সুতলি বোমায় লাগানো সিগারেট। ভোটের দিন হাওড়ায় ফাটানো হয়েছিল এমনই বোমা। নিজস্ব চিত্র।
লোকজন নেই। নেই কোনও জমায়েত। কিন্তু ফেটে চলেছে একের পর এক বোমা। দুমদাম শব্দে মিনিট দশেক পরপরই ফাটছিল বোমা। পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনী এলাকায় তল্লাশি চালিয়েও কাউকে খুঁজে পাচ্ছিল না। বোঝা যাচ্ছিল না, কারা ফেলছে বোমা। অভিযুক্তদের খুঁজে বার করতে লেগে গিয়েছিল ঘণ্টা দুয়েক।
চতুর্থ দফার নির্বাচনে উত্তর হাওড়া বিধানসভা কেন্দ্রের কয়েকটি এলাকায় সকাল থেকেই শুরু হয়েছিল ভোট। কিন্তু সকাল সাড়ে সাতটায় ভোট শুরু হওয়ার পর থেকেই বোমাবাজির জেরে দিশাহারা হয়ে পড়েছিলেন কর্তব্যরত পুলিশকর্মীরা। বোমাবাজির সেই খবর বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যম মারফত পৌঁছে যায় জাতীয় নির্বাচন কমিশনের কর্তাদের কানে। কমিশনের পর্যবেক্ষকদের ঘন ঘন ফোন আসতে থাকে গোলাবাড়ি থানায়।
হাওড়া পুরসভার ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের ডবসন লেন, হাওড়া বাস স্ট্যান্ড, ডক্টর অবনী দত্ত রোড ও সালকিয়া স্কুল রোডে সকাল সাড়ে সাতটা থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত নাগাড়ে ফেটেছে বোমা।
তদন্তকারীরা জানান, ওই বোমাবাজির সূত্রেই তাঁরা প্রথম শোনেন ‘সিগারেট বোমা’র কথা। হাওড়ার ওই সমস্ত এলাকায় তল্লাশি অভিযান চালিয়ে এই ধরনের বেশ কিছু বোমা উদ্ধার করেছে পুলিশ। সুতলি বোমার সলতের জায়গায় লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল একটি করে সিগারেট। সেই সিগারেটের নীচের ফিল্টারটি ছিঁড়ে ফেলে বোমার গায়ে থাকা ছিদ্রের মধ্যে তা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এর পরে সিগারেটের উল্টো দিকের মাথায় আগুন ধরিয়ে রাস্তার আনাচ-কানাচে তা রেখে যাওয়া হচ্ছিল।
এক তদন্তকারীর কথায়, ‘‘সিগারেটে এক বার আগুন ধরিয়ে দিলে সহজে তা নেভে না। কারণ, সিগারেটের তামাক অ্যালকোহলে ভিজিয়ে শুকনো করার পরেই তা ব্যবহার করা হয়। অ্যালকোহল থাকায় সিগারেটের তামাক না টানলেও নিভে যায় না। আগুন লাগানোর পাঁচ-সাত মিনিট পরে ফাটে সিগারেট-বোমা। কিন্তু বিড়ির তামাকে কোনও রকম অ্যালকোহল থাকে না। তাই ধরানোর পরে না টানলে বিড়ি নিভে যায়।
তদন্তকারীদের কথায়, ‘‘সে দিন সুকৌশলে সিগারেটকে সলতে হিসেবে ব্যবহার করে এলাকায় বোমা ফাটানো হয়েছিল। কেন্দ্রীয় বাহিনীর চোখে ধুলো দিয়ে ওই সমস্ত বোমা ফাটানো হয়।’’ এই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে বেলা ১১টা নাগাদ গোলাবাড়ি থানার পুলিশ দশ জনকে গ্রেফতার করে।
ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায়, স্থানীয় বাজি কারখানায় ওই সুতলি বোমা তৈরি করা হয়েছিল। সকাল থেকেই সিগারেটে আগুন ধরিয়ে বিভিন্ন গলির আনাচ-কানাচে তা রেখে দেওয়া হচ্ছিল। সিগারেটের সলতে পুড়ে আগুন বোমার ভিতরে ঢুকতেই তা ফেটে যাচ্ছিল।
পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনী তল্লাশি অভিযান চালানোর সময়ে বোমা ফাটানো বন্ধ রাখা হচ্ছিল। কিন্তু তারা এলাকা ছাড়ার পরেই ফের সিগারেটে আগুন ধরিয়ে গলির আনাচ-কানাচে চটের বস্তায় ভরে রেখে দেওয়া হচ্ছিল ওই বোমা। এ ভাবেই পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর সঙ্গে ঘণ্টা তিনেক ধরে লুকোচুরি খেলেছিল দুষ্কৃতীরা।
কিন্তু কী ভাবে ধরা পড়ল ওই সিগারেট বোমা? এক তদন্তকারী বললেন, ‘‘বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশির সময়ে কয়েকটি সিগারেট লাগানো সুতলি বোমা উদ্ধার করা হয়। সেই সমস্ত বোমার সিগারেট কোনও ভাবে নিভে গিয়েছিল। তাই সেগুলি ফাটেনি। তাড়াহুড়োয় সিগারেটে ঠিকমতো আগুন ধরাতে না পারায় সেগুলি নিভে গিয়েছিল বলে মনে করা হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের কয়েক জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায়, এলাকার কিছু দুষ্কৃতী সকাল থেকেই ওই ভাবে বোমা ফাটাচ্ছিল। স্থানীয় বাসিন্দাদের সূত্রেই অভিযুক্তদের চিহ্নিত করা হয়।’’ ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায়, ওই সমস্ত এলাকায় প্রচুর অবাঙালি ভোটার রয়েছেন। তাঁদের ভয় দেখানোর জন্যই নাকি ওই বোমা ফাটানো হয়েছিল। যাতে তাঁরা ভয় পেয়ে ভোট দিতে না যান।
নির্বাচনী গন্ডগোলে সাধারণত হাতবোমা ফাটানো হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ওই বোমা ফাটানো হয়নি। কারণ, চার দিকে পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর টহলদারি চলায় হাতবোমা ফাটাতে গিয়ে ধরা পড়ার ঝুঁকি ছিল। সেই কারণেই স্থানীয় বাজি কারখানায় চকলেট বোমার মশলা বেশি করে দিয়ে সুতলি বোমা তৈরি করা হয়েছিল। আর চকলেট বোমার মতোই অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে ফাটানো হয়েছিল সেই বোমা। এক বাজি কারিগরের কথায়, ‘‘হাতবোমা, অর্থাৎ ‘পেটো’ গরমকালে সঙ্গে রাখা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, রোদের তাপে নিজে থেকেই ওই বোমা ফেটে যায়। সে ক্ষেত্রে বড় দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু সিগারেট বোমায় ঝুঁকি অনেক কম। তা ছাড়া, সিগারেট বোমা ফাটলে বিকট কোনও আওয়াজ হয় না। তেমন ধোঁয়াও বেরোয় না। কিন্তু মানুষকে ভয় দেখানোর জন্য ওই বোমার আওয়াজই যথেষ্ট।
চতুর্থ দফার ওই নির্বাচনে বোমাবাজি বন্ধ করে প্রত্যেক ভোটারকে বুথে নিয়ে গিয়ে ভোট দেওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল বলে দাবি করছেন হাওড়া কমিশনারেটের কর্তারা। পাশাপাশি, ওই দিনের বোমাবাজির রিপোর্ট নির্বাচন কমিশনে দিয়েছে হাওড়া কমিশনারেট। কমিশন সূত্রে খবর, পরবর্তী পর্যায়ের নির্বাচনে সব পুলিশ আধিকারিককে সিগারেট বোমার বিষয়ে অবগত করা হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy