প্রতীকী ছবি।
পর্বতের মূষিক প্রসব হইয়াছে। এত ঢক্কানিনাদ, এত শোভাযাত্রা, এত এত বিজ্ঞাপনের পরও যাহা ছিল, তাহার এক-তৃতীয়াংশ চলিয়া গিয়াছে যাহা নাই তার শোকে। কেন হইয়াছে, তাহার কারণসমূহ লইয়া প্রচুর লেখালিখি হইতেছে ও হইবে। কিন্তু একটি কথা হয়তো অধিক আলোচিত হইবে না। আর তাহা হইল, স্থিতাবস্থার পক্ষে রায়-এর অর্থ যিনি স্ববাক্যে, স্বকর্মে, স্থিত থাকেন, তাঁহার পক্ষে রায়। এইবার তাঁহার বাক্য এবং কর্ম আমার অপছন্দ হইতেই পারে, যেমন আমার কর্ম এবং বাক্য অপছন্দ হইতেই পারে অন্য কাহারও। তথাপি, উইন্সটন চার্চিলকে ভারতরত্ন দিলেও যেমন তাঁহাকে ভারতপ্রেমী প্রমাণ করা অসম্ভব, আসমুদ্র হিমাচলের নির্বাচনে একটি রঙের পতাকা উড়াইবার কথা বলিয়া, মুহুর্মুহু রং পাল্টাইতে দড় গিরগিটিদিগকে প্রতিনিধি হিসেবে আগাইয়া দিলে জনমানসে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হওয়াই স্বাভাবিক। যাঁহার নিষ্পেষণে বেসন বেগুনি ছাড়িয়া, মানুষ মহল্লা ছাড়িয়া পলাইয়া যাইত, তিনি ডিগবাজি খাইয়া নিজেকে যত বড় জিতেন্দ্রিয় দাবি করুন না কেন, মানুষের মন জেতা যাইবে না।
গণতন্ত্রের প্রত্যাখ্যানের ভিতরেও সমর্থন লুকাইয়া থাকে। যিনি প্রায় পঞ্চাশ পাইলেন তিনি গৃহীত হইলে, যিনি প্রায় চল্লিশ পাইলেন তিনিও সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যাত নন। এই শতকরা চল্লিশের কিংবা শতকরা চার-এর জানমালের নিরাপত্তা শতকরা পঞ্চাশ যিনি পাইয়াছেন, তাঁহার উপরই নির্ভর করে। বিরোধীর নিরাপত্তাহীনতা শাসকের পক্ষে ঘোর অগৌরবের। এটি সব রাজ্যের মতো এই রাজ্যের ক্ষেত্রেও সত্য।
রাষ্ট্রনায়কের সত্য আরও বড়। ভয়ঙ্কর অতিমারির ভিতর মানুষ যখন কীটপতঙ্গের মতো মরিতেছে, তখন কাণ্ডারীর কাজ ‘সন্তান মোর মার’ বলিয়া প্রাণ বাঁচাইবার কাজে প্রাণ পণ করা। হাসপাতালে অক্সিজেন নাই, শ্মশানে শবের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান— এমন সময় বক্তৃতা দিয়া বেড়াইলে মানুষ তো বলিবেই, ‘তব বাক্যে ইচ্ছি মরিবারে।’
মৃতদের নগরীর রাজাকে লইয়া কাব্য রচিত হইতে পারে, কিন্তু সেই নগরীর বাসিন্দা কেউ হইতে চায় না। মৃতের সম্মানের দাবিতেই আন্তিগোনে সম্রাটের সহিত লড়িয়া গিয়াছিলেন। একটি চিতা কিংবা চুল্লিতে যখন দুইজনকে একসঙ্গে দাহ করা হইতেছে, তখন নির্বাচনকে দীর্ঘায়িত করিয়া নির্বাচন কমিশন কেবলই মৃত্যুর জন্ম দিবার সুবন্দোবস্ত করিল।
জন্ম দেয় মায়েরা। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নিদর্শন নাই যে মেয়েরা দলবদ্ধ হইয়া কারও বাড়িতে আগুন দিতে কিংবা কাউকে খুন করিতে গিয়াছে। তাহা হইলে প্রতিটি কুবাক্যের সহিত নারীকে জড়াইয়া লওয়া ভোটভিক্ষার রীতি হইয়া উঠিল কেন? আঘাতপ্রাপ্ত একজন ভদ্রমহিলা, তিনি সম্রাজ্ঞী হোন বা পরিচারিকা, কোন পোশাক পরিবেন, তাহা লইয়া মশকরা করাটাকে কেবল অভদ্রতা নহে, ‘বিনিথ কনটেম্পট’ বলিয়া মনে করি এবং করিব। নির্বাচনের রায় বিপরীত হইলেও তাহাই করিতাম। যাঁহারা ভারতীয় পরম্পরা লইয়া গর্ব করেন, তাঁহাদের জানা উচিত শিবাজি মহারাজ যুদ্ধে পরাজিত বিপক্ষের স্ত্রীকে বলিয়াছিলেন, “আমার মা আপনার মতো সুন্দর হলে, আমাকেও দেখতে আরও ভাল হত।”
পার্টি ত্যাগ করিবার পর আমার ঘরে একবার আসিয়াছিলেন কমরেড সৈফুদ্দিন চৌধুরী। সেই অপরাধে, জরুরি অবস্থার সময়ে আপন গহনা বেচিয়া আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা কমরেডদের অন্নজলের ব্যবস্থা করা আমার মাকে দিনের পর দিন অশ্রাব্য গালিগালাজ এবং সর্বাধিক জঘন্য হুমকি শুনিতে হইয়াছিল। প্রতিবাদ করায় আমি রাতারাতি ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ হইয়া গিয়াছিলাম।
‘দেশদ্রোহী’ হইতে রাজি। কিন্তু খারাপ লাগিলে বলিতে পারিব বা না কেন? বলিতে মানুষ তখনই পারে না যখন সে কাহারও হস্তে তামাক খায়। কিন্তু যাহারা খায় না, তাহারা চিটফান্ডের পয়সায় ছায়াছবি নির্মাণকে বামপন্থী কার্য বলিয়া মনে করিবে না, রেল কিংবা এল আই সি বেচিয়া দেওয়াকে জাতীয়তাবাদী কার্য বলিয়া ভাবিবে না এবং হাই টেনশন তার হইতে কাহাকেও ঝুলিয়া থাকিতে দেখিলে পরে ব্যক্তিগত কারণে আত্মহত্যা বলিয়াও মনে করিবে না।
পরিস্থিতি যা দাঁড়াইয়াছে, আসন-পাওয়া বিরোধী এবং আসন-না-পাওয়া বিরোধীরা পরস্পরকে লইয়া ব্যস্ত। হয়তো এখনই শাসকের নির্বিকল্প হইয়া উঠিবার সময়।
ঔপন্যাসিক কি ইহাকেই একাধারে ভাল এবং খারাপ সময় বলিয়াছিলেন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy