করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের জেরে বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে এ রাজ্য। তার মধ্যেই চলছে নির্বাচনী প্রচার। এখনও বাকি তিন দফার ভোটপর্ব। ইতিমধ্যে এ রাজ্যে প্রচারপর্বের যে ছবি দেখা গিয়েছে, তাতে দূরত্ব বজায় রেখে মিটিং-মিছিল-সমাবেশ করা সোনার পাথরবাটির শামিল! বিশেষ করে যে সব কেন্দ্রে তারকা-প্রার্থীরা প্রচারে বেরিয়েছেন, সেখানে সুরক্ষাবিধি শিকেয় তুলে তারকাদের সঙ্গে সেলফি বা তাঁদের ছুঁতে চাওয়ার হুড়োহুড়ি ছিল চোখে পড়ার মতো। তাই কিছুটা হলেও সংক্রমণ বাড়ার দায় বর্তায় নির্বাচনী প্রচারের উপরে। সেই দায়ভার নিতে কি প্রস্তুত প্রার্থীরা? পরিস্থিতির দাবি মেনে প্রচারকৌশলে কি বদল আনা সম্ভব নয়?
ব্যারাকপুরের তৃণমূল প্রার্থী রাজ চক্রবর্তী যেমন বলছেন, ‘‘এই শেষ পর্বে এসে ভার্চুয়াল প্রচার করা সম্ভব ছিল না। নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরুর আগেই তা হলে কমিশনকে এ বিষয়ে গাইডলাইন তৈরি করে দিতে হত। ভিড়ের আশঙ্কায় দেবের সঙ্গে র্যালি বাতিল করেছি আমি। তবে আমি বন্ধ করলাম, আর একজন করল না। তা হলে তো আমি পিছিয়ে পড়ব। আর নবরাত্রি, বাংলা নববর্ষের মতো উৎসবও পালিত হয়েছে।’’
সংক্রমণ বৃদ্ধির জন্য শুধু নির্বাচনকে দায়ী করতে নারাজ বিজেপির তারকা প্রার্থী শ্রাবন্তীও। পশ্চিম বেহালার এই বিজেপি-প্রার্থীর কেন্দ্রে ভোট হয়ে গেলেও, প্রচারে ব্যস্ত নায়িকা। দুর্গাপুরে প্রচারের ফাঁকে বললেন, ‘‘মহারাষ্ট্র-সহ দেশের অনেক রাজ্যের অবস্থাই শোচনীয়। কিন্তু সে সব রাজ্যে তো ভোট হচ্ছে না। তাই শুধু ভোটকে দায়ী করা উচিত নয়। যতটা সম্ভব সুরক্ষাবিধি মেনে চলার চেষ্টা করছি।’’ তারকা প্রার্থীদের তো অনেক সময়েই মুখে মাস্ক দেখা যাচ্ছে না। শ্রাবন্তীও ব্যতিক্রম নন। অভিযোগের জবাবে তিনি বললেন, ‘‘জনগণ অনুরোধ করছেন মাস্ক খুলতে। আমাদের দেখতে চাইছেন তাঁরা। তাঁদের আর্শীবাদেই আমি এখনও সুস্থ আছি। তিন-চার দিন অন্তর কোভিড টেস্ট করাচ্ছি।’’
মুখে সুরক্ষাবিধি মানার কথা বললেও কার্যত দরজায় দরজায় গিয়ে বাড়ির মহিলাদের জড়িয়ে ধরা, বাচ্চাদের কোলে নেওয়ার ছবির কমতি নেই এই পরিস্থিতিতেও। বিজেপির আর এক তারকা-প্রার্থী যশ দাশগুপ্ত এ প্রসঙ্গে বললেন, ‘‘কেউ কাছে আসতে চাইলে দূরত্ববিধির কথা বলে দূরে সরিয়ে দিলে তাঁরা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন, সেটা আমাদের খারাপ লাগে। সেলফির অনুরোধও আসতে থাকে ক্রমাগত।’’ খারাপ লাগলেও সেলফির অনুরোধে ইদানীং ‘না’ করছেন সোনারপুর দক্ষিণের তৃণমূল প্রার্থী লাভলি মৈত্রও।
কোভিড সংক্রমণ বাড়ায় সরাসরি নির্বাচনী প্রচারকে দুষছেন অনেকে। সদ্য আক্রান্ত অভিনেতা ঋতব্রত মুখোপাধ্যায় যেমন তাঁর সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে এ নিয়ে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন। অন্য দিকে, বামজোটের প্রার্থীর প্রচারে উপস্থিত থাকায় ট্রোলড হতে হয়েছে শ্রীলেখা মিত্রকে। বিভিন্ন কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থীদের হয়ে প্রচারে গিয়ে দেব বারবার বলছেন মাস্ক পরতে। সাবধান করতে এ-ও বলেছেন, ‘‘তেমন হলে সভায় আসবেন না।’’ সম্প্রতি বিভিন্ন দলের সভা-মিছিল বাতিল হওয়া শুরু হয়েছে। বরাহনগরের বিজেপি প্রার্থী পার্নো মিত্র যেমন অন্য কেন্দ্রে প্রচার করতে যাচ্ছেন না, বাড়িতেই রয়েছেন। শ্যামপুরের বিজেপি প্রার্থী তনুশ্রী প্রচারে গিয়ে বলেছেন, ‘‘মাস্ক পরুন, না হলে এখান থেকে যাব না।’’ মানুষ তা কতটা শুনছেন, সে প্রশ্ন আলাদা। ‘‘আমি তো জোর করে কাউকে মাস্ক পরিয়ে দিতে পারব না। নিজেও সব সময় পরতে পারিনি। যেখানে নরেন্দ্র মোদী সভা করছেন, সেখানে আমরাও করতে পারি,’’ যুক্তি আসানসোল দক্ষিণের তৃণমূল প্রার্থী সায়নী ঘোষের।
তারকা প্রার্থী নিয়ে ভোটের ক্যাম্পেন চলবে অথচ তাতে ভিড় আশা করা হবে না, এমন পরস্পরবিরোধী কথায় বিশ্বাসী নন বামজোটের প্রার্থী দেবদূত ঘোষ। ‘‘নির্বাচন কমিশনের অনেক আগেই ভাবা উচিত ছিল বিষয়টা। বিজেপি বা তৃণমূলের মতো স্টার-ক্যাম্পেনার আমাদের দলে নেই। ব্যক্তিগত ভাবে আমি জমায়েতের বিরোধী। কিন্তু তার ফলে এমন বার্তা যেন না যায় যে, আমরা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেই। করোনায় আমরা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো মানুষকে হারিয়েছি। এ বছর আরও একটা মৃত্যুমিছিল চাই না,’’ বললেন টালিগঞ্জ থেকে দাঁড়ানো দেবদূত।
শেষ কয়েক দফা ভোট একসঙ্গে করা কি জমায়েত এড়ানোর উপায় হতে পারে? এ প্রসঙ্গে বারাসত কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী চিরঞ্জিৎ বললেন, ‘‘যখন নির্বাচন শুরু হয়েছিল, তখন পরিস্থিতি অন্য রকম ছিল। এখন আরও তিন দফায় ভোট না করে, একদিনে সেরে ফেলা যায়। কেন করা হচ্ছে না, সেই প্রশ্নটা উঠবে বিজেপির দিকে। একদিনে ভোটটা শেষ করে দিলে আর তো প্রচারের প্রশ্নই ওঠে না। লোক না হলে ভোট হয় না। লোক হলে বিধি মানা সম্ভব নয়, কাছাকাছি তারা দাঁড়াবেই।’’ চিরঞ্জিতের এলাকার ভোট হয়ে গিয়েছে এবং তিনি আর প্রচারেও যাচ্ছেন না। তবে ভোটের দফা কমিয়ে আনার বিরোধিতা করে ভবানীপুরের বিজেপি প্রার্থী রুদ্রনীল বললেন, ‘‘এত দফায় ভোট না হলে তৃণমূলের সুবিধে হত। ভাইরাস তো আর সময় দেখে আসেনি। আমার কেন্দ্রে অবাঙালি মানুষ বেশি, তাঁদের অনেকেই অভিনেতা রুদ্রনীলকে চেনেন না। এলাকায় প্রার্থীর মুখ চেনানোটা জরুরি। তবে র্যালিতে ৫-৬ জনের বেশি রাখিনি।’’ প্রচারে তাঁর মুখ চেনা না গেলেও মাস্ক মুখ থেকে নামাননি, দাবি করলেন কাঞ্চন মল্লিক। উত্তরপাড়ার তৃণমূল প্রার্থী বলছেন, ‘‘দূরত্ব বজায় রাখতে টোটোয় প্রচার করেছি। হ্যান্ডমাইকের বদলে মাউথপিস ব্যবহার করেছি।’’
সংক্রমণ বৃদ্ধির দায় নিজেদের কাঁধে নিতে নারাজ বেশির ভাগ তারকা প্রার্থীই। অতিমারি আবহে নির্বাচন করানোর দায়ভার তাঁরা দিচ্ছেন নির্বাচন কমিশনের উপরে। তাঁরা শুধু তাঁদের ‘কাজ’টুকু করছেন। ভালয় ভালয় সব মিটে যাওয়ার দিকেই আপাতত সকলে তাকিয়ে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy