ফাইল চিত্র।
ভয়, ভক্তি এবং যুক্তি। মূলত এই তিনটি শব্দে গাঁথা হচ্ছে বারুইপুর পূর্ব, বারুইপুর পশ্চিম, ক্যানিং পূর্ব, ক্যানিং পশ্চিম, মগরাহাট পূর্ব এবং মগরাহাট পশ্চিম— দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার এই ছ’টি বিধানসভা কেন্দ্রের নির্বাচন। এই কেন্দ্রগুলিতে ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের ফলের নিরিখে তৃণমূল এগিয়ে। কিন্তু এ বার সংযুক্ত মোর্চার তরফে আব্বাস সিদ্দিকীর আইএসএফ দু’টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে। ফলে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত জায়গাগুলিতে ভোট কাটাকাটির নতুন অঙ্ক নিয়েও গুঞ্জন কম নয়।
তবে বহমান ভয়, ভক্তি এবং যুক্তি।
ভয় নিরাপত্তাহীনতার। বিজেপির ‘আসল পরিবর্তন’-এর হুঙ্কারে সংখ্যালঘু-মন নিরাপত্তাহীনতার ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। আর যত কুঁকড়ে যাচ্ছে, তত একজোট হয়ে আঁকড়ে ধরতে চাইছে কোনও শক্ত অবলম্বন। যাঁরা ‘পরিবর্তন’ চান, তাঁদেরও ভয় আছে। শাসকের বিরুদ্ধে মুখ খুলে আক্রান্ত হওয়ার ভয়।
ভক্তির স্রোতও দু’দিকেই। মগরাহাট পশ্চিমের ‘পরিবর্তন’পন্থী তিন মহিলা হেসে বললেন, ‘‘মোদী যা বলছেন, সে সব হলে তো দারুণ হবে। সব দলই সুযোগ পেয়েছে। এ বার বিজেপিকেও একটা সুযোগ দিতে চাই।’’ আবার প্রত্যাবর্তনপন্থীরা বলছেন, পাকা রাস্তা, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্যসাথী কার্ড, নানা সরকারি ভাতা পেয়ে তাঁরা ভালই আছেন। করোনা পর্বে লক ডাউনের সময় শাসক দলের নেতারা সব রকম সাহায্যই করেছেন। এর পরেও পানীয় জলের সমস্যা আছে। কিন্তু বর্তমান শাসক ক্ষমতায় ফিরে তার সমাধান করে দেবেন বলে প্রত্যাবর্তনপন্থীরা আশাবাদী।
যুক্তির একটি ধারাও বহমান। সেখানে প্রশ্ন উঠছে, শুধু সরকারি ভাতায় কি জীবন চলবে? গ্যাসের দাম সাড়ে ৮০০ ছুঁই-ছুই। পেট্রোল-ডিজেলের দাম ক্রমবর্ধমান। জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া। রোজগার কমে যাচ্ছে। সে সবের সমাধানের কথায় না গিয়ে অনেক নেতাই ভোট চাইছেন ধর্মের জুজু দেখিয়ে। মানুষ কি ধর্ম ধুয়ে জল খাবে? ঘুষ-বিহীন চাকরি, ফড়েরাজ-মুক্ত চাষ এবং স্বাধীন জীবনের দাবি শোনা যাচ্ছে এই ধারায়।
এই ছয় কেন্দ্রের ‘পরিবর্তনপন্থী’রা অভিযোগ করছেন, আমপানে বাড়ি ভাঙলেও তাঁরা ক্ষতিপূরণের টাকা পাননি। সেই টাকা পেয়েছেন অটুট অট্টালিকার মালিক তথা শাসক দলের নেতা-নেত্রী এবং তাঁদের পরিজনেরা। প্রাথমিক স্কুল-সহ নানা ক্ষেত্রে চাকরির জন্য নেতাকে টাকা দিয়ে প্রতারিত হওয়ার অভিযোগও রয়েছে বিস্তর।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের যে এই সব অভিযোগ নেই, তা নয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে বড় হয়ে উঠছে নিরাপত্তাহীনতার ভয়। হিন্দুত্ববাদীরা ক্ষমতায় এলে জান-মান অক্ষত থাকবে তো? কিন্তু সংখ্যাগুরুর সে ভয় নেই। তাই ওই সম্প্রদায়ের যাঁদের অভিযোগ আছে, তাঁরা তুলনায় সহজে ‘পরিবর্তন’ চাইতে পারছেন। তবে সমাজে দুই সম্প্রদায়ই রয়েছে মিলেমিশে।
দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। অভিযোগ, সেখানে এখন ফড়ে-দালালদের বিরাট দাপট। ফলে চাষি ধান, পাট, আনাজের মতো ফসলের দাম পাচ্ছেন না। অথচ, বাজারে মানুষ চাল এবং আনাজ কিনছেন চড়া দামে। এই জেলায় কিছু শিল্পও আছে। যেমন— ফলতা এসইজেড, বানতলা চর্মনগরী এবং তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প। ফলতায় কর্মীসংখ্যা ১৪ হাজার থেকে ৩ হাজারে নেমে এসেছে। বানতলা চর্মনগরী এবং তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের কর্মীর সংখ্যা ৯০ হাজার থেকে কমে এখন ৪০ হাজার। বিষ্ণুপুর থেকে ডায়মন্ড হারবার এই লম্বা অঞ্চল জুড়ে প্রায় সব
কারখানা বন্ধ।
এই আবহেই ভোটের ময়দানে লড়ছেন প্রার্থীরা। এই ছ’টি কেন্দ্রই এখন তৃণমূলের হাতে। ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে এই ছ’টি কেন্দ্রে দ্বিতীয় স্থানে ছিল বাম-কংগ্রেস জোট। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের ফলের নিরিখে সব ক’টিতেই দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে বিজেপি। তবে ২০১৬-র তুলনায় ২০১৯-এ তৃণমূলের এগিয়ে থাকার ব্যবধান বেড়েছে। আর একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়— ক্যানিং পূর্ব, ক্যানিং পশ্চিম, মগরাহাট পূর্ব, মগরাহাট পশ্চিম— এই চার কেন্দ্রে সংখ্যালঘু ভোটার কোথাও ৫০ শতাংশ, কোথাও ৬০ শতাংশের আশপাশে। আর বারুইপুর পূর্ব, বারুইপুর পশ্চিম কেন্দ্র দু’টিতে সংখ্যালঘু ভোটার ৩০ শতাংশের আশপাশে।
এই ছয় কেন্দ্রেই উল্লেখযোগ্য প্রার্থী তৃণমূল, বিজেপি এবং সংযুক্ত মোর্চার। বারুইপুর পূর্বে তৃণমূলের প্রার্থী বদলেছে। এই কেন্দ্রের প্রাক্তন বিধায়ক নির্মল মণ্ডল এ বার টিকিট পাননি। সেখানে তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন বিভাস সর্দার। ক্যানিং পশ্চিমের বিধায়ক শ্যামল মণ্ডলকেও এ বার ওই আসনে প্রার্থী করেনি তৃণমূল। তিনি এ বার বাসন্তীর প্রার্থী। ক্যানিং পশ্চিমে এ বার তৃণমূলের টিকিট পেয়েছেন পরেশরাম দাস।
বারুইপুর পশ্চিম এবং মগরাহাট পশ্চিমের তৃণমূল প্রার্থী বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় এবং গিয়াসউদ্দিন মোল্লা হেভিওয়েট। বিমানবাবু বিধানসভার স্পিকার এবং গিয়াসউদ্দিন রাজ্যের মন্ত্রী। দু’জনেই এ বারও জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী। বিমানবাবু বলেন, ‘‘ভাল ভাবে জিতব। এ বার জিতে আমার প্রথম কাজ হবে জলসঙ্কটের সমাধান করা। কিছু জায়গায় এখনও ওই সঙ্কট আছে।’’ বিমানবাবুর বিরুদ্ধে বিজেপির প্রার্থী দেবোপম চট্টোপাধ্যায়। স্থানীয় মানুষ তাঁকে আরএসএসের লোক বলে জানেন। তবে প্রচারে নানা রকম জৌলুস ছাড়া দেবোপম সম্পর্কে বলার মতো আর বিশেষ কিছু খুঁজে পাচ্ছেন না তাঁরা। আর মন্ত্রী গিয়াস বলেন, ‘‘মানুষের আশীর্বাদে জিতব। জিতেই আবার উন্নয়নের কাজে নেমে পড়ব।’’ তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপির মানস সাহা অবশ্য দাবি করছেন, জিতবেন তিনিই। কারণ, মন্ত্রীর বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ আছে। প্রসঙ্গত, মানসবাবু কিছু দিন আগে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন।
ক্যানিং পূর্বের তৃণমূল প্রার্থী, যিনি লোকসভা ভোটের ফলের নিরিখে ১ লক্ষ ৪৩ হাজার ১৭৩ ভোটে এগিয়ে আছেন, সেই সওকত মোল্লারও দাবি, তিনি জিতবেন। তবে ওই কেন্দ্রের সংযুক্ত মোর্চার আইএসএফ প্রার্থী গাজী সাহাবুদ্দিন সিরাজির সমর্থনে সভা করে এসেছেন আব্বাস। সেই সভার ব্যাপক ভিড় এখন এলাকায় চর্চার বিষয়। তরুণ প্রজন্মের ভোটারদের মধ্যে ‘ভাইজানের’ আকর্ষণ চোখে পড়ার মতো। সওকত যদিও দাবি করেন, ‘‘বাইরে থেকে লোক এনেছিল। আর সিপিএম লোক দিয়েছিল।’’
এই ছয় কেন্দ্রে বিজেপির সংগঠন খুব মজবুত নয়। তবে তাদের পোস্টার, ব্যানার, ফ্লেক্স চোখে পড়ছে প্রায় সর্বত্রই। ৩০-৩৫টি ম্যাটাডোর বোঝাই লোক নিয়ে ডিজে বাজিয়ে প্রচারও চলছে। পাশাপাশি রয়েছে ভোটের মেরুকরণের উদ্দেশ্যে হিন্দু জাগরণ মঞ্চ এবং আরএসএসের ধর্মীয় প্রচার। তবে বিরোধীদের দাবি, সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রের বাইরের নানা জায়গা থেকে লোক এনে বিজেপির ম্যাটাডর ভরানো হচ্ছে।
এই ছয় কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থীদের মধ্যে ক্যানিং পশ্চিম এবং মগরাহাট পশ্চিমের প্রার্থী অর্ণব রায়ও দলবদলু। তিনি গত বিধানসভা ভোটে ক্যানিং পশ্চিমেই কংগ্রেসের প্রার্থী ছিলেন। প্রার্থীদের নিয়ে বিজেপি কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ কমবেশি ছয় কেন্দ্রেই আছে। সেই ক্ষোভ মেটাতে আসরে নামতে হয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাইকে। তাতে কাজ হয়েছে বলে বিজেপির জেলা নেতৃত্বের দাবি। দলের দক্ষিণ ২৪ পরগনা (পূর্ব) জেলার সহ সভাপতি নারায়ণ মল্লিক বলেন, ‘‘এই কেন্দ্রগুলিতে মানুষ পঞ্চায়েতে ভোট দিতে পারেননি, আমপানে ক্ষতিগ্রস্তরা ক্ষতিপূরণের টাকা পাননি। তাঁরা বিজেপিকেই জেতাবেন।’’
সংযুক্ত মোর্চার তরফে এই ছয় কেন্দ্রে দুই আইএসএফ প্রার্থীর পাশাপাশি তিন জন সিপিএম এবং এক জন কংগ্রেস প্রার্থী। তাঁদের মধ্যে মগরাহাট পশ্চিমের আইএসএফ প্রার্থী মইদুল ইসলাম মোল্লা শিক্ষক ঐক্য মুক্ত মঞ্চের তরফে গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষকদের দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন করেছেন। কিছু দিন আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির পাশে আদিগঙ্গায় নেমে বিক্ষোভ দেখান। তাঁর সমর্থনেও সভা করেছেন আব্বাস এবং সিপিএমের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক শমীক লাহিড়ি। শমীকবাবু বলেন, ‘‘কৃষি, শিল্প, রোজগার, শিক্ষা এবং গণতান্ত্রিক অধিকার— সব দিক থেকেই মানুষের মনে শাসকের বিরুদ্ধে ক্ষোভ রয়েছে। লোকসভায় সেই ক্ষোভ থেকে অনেকে বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন। কিন্তু এ বার তাঁরা দেখছেন, তৃণমূলের যাঁদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ, তাঁরাই এখন বিজেপিতে। তাই মানুষ এ বার আমাদের দিকে ফিরছেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy