপাপুর এখন প্রায় কংগ্রেস, সিপিএম শূন্য। বিজেপি এখানে বিষয় নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জন্ম থেকে মৃত্যু—প্রতি স্তরে মানুষের জন্য প্রকল্পের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন।’’ যদিও বিজেপি প্রার্থী নারায়ণ মণ্ডল বললেন, ``তৃণমূলের সন্ত্রাস, পঞ্চায়েতে ভোট দিতে না দেওয়া, আমপানের ত্রাণ নিয়ে দুর্নীতি--এ সব নিয়ে মানুষ ভীষণ ক্ষুব্ধ।’’ কিন্তু আপনাদের দলও তো কালো টাকা ফিরিয়ে আনতে পারেনি? জ্বালানির দাম, জিনিসপত্রের দাম কমাতে পারেনি? প্রার্থীর জবাব, ‘‘ ইস্তেহারে আমাদের পরিকল্পনার কথা মানুষকে জানাচ্ছি।’’ আবার আইএসএফ এখানে তাদের প্রার্থী বাইজিত আমিনের `বড় হুজুর` এর বংশধর পরিচয় সম্বল করে লড়াইয়ে নেমেছে। সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা কমিটির সদস্য শ্রীদীপ রায়চৌধুরীর দাবি, বসিরহাটের বেশির ভাগ আসন এ বার সংযুক্ত মোর্চা জিতবে। তিনি বলেন, ``পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য কেন্দ্র এবং রাজ্য, দুই সরকারই কিছু করেনি। তাঁদের আমরাই ফিরিয়ে এনেছিলাম। সন্ত্রাস করে পঞ্চায়েত নির্বাচনে মানুষকে ভোট দিতে দেওয়া হয়নি। তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে দলবদলও মানুষ ভাল চোখে দেখছেন না।``
বসিরহাটে (উত্তর) আপনাদের বিধায়কও তো তৃণমূলে চলে গিয়েছেন? শ্রীদীপবাবুর জবাব, ‘‘এটা আমাদের কর্মীদের লড়াইয়ে আরও উৎসাহ দিয়েছে।’’
বেতনি নদীর দু`পাড় জুড়ে বিস্তৃত সন্দেশখালি কেন্দ্রের আসল লড়াই মূলত মেছো ভেড়ির দখলকে ঘিরেই। এলাকার খবর, বোমা-গুলির শব্দ এখানে সন্ধ্যে হলেই শোনা যায়। নদীর ঘাটে দাঁড়িয়ে শোনা গেল, বেতনির জলে দাঁড়ানো পরিবহণ দফতরের লঞ্চ চালুই হতে পারেনি নৌকোয় নদী পারাপারের সিন্ডিকেটের দাপটে। কেন্দ্রের আর এক প্রান্তে দিঘির পাড় গ্রামের বাসিন্দা ছাত্রী পল্লবী বেরার থেকে জানা গেল, তাঁর সবুজ সাথীর সাইকেল পাওয়ার কথাও। বাসিন্দাদের দাবি, শাসক দলের লোকজন ভোটের সময়ে সবাইকেই চোখে চোখে রাখেন। এখানে জোর যার মুলুক তার। বিজেপির অভিযোগ, প্রার্থী ভাস্কর সর্দারকে নিয়মিত হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তৃণমূলের পাল্টা দাবি, বিজেপির প্রার্থী এলাকায় গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে পারেননি। মানুষই তাঁকে চাইছেন না।
আবার হাড়োয়ায় শোনা গেল বিজেপির দলীয় প্রার্থী রাজেন্দ্র সাহাকে নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে তাঁর দলের মধ্যেই। মিনাখাঁয় দেখা গেল পরিযায়ী শ্রমিকেরা বাগদা চিংড়ির চাষে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু পার্শ্ববর্তী বানতলা চর্মনগরীর দূষিত জল ভেড়িতে ঢুকে যাওয়ায় মার খাচ্ছে মাছের চাষ।
কিন্তু স্থানীয়দের অভিযোগ, এ সব নিয়ে কথা বলছে না কোনও রাজনৈতিক দলই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy