সুজিত বসু, সব্যসাচী দত্ত, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়
যখন তাঁরা এক দলে, তখনও তাঁদের ‘মধুর’ সম্পর্ক ছিল আলোচনার বস্তু। এ বার তাঁরা আক্ষরিক অর্থেই প্রতিপক্ষ এবং ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বীও। বিধাননগরের নির্বাচনে যা আকর্ষণের বাড়তি মাত্রা জুড়েছে। তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যাওয়ার আগে সব্যসাচী দত্ত ছিলেন বিধাননগর পুরসভার মেয়র। তবে সল্টলেক তাঁর বিধানসভা কেন্দ্রে ছিল না, বিধায়ক হয়েছিলেন রাজারহাট-নিউ টাউন থেকে। তৃণমূলের সুজিত বসু অবশ্য ২০১১ থেকে এই কেন্দ্রের বিধায়ক। রাজ্যের মন্ত্রীও। বিধাননগর কেন্দ্রটির বিন্যাস যেমন আধুনিক সল্টলেককে নিয়ে, তেমনই আছে লেক টাউন, বাঙুর, শ্রীভূমি, পাতিপুকুর, দত্তাবাদ, সুকান্তনগরও।
গত বিধানসভা নির্বাচনে বিধাননগরে হাজার সাতেক ভোটে জিতেছিলেন সুজিত। দ্বিতীয় স্থানে ছিল কংগ্রেস। কিন্তু গত লোকসভা নির্বাচনের ফলের নিরিখে এই বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপি তৃণমূলের চেয়ে প্রায় ১৯ হাজার ভোটে এগিয়ে যায়। সেই অঙ্ক এ বারের বিধানসভা ভোটে খানিকটা নিশ্চিন্ত রেখেছে বিজেপির সব্যসাচীকে। তৃণমূলে থাকাকালীন বিধাননগর বিধানসভা কেন্দ্রে প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছে ছিল তাঁর। সেই ইচ্ছে পূরণ হল বিজেপিতে গিয়ে।
তৃণমূল-শাসিত বিধাননগর পুরসভার ১৪টি এবং দক্ষিণ দমদম পুরসভার ১০টি ওয়ার্ড মিলিয়ে এই বিধানসভা কেন্দ্র। বিধাননগর পুরসভার ১৪ জন কাউন্সিলরের মধ্যে সব্যসাচী ছাড়া আরও দু’জন— দেবাশিস জানা ও অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় এবং দক্ষিণ দমদমের ১০ জনের মধ্যে এক জন, মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে গিয়েছেন। সব্যসাচীর দাবি, বিধাননগরের আরও ১০ জন তৃণমূল কাউন্সিলর তাঁকে চিঠি দিয়ে বিজেপিতে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। বিধাননগর কর্পোরেশন হওয়ার আগে মিউনিসিপ্যালিটি থাকাকালীন অনুপম দত্ত এবং অশেষ মুখোপাধ্যায় নামে আরও দুই কাউন্সিলর তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে গিয়েছিলেন। দক্ষিণ দমদমের তৃণমূল কাউন্সিলরদের নিয়েও সব্যসাচীর ‘রহস্যপূর্ণ’ কথা, ‘‘দেখুন না, কী হয়! সুজিত বসু নিজের ওয়ার্ডে লিড পাবেন তো?’’ প্রসঙ্গত, সুজিত দক্ষিণ দমদমের কাউন্সিলরও।
এ তো গেল অঙ্কের হিসেব। এর বাইরে জনপ্রিয়তার যে পরিসর আছে, সেখানে সুজিতের অবস্থান উপেক্ষা করার নয়। বিধাননগর বিধানসভা এলাকা ঘুরলেই মানুষের মুখে শোনা যায়, ‘‘সুজিত বসু আমাদের খুব উপকার করেন।’’ লেক টাউন এলাকার এক ব্যবসায়ীর কথায়, ‘‘সারা বছর সুজিতবাবু পাশে থাকেন। যিনি যে দরকারেই যান, কাউকে খালি হাতে ফেরান না।’’ দত্তাবাদের এক বৃদ্ধের মুখেও সেই কথাই, ‘‘হাসপাতালে ভর্তি বা আর্থিক সাহায্য— সুজিতবাবুর কাছে গেলেই পাই। সবার ফোন ধরেন।’’ সল্টলেকের মধ্যবিত্তদের অনেকের মধ্যেও সুজিতের প্রভাব আছে।
২০১১ সাল থেকে পর পর দু’বার বিধাননগর বিধানসভায় জিতেছেন সুজিত। এক সময়ে তিনি অধুনা প্রয়াত সিপিএম নেতা তথা রাজ্যের মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তা ছাড়া, তিনি ক্লাব এবং নানা সামাজিক সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত। বিধাননগরের বহু জায়গায় ফুটবল ম্যাচ থেকে শ্রীভূমির দুর্গাপুজোর মতো নানা কর্মসূচির উদ্যোক্তা সুজিত। বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, লকডাউনে জীবিকা হারানো অনেককে টানা ন’মাস রান্না করা ও প্যাকেট করা খাবার দিয়েছেন সুজিতই।
রাজনৈতিক মহলের একটি অংশের মত, লোকসভা এবং বিধানসভা ভোট এক নয়। লোকসভায় দেশের সরকার গড়তে মানুষ ভোট দিয়েছিলেন। আর বিধানসভায় ভোট হবে রাজ্যের সরকার গড়তে। বিধায়ক নির্বাচনে প্রার্থীর ‘কাছের মানুষ’ ভাবমূর্তিই সেখানে গুরুত্ব পায়। কারণ, সারা বছর মানুষকে বিধায়কের কাছে যেতে হয়। সে দিক থেকে সুজিত স্বস্তিদায়ক জায়গায় আছেন।
জয়ের ব্যাপারে প্রত্যয়ী সুজিত বললেন, ‘‘মানুষ আমাকে ভোট দেবেন কাজ দেখে। আমার এলাকার ভোটারেরা জানেন, পাঁচ বছরে কী কী উন্নয়ন করেছি।’’ রাস্তা, পানীয় জল, নিকাশির কাজের খতিয়ান দিয়ে সুজিত জানান, জিতলে পানীয় জল প্রকল্পের যে কাজ চলছে, তা শেষ করবেন। সব্যসাচী যে আরও কাউন্সিলরের দল বদলের সম্ভাবনার দিকে ইঙ্গিত করছেন, তা নিয়ে সুজিতের খোঁচা, ‘‘সিন্ডিকেটের নেতার কথায় কী যায় আসে?’’
বস্তুত, সব্যসাচীর নামের সঙ্গে এই ‘সিন্ডিকেট’-এর প্রসঙ্গ জুড়ে আছে। সব্যসাচী নিজেও এ নিয়ে লুকোননি। কিন্তু তা তাঁর ভাবমূর্তির পক্ষে কতটা মানানসই, সে প্রশ্ন থাকছেই। তাঁর কথায়, ‘‘সিন্ডিকেট বলে কিছু হয় না। আইন মেনে ইমারতি দ্রব্যের ব্যবসা অপরাধ নয়।’’ কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ-সহ বিজেপির তাবড় নেতারা প্রায় প্রতি দিন দু’বেলা রাজ্যে এসে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ‘সিন্ডিকেট রাজ’-এর অভিযোগ তুলছেন। দাবি করছেন, রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় এলে ‘সিন্ডিকেট রাজ’-এর অবসান হবে। বিধাননগরের বাসিন্দাদের একটি অংশের প্রশ্ন, ‘‘সিন্ডিকেটের নেতা সব্যসাচী দত্তকে প্রার্থী করে বিজেপি সিন্ডিকেট বন্ধ করবে?’’ সব্যসাচীর জবাব, ‘‘মোদীজি ও অমিতজি সিন্ডিকেট বলতে ভাইপোর তোলাবাজিকেই বুঝিয়েছেন।’’
প্রচারে সব্যসাচীর মূল বক্তব্য, তিনি বিধাননগরে হকার উচ্ছেদ করেছিলেন। এ বার জিতলে বিধাননগরকে সম্পূর্ণ হকারমুক্ত করবেন। তাঁর এই প্রচার সল্টলেকের বাসিন্দাদের একটি অংশকে খুশি করলেও নিম্নবিত্ত মানুষ প্রশ্ন তুলছেন, ‘‘হকারদের উচ্ছেদ করা হলে তাঁদের জীবিকার কী হবে?’’
নিম্নবিত্তের প্রশ্ন যা-ই থাক, সব্যসাচী মনে করছেন, বিধাননগর আসনটি তাঁর পক্ষে ‘ওয়াক ওভার’। উপরন্তু, শাহও সেখানে সভা করেছেন।
সব মিলিয়ে বিধাননগরের লড়াই সুজিত এবং সব্যসাচীর ‘বাহিনী’র জোরের।
এ ছাড়াও বিধাননগরের লড়াইয়ে আছেন কংগ্রেস প্রার্থী অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। বহুজাতিক সংস্থায় কর্মরত অভিষেকের ভরসা ২০১৬-য় এখানে কংগ্রেসের ফল। তা ছাড়া, তাঁর ভাবমূর্তি নিয়ে কোনও প্রশ্ন ওঠেনি। তিনি প্রচারে জোর দিচ্ছেন উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থানে। অভিষেক বলেন, ‘‘আমি জিতে বিধাননগরে যাতায়াতের জন্য জলপথ চালু করব। সেখানে ফেরি পরিষেবা দেবেন স্থানীয় বেকারেরা। ফলে তাঁদের কর্মসংস্থান হবে।’’ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, অভিষেক এই কেন্দ্রে জয় পরাজয়ের নির্ধারক হবেন। সল্টলেকের বামপন্থী ভোটারদের ভোট অভিষেকের পক্ষে সংহত করতে চেষ্টায় ত্রুটি রাখছেন না সিপিএম নেতৃত্ব। দলের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র, রমলা চক্রবর্তী এবং প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী একযোগে সভাও করেছেন সেখানে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy