ইশা খান চৌধুরী ও গনি খান চৌধুরি। ফাইল চিত্র।
বাড়ির সামনে ভাইয়ের ছোট্ট মুদি দোকানে লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে বসে ছিলেন চামাগ্রামের আনসার শেখ। সৌদি আরবে কাজ করেন। চার বছর বাদে তিন মাসের ছুটি নিয়ে বাড়ি এসেছেন। সৌদি থেকে ফিরেই এখানকার ধুলোবালিতে রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠেছেন। নিজভূনেরর বেহাল রাস্তা, নিকাশি, পানীয় জলের অভাব নিয়েও তাঁর বেজায় ক্ষোভ। অথচ সৌদিতে রাস্তাঘাট ঝাঁ-চকচকে, জলের অভাব নেই। সরকারই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে, দাবি আনসারের।
পাঁচ দশকের আগে থেকে গনি খানের ‘গড়’ সুজাপুর বিধানসভায় আনসারের মতই এমন ক্ষোভ প্রায় সর্বত্র। এলাকায় কাজ না মেলায় ভিন্ রাজ্যে পাড়ি দেওয়া যুবকের সংখ্যা কম নয়। প্রায় পুরোপুরি সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এই সুজাপুরে এনআরসি ও সিএএ নিয়েও আতঙ্ক ঘরে ঘরে। সুজাপুরে এই ‘নানা’ ফ্যাক্টরই কংগ্রেসের গনি পরিবারের সদস্য ইশা খান চৌধুরীর দুর্গ রক্ষার ‘ইস্যু’। আর তৃণমূল প্রার্থী ভূমিপুত্র আব্দুল গনি সেই দুর্গ দখলের লড়াইকে আরও জমিয়ে দিয়েছে। পাশের বিধানসভা বৈষ্ণবনগরে কাজের জন্য বাসিন্দাদের ভিন্ রাজ্যে পাড়ি দেওয়ার প্রবণতা থাকলেও ভোট চিত্র কিন্তু ভিন্ন। পাচার, জাল নোট, বেআইনি ইট ভাটার কারবার সীমান্তের এই কেন্দ্রে জড়িয়ে। তেমনি গঙ্গা ভাঙনের তীব্রতাও মারাত্মক। প্রায় অর্ধেক অর্ধেক হিন্দু ও সংখ্যালঘু ভোটের ভাগাভাগিও এই কেন্দ্রে বিজেপি-তৃণমূল-কংগ্রেসের ত্রিমুখী লড়াইকে অন্য মাত্রা এনে দিয়েছে।
১৯৬২ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত সুজাপুর কেন্দ্রে কখনও হারেনি কংগ্রেস। ১৯৬৭ থেকে পরপর পাঁচবার বিধায়ক হন অবিসংবাদী কংগ্রেস নেতা আবু বরকত আতাউল গনি খান চৌধুরি। ১৯৯১ থেকে এই কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থী হিসাবে জিতে আসছেন গনি খানেরই নিকটাত্মীয়রা। ২০১৬ সালে এই কেন্দ্রে গৃহযুদ্ধ দেখেছিলেন মানুষ। তৃণমূল প্রার্থী তথা নিজেরই কাকা আবু নাসের খান চৌধুরিকে প্রায় ৪৭ হাজার ভোটে হারিয়ে বিধায়ক হয়েছিলেন ইশা। এবারে সেই ইশাই কংগ্রেস প্রার্থী। ওয়াকিবহল মহলের মতে, প্রায় ৯৫ শতাংশ সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এই কেন্দ্রে এবার বিজেপি সংখ্যালঘু মুখ শেখ জিয়াউদ্দিনকে প্রার্থী করলেও লড়াই কিন্তু কংগ্রেস ও তৃণমূলের। এনআরসি ও সিএএ নিয়ে আতঙ্কের ভোট এবার কোন দিকে, সেটাও চর্চার।
পানীয় জল, কর্মসংস্থান, সম্প্রীতি রক্ষার কথা ও গনি ‘মিথ’ তুলেই ইশা প্রচার করছেন। ইশা বলেন, ‘‘সুজাপুরের সঙ্গে আমাদের নাড়ির টান। সুজাপুরের মানুষ জানেন, কোতোয়ালি আসলে তাঁদেরই বাড়ি। তাই রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে সুজাপুরের মানুষ কংগ্রেসকেই ভোট দেবেন।’’ তবে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি রুখতে এবার বদ্ধপরিকর তৃণমূল। দলের প্রার্থী হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারক আব্দুল গনি সুজাপুরের গয়েশবাড়ির বাসিন্দা। সামলেছেন রাজ্যের ওয়াকফ বোর্ডের চেয়ারম্যানের পদও। আগে জগৎবল্লভপুর থেকে বিধায়কও হয়েছেন। এবারের লড়াই ঘরের মাটিতে।
প্রথমবারের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সুজাপুর আসনটি উপহার দিতে চেষ্টার কসুর রাখছেন না প্রবীন এই ‘ভূমিপুত্র’। তিনি বলেন, ‘‘সুজাপুরে জন্মেছি। নানা দায়িত্ব পালন করে এবার সুজাপুরে ফিরে এসেছি। লক্ষ্য একটাই, সুজাপুরের সার্বিক উন্নয়ন।’’ সব মিলিয়ে ‘ভূমিপুত্র’ বনাম ‘রাজনৈতিক ইতিহাস’ এবার মুখোমুখি সুজাপুরে।
পাশের কেন্দ্র বৈষ্ণবনগরে গত বিধানসভা ভোটে বিজেপির স্বাধীন সরকার জিতেছিলেন। কিন্তু কংগ্রেস প্রার্থী আজিজুর রহমানের চেয়ে মাত্র ৪ হাজার ভোটে জয়ী হন। এই দু’জনেই এবারে প্রার্থী। লোকসভা ভোটে বিজেপি অবশ্য ভাল লিড রেখেছিল। তৃণমূলের এবারের প্রার্থী মালদহ জেলা পরিষদের সহকারী সভাধিপতি চন্দনা সরকার। এখানে হিন্দু ও সংখ্যালঘু ভোট প্রায় সমান। বিজেপি হিন্দু ভোটের উপর ভর করেই জিততে মরিয়া। কিন্তু তৃণমূল ও কংগ্রেস প্রার্থীও সেই ভোটে থাবা বসাতে বদ্ধপরিকর। বিজেপির গোঁজ নির্দল প্রার্থী হরেন্দ্রনাথ সরকার কাঁটা স্বাধীনের। যদিও স্বাধীন বলেন, ‘‘বৈষ্ণবনগরের মানুষ এবারও আমাকে আশীর্বাদ করবেন।’’ এদিকে সংখ্যালঘু ভোট কংগ্রেস ও তৃণমূলে ভাগাভাগি হবে না তো? তৃণমূল প্রার্থী চন্দনা বলেন, ‘‘সিএএ, এনআরসি নিয়ে আতঙ্কিত সংখ্যালঘুরা এবার প্রতিবাদী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরই সঙ্গে। সেই ভোট আমরাই পাব।’’ কংগ্রেসের আজিজুর অবশ্য বলেন, ‘‘বৈষ্ণবনগরের মানুষ ধর্মনিরপেক্ষ। ধর্মের দোহাই দিয়ে ভোট হয় না। মানুষ জোটের পক্ষেই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy