কঙ্কালীতলা: বেনাচাপড়া কঙ্কাল-কাণ্ডে অভিযুক্ত তিনি। জেলও খাটতে হয়েছে। তার পরেও দীর্ঘ সময় চন্দ্রকোনা রোডের বাড়িতে ফিরতে পারেননি। গত ডিসেম্বরে এলাকায় ফিরেছেন। উচ্ছ্বাসে তাঁকে বরণ করে নিয়েছে স্থানীয় বাম জনতা। কিন্তু তাদের মধ্যেও মিশেছিল কিছু অদৃশ্য কঙ্কাল। মুখে কেউ কিছু না বললেও মনে তো আছে!
হোসিয়ারি হুঁশিয়ারি: কঙ্কাল-কাণ্ডে আদালতে তাঁর হয়ে সওয়াল করেছিলেন বলাই রায়। সেই মামলায় তাঁর অমর উক্তি, ‘‘ধর্মাবতার, মারা যাওয়ার দশ বছর পরেও কঙ্কালের পরনের গেঞ্জি আর অন্তর্বাসের সুতো অক্ষত রয়ে গেল! এ সুতো ভারতের কোন হোসিয়ারি কারখানায় তৈরি হয়?’’ কঙ্কাল-কাণ্ডের কথা তুললে সুশান্তও বলছেন, ‘‘এত বোকামো কেউ করে! দশ বছর পর মানুষগুলোর হাড়গোড় ছেড়ে গেল! অথচ গেঞ্জি আর অন্তর্বাস অক্ষত রইল!’’
বাঘের ঘরে: চন্দ্রকোনা রোডের পরিমল কাননের পাশের বাড়িতে রুগ্না স্ত্রী-র কাছে ফিরতে পারতেন না। কলকাতার ভবানীপুরে ভাইপোর যে ফ্ল্যাটে থাকতেন, তার দেড়শো মিটারের মধ্যে শাসক তৃণমূলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ এবং অঘোষিত দু’নম্বর অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি। ভাবা যায়!
একলা আকাশ থমকে গেছে: জেলবাস এবং তার পরের দীর্ঘ সময় ঘুম থেকে উঠে কলকাতার আকাশ দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। এখন সকালে ঘুম থেকে উঠেই লাল রং করা পার্টি অফিসে গিয়ে বসেন। সেখান থেকেই প্রচারে বেরোন। প্রচার সেরে আবার যান এক দশক আগের ‘দুর্গ’ পার্টি অফিসে। দিনভর প্রাণ ভরে আকাশ দেখেন। যে আকাশে থমকে গিয়েছে তাঁর ‘সুসময়’।
দুঃসময়: এই শিরোনামে লেখা নাটকের নাট্যকারের মন্ত্রিসভায় থাকলেও তাঁর পছন্দের মানুষ ছিলেন না সুশান্ত। ২০১১ সালে নাকি তাঁকে প্রার্থীও করতে চাননি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তবু ‘সম্পদ’-কে তালিকায় রেখেছিল দল। এখন সে সব মনে পড়লেও মনে রাখতে চান না। তবে কলকাতায় এতগুলো বছর কাটালেও পাম অ্যাভিনিউয়ের ধারেপাশে যাননি। যেখানে ঘরবন্দি বৃদ্ধ-অসুস্থ-অশক্ত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী।
চমকাইতলা: দেখে রাগী বলা যাবে না। ফর্সা মুখে সবসময় ঝুলে থাকে একটা স্মিতহাসি। হাসতে হাসতেই নাকি ‘বদলা’-র নির্দেশ দিতেন। এখনও হাসিমুখেই যাচ্ছেন প্রচারে। রক্তে মিষ্টি বাড়লেও কথার মিষ্টতা ঢেকে মাঝে মাঝেই অতীতের ঝাঁজ উঁকি মারে। ক’দিন আগেই ডায়ালগ দিয়েছেন, তাঁর কারও গায়ে হাত পড়লে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে এসে হাত-পা ভেঙে দেবেন। তার পর চিকিৎসাও করাবেন নিজেই।
নিজৌষধি: দলের লোকেরাই একদা বলতেন, সুশান্ত ঘোষ বিরোধীদের শায়েস্তা করার দাওয়াই জানেন। কোন রোগে কী ওষুধ, তিনিই ঠিক করে দিতেন। এখন নিজেই কাহিল ওষুধে। দিনে দুটো সুগারের, তিনটে প্রেশারের ট্যাবলেট খেতে হয়। নিঃসন্তান সুশান্তের স্ত্রী করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় গুরুতর অসুস্থ। তাঁর চিকিৎসার জন্য মাসে অন্তত ৮,০০০ টাকার ওষুধ লাগে।
রুমাল থেকে বেড়াল: ছিলেন গড়বেতার দোর্দণ্ডপ্রতাপ এবং দাপুটে নেতা। কেশপুর, গড়বেতা, ছোট আঙাড়িয়া নামগুলোর সঙ্গে সমার্থক ছিলেন তিনি। হয়ে গেলেন কঙ্কাল-কাণ্ডের খলনায়ক। ছিলেন তারকা বক্তা। হয়ে গেলেন জেলখাটা অভিযুক্ত। বছর দশেক আগেও তাঁর সভায় জনজোয়ার। স্লোগানের হিল্লোল। এখন আশেপাশে কুল্যে গুটিদশেক পার্টিকর্মী। বিধানসভা ভোটের প্রার্থী হয়ে একাই দৌড়ে বেড়াচ্ছেন গ্রামের আলপথ, মাঠ আর খেতখামারে।
সরকার: মেদিনীপুরের জেলা সম্পাদক দীপক সরকারের মানসপুত্র ছিলেন। তবে এখন রাজ্যে বাম সরকার যেমন নেই, তেমনই দীপকও নিভু নিভু। আলিমুদ্দিনের ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সুশান্তের পটে না। জেলায় সূর্যকান্ত মিশ্র, তরুণ রায়দের সঙ্গেও সম্পর্ক ‘মধুর’। ফলে সরকার-রাজ এখন স্তিমিত। তবে সূর্য-তরুণদের আপত্তি সত্ত্বেও সুশান্তকে পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা কমিটি এবং জেলা সম্পাদকমণ্ডলীতে রেখেছে সিপিএম। ভোটেও দাঁড়াতে বলেছে।
মানে না মানা: তাঁর ‘প্রতিরোধের তত্ত্ব’ মানতে চাননি দলের তাত্ত্বিক নেতারা। কিন্তু সুশান্ত তো সুশান্তই। ও যে মানে না মানা! দলে কোণঠাসা হওয়ার পরেও ডিওয়াইএফআইয়ের বিভিন্ন কর্মসূচিতে গিয়েছেন। প্রকাশ্যেই দলের সমালোচনা করেছেন। এহ বাহ্য, দলীয় নির্দেশ অমান্য করে আরামবাগের প্রয়াত সাংসদ অনিল বসুর স্মরণসভায় চলে যান। দল তদন্ত কমিশন করে। তাতে দলের নির্দেশ অমান্য করা ছাড়াও আয়-বহির্ভূত সম্পত্তি এবং শত্রু শিবিরের সঙ্গে সমঝোতার অভিযোগও ছিল। ছ’মাস সাসপেন্ড করেছিল দল।
বিমান বন্দরে: দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠকে তাঁকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল একবার। খবর পেয়ে সটান বিমান বসুকে গিয়ে বলেছিলেন, ‘‘তাড়াবেন না! বলুন, দল ছেড়ে দিচ্ছি!’’ ভেবেছিলেন, সিপিএম ছেড়েই দেবেন। কিন্তু থমকে যান বিমান এবং অন্য হিতৈষীদের পরামর্শে।
গড়চুমুক: ১৯৮৫ সালে গড়বেতা থেকে প্রথম জিতেছিলেন উপনির্বাচনে। ২০১১ পর্যন্ত সেখান থেকেই টানা জয়ী। কিন্তু এবার তাঁকে শালবনি থেকে ভোটে দাঁড় করিয়েছে সিপিএম। তবে সুশান্ত-গড়ে দল টিকিট দিয়েছে তাঁরই ঘনিষ্ঠ তপন ঘোষকে।
ডাবচুমুক: ভোটের প্রচারে বেরিয়ে দরদর করে ঘামছেন। রুমালে ঘাম মুছছেন। জল খাচ্ছেন। তবে আগের মতো তেষ্টা পেলেই ডাব খাচ্ছেন না। বলছেন, ‘‘বড্ড দাম! এখন তো আর ক্ষমতায় নেই। ডাব-টাব এখন বিলাসিতা।’’ বাড়িতেও এবেলা মুড়ি। ওবেলা ভাত।
সাদা নয়, কাদা চাই: সাদা ঢোলা পাজামা। সাদা আদ্দির পাঞ্জাবি। হাতা কিছুটা গোটানো। এ-ই ছিল ক্ষমতাশালী সুশান্তর পোশাক। সবাই ওই নামেই ‘কমরেড’-কে চিনত। বিধানসভা থেকে চমকাইতলা সর্বত্র সাদার চমক দেখা যেত। এখন রঙিন পাঞ্জাবি পরেন। বেশিরভাগই বেগুনি রংয়ের। বলেন অভাবের কারণে। এমন রঙের পোশাক পরেন, যাতে ধুলোময়লা লাগলেও বোঝা যাবে না। সাদা হলে অনেক ঝক্কি। রোজ কাচো, ধোও, ইস্ত্রি করো!
কলমে কামাল: জেলে থাকাকালীন প্রচুর বই পড়েছেন। জেলেই আলাপ যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত বাবু মিত্রর সঙ্গে। তিনিই খাতির করে বইপত্র এনে দিতেন। জেল থেকে বেরিয়ে ‘কারাবাসের দিনগুলি’ বইয়ে লিখেছেন সেই জেলসঙ্গীর কথা। তার আগে লিখেছেন ‘অন্ধকার সময় : আলোর সন্ধান’, ‘সন্ত্রাসের আড়াই বছর’। আরও বই আছে। কিন্তু ‘বামফ্রন্ট জমানার শেষ দশ বছর’লিখে দলের রোষে পড়ে যান। তবে এখনও মনে করেন তিনি সব ঠিকঠাকই লিখেছেন। কারও সাহস হবে না অমন ‘সত্য’ লেখার। দলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে ধারাবাহিক লেখা শুরু করেও কয়েক কিস্তির পর বন্ধ করে দেন।
মশা মারতে কয়েল দাগা: চন্দ্রকোনা রোডে বড্ড মশা সন্ধ্যার দিকটায়। এক সময় যাঁর কথায় বিস্তীর্ণ এলাকায় বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খেত, তিনি এখন মশা মারতে ‘কয়েল’ দাগেন। কামানটি বোধহয় এখনও মজুত রেখেছেন আদ্দির পাঞ্জাবির হাতার আড়ালে।
তথ্য: পিনাকপাণি ঘোষ। রেখাচিত্র: সুমন চৌধুরী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy