প্রতিপক্ষ: ডান দিক থেকে শশী পাঁজা, জীবনপ্রকাশ সাহা ও সন্দীপন বিশ্বাস।
দগ্ধ ‘হাজার বস্তি’ বলছে, ‘ভোট তো এসে গেল, ঘর কই?’ প্রতিশ্রুতি পেতে পেতে ক্লান্ত কুমোরটুলি আজ আর উন্নয়নের কথা শুনতে চায় না। আর তোলাবাজির জুলুমে ক্লান্ত সোনাগাছির মেয়েরা চান শ্রমের অধিকার, ভোটদানের অধিকার। শ্যামপুকুর বিধানসভা কেন্দ্রের এই তিন সমস্যার সঙ্গে লড়াইয়ে স্থানীয় বিধায়ক, তৃণমূল কংগ্রেসের শশী পাঁজার হাতিয়ার তাঁর জনসংযোগ। তবু শ্যামপুকুরের অলিগলিতে ঘুরলে পাওয়া যায় পদ্ম-গন্ধ। কানে আসে শাসক দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কথা। ভোটের বাজারে যার ফায়দা তুলতে চেষ্টার ত্রুটি রাখছে না বিরোধীরা।
বাগবাজারের একাংশে ফুটপাত জুড়ে পর পর সংসার। কোনওটির মাথার উপরে প্লাস্টিকের ছাউনি, কোনওটি বিছানার চাদর দিয়ে কোনওক্রমে আড়াল করা। সেখানেই একচিলতে প্লাস্টিকের ‘ঘরে’ টুলের উপরে ঠায় বসে ক্ষয়াটে, ন্যুব্জ চেহারার অশীতিপর বৃদ্ধা। আনমনে তাকিয়ে রাস্তার ও পারে হাজার বস্তির দিকে, যেখানে মাত্র চার মাস আগেও ছিল তাঁর ঘরবাড়ি।
কেমন আছেন? কানে খাটো বৃদ্ধা কষ্ট করে প্রশ্নটা শুনে হাসলেন— ‘‘আগুন লাগার পরে আশপাশের বাড়ি থেকে ক’টা কাপড় দিয়েছিল। নিজের বলতে এখন সেটুকুই। কিছুই বাঁচাতে পারিনি।’’ ফুটপাতের ওই খুপরি জায়গায় বড় নাতি সেলাই মেশিনে কাজ করেন, ফলে ভরদুপুরেও বসেই থাকতে হয় বৃদ্ধাকে। রাতে মেশিন তুলে ফেললে তবেই একটু শোওয়ার জায়গা মেলে। ‘‘সে রাতে বস্তিতে নয়, আমাদের কপালে আগুন লেগেছিল।’’— কপাল চাপড়ে বলছেন বৃদ্ধা।
পাশেই গাছতলায় গায়ে গামছা দিয়ে বসে ‘ঘরপোড়া’ দুই যুবক। জানালেন, অগ্নিকাণ্ডের পরে দেড় মাস খাবার জুগিয়েছে সরকার, সঙ্গে বিজেপিও। তবে এখন সে সবই বন্ধ। হাজার বস্তির দিকে তাকিয়ে তাঁদেরই এক জনের স্বগতোক্তি—‘‘মমতাদি এসে বলেছিলেন, তিন মাসের মধ্যে যেমনটা ছিল তেমনটা করে দেবেন। ভোট এসে গেল, কিন্তু কাজ এখনও শেষ হল না।’’
আজও শেষ হয়নি শ্যামপুকুর কেন্দ্রের কুমোরটুলির পুনর্বাসন প্রকল্প। সংযুক্ত মোর্চা সমর্থিত, ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থী জীবনপ্রকাশ সাহা এবং বিজেপি প্রার্থী সন্দীপন বিশ্বাসের ভোটে হাতিয়ার তাই কুমোরটুলির উন্নয়ন। যদিও এত বছর পরে উন্নয়নের স্বপ্ন আর দেখেন না মৃৎশিল্পীরা। তাঁদেরই এক জনের কথায়, ‘‘২০০৪ থেকে কুমোরটুলির পুনর্বাসনের নামে প্রহসন চলছে। তাই উন্নয়নের কথা এখানে আর কেউ বলে না। এ-ই বেশ ভাল আছি।’’
তবে এই ‘ভাল থাকা’য় যে শ্যামপুকুর কেন্দ্রের মানুষ পাশে পেয়েছেন তাঁদের বিধায়ককে, তা স্বীকার করছেন অনেকেই। এলাকার সৌন্দর্যায়ন থেকে পুজো-পার্বণ-উৎসব, এমনকি করোনা-আমপানের কঠিন সময়েও পাশে দাঁড়িয়েছেন শশী। তাই প্রচারে বেরিয়ে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালে হাসিমুখে তাঁকে স্বাগত জানাচ্ছেন বহু ভোটার। কেউ কেউ ভাঙা শৌচাগার, নর্দমার জমা জল নিয়ে অনুযোগ করছেন বটে, তবে ‘ঘরের মেয়ে’ হয়েই তাঁদের ভরসা জুগিয়ে চলেছেন মন্ত্রী। বাগবাজারের সাত নম্বর ওয়ার্ডের এক বস্তিবাসী বলছেন, ‘‘লকডাউনের সময়ে শশী অনেক করেছেন, এ কথা সত্যি। মন্ত্রী হলেও ওঁর কাছে সহজেই পৌঁছনো যায়, এটাই তো অনেক।’’ এ বারের ভোটে হ্যাটট্রিকের মুখে দাঁড়ানো শশীর ইউএসপি তাই তাঁর ‘কাছের মানুষ, কাজের মানুষ’ ইমেজটাই।
বিজেপি প্রার্থী সন্দীপনও প্রচারে জোর দিচ্ছেন বস্তি উন্নয়নের উপরে। সেই সঙ্গে রয়েছে কুমোরটুলিকে পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তর এবং সোনাগাছিতে তোলাবাজি-জুলুম শেষ করার প্রতিশ্রুতি। আর ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থী, সাদাসিধে ভাবমূর্তির জীবনপ্রকাশের হাতিয়ার এলাকার পার্কিং সমস্যা, স্থানীয় হাসপাতালের দুর্বল পরিকাঠামো এবং হাতিবাগান উড়ালপুলের দাবি। তবে বাগবাজারের এক কর পরামর্শদাতা (ট্যাক্স কনসালট্যান্ট) অবশ্য বলছেন— ‘‘খাল কেটে কুমির আনার প্রশ্নই নেই। বিজেপি যে সব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, সেগুলো আগে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে করে দেখাক। তার পরে কথা হবে।’’
শশীর জন্য থাকছে বিরোধীদের সমালোচনাও। রাজ্যের নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রী হয়েও নিজের কেন্দ্রে যৌনকর্মীদের দাবিদাওয়া নিয়ে কী করেছেন— সেই প্রশ্নের মুখে পড়ছেন তিনি। এর সঙ্গে রয়েছে সোনাগাছিতে তোলাবাজির জুলুমের অভিযোগ। রয়েছে এলাকায় তৃণমূলের প্রোমোটিং সিন্ডিকেট প্রসঙ্গ, ‘বহিরাগত’ খোঁচাও। পেশায় চিকিৎসক মন্ত্রীর জবাব, ‘‘যৌনকর্মীরা মূল স্রোতে ফিরতে চাইলে এই সরকারের ‘মুক্তির আলো’ প্রকল্প রয়েছে, যা দেশে প্রথম। এ ছাড়া কোভিড-আমপানের দুঃসময়েও ওঁদের পাশে থেকেছি।’’ তবে এনআরসি নিয়ে আতঙ্কে থাকা সোনাগাছির মেয়েরা অবশ্য চাইছেন নিজের ভোট নিজে দেওয়ার অধিকার।
১১টি ওয়ার্ডের শ্যামপুকুর কেন্দ্র থেকে ২০১১ সালে জীবনপ্রকাশকে হারিয়ে প্রথম বার ভোটে জিতেছিলেন প্রবীণ রাজনীতিক, প্রয়াত অজিত পাঁজার পুত্রবধূ শশী। ভোট পেয়েছিলেন ৭২৯০৪টি। সে বার বিজেপি পেয়েছিল মাত্র সাড়ে চার হাজার ভোট। ২০১৬ সালে ফের জয়ী শশী। সে বছরও ভোটের নিরিখে বিজেপি ছিল তৃতীয় স্থানে (১৮৩৭৮টি ভোট)। কিন্তু ‘খেলা’ ঘুরতে শুরু করে তার পরেই। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্র থেকে ২১৭০টি ভোটে এগিয়ে যায় বিজেপি। পুরনো কলকাতার বাঙালি অধ্যুষিত এই কেন্দ্রে তৃণমূল কেন পিছিয়ে পড়ল, তা সেই সময়ে রাজনৈতিক মহলে রীতিমতো আলোচনার বিষয় ছিল। যদিও শশীর ব্যাখ্যা, ‘‘সে সময়ে বাম সমর্থকদের একটা বড় অংশ বিজেপি-কে ভোট দিয়েছিলেন। লোকসভা ভোটের প্রেক্ষাপট আলাদা, তাই ফলাফল অন্য রকম হয়েছিল। কিন্তু বিধানসভা ভোটে অন্য অঙ্ক। এখানে হাতের কাছে পাচ্ছেন কাকে, সেটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’’
তবে এলাকার অন্দরে তৃণমূল-বিরোধী চোরাস্রোত এবং দলীয় গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব— আপাতত এই দুই-ই মন্ত্রীর পথের কাঁটা। এলাকায় কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, কাটমানি, আমপান-দুর্নীতি ইত্যাদি কারণে ঘাসফুলের উপরে চটেছেন অনেকে। ‘‘অনেকেরই এখন মুখে দিদি, মনে মোদী।’’— সাফ বলছেন পাথুরিয়াঘাটার এক ব্যবসায়ী। বিজেপি প্রার্থী সন্দীপনের আবার দাবি, ‘‘মানুষের মধ্যে একটা ভয় কাজ করছে। তৃণমূলের অনেক কর্মীই তলে তলে আমায় সমর্থন করছেন।’’ সন্দীপন অবশ্য কিছু দিন আগেও তৃণমূলে ছিলেন।
বিষয়টি আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ অন্য একটি অঙ্কে। উত্তর কলকাতার রাজনীতি নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, তাঁদের কাছে মানিকতলার সাধন পাণ্ডের সঙ্গে শ্যামপুকুরের শশীর ‘মধুর’ সম্পর্কের কথা অজানা নয়। ঘটনাচক্রে, তৃণমূলে সন্দীপনের পরিচয়ও ছিল সাধন-ঘনিষ্ঠ হিসেবেই।
এই দুই দলের মাঝে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে আছেন ফরওয়ার্ড ব্লকের জীবনপ্রকাশ। এই কেন্দ্র থেকে দু’বার (২০০৪ সালের উপনির্বাচন এবং ২০০৬-এর বিধানসভা নির্বাচন) নির্বাচিত হওয়া প্রাক্তন ওই বিধায়ক বলছেন, ‘‘মানুষের আর্থিক অবস্থার সুযোগ নিয়ে তাঁর ভোট, মত বদল করা হচ্ছে। মানুষ নিজের মতো করে ভোট দিতে পারলে ফল অন্য হবে।’’
এলাকায় ঘুরলে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কথাও যে কানে আসে না, তা নয়। দলের ৯ জন কাউন্সিলরের সকলেই সমান ভাবে ‘গা ঘামাচ্ছেন’ কি না, গুঞ্জন আছে তা নিয়েও। যদিও শশীর দাবি, ‘‘দু’-এক জনের আনুগত্য অন্য দিকে রয়েছে ঠিকই, তবে তাঁদের দেখে গোষ্ঠী ভাবলে ভুল হবে। এলাকার মানুষ আমাকে জানেন, চেনেন, সর্বদা দেখেন। আর মাথার উপরে মমতাদি তো আছেনই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy