ছবি পিটিআই।
মাঝ এপ্রিলের চড়া রোদে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকাই দায়। ইলামবাজারের ধরমপুর অঞ্চলের নান্দার গ্রামের এক আটচালায় মাঠের কাজ সেরে বিশ্রাম নিতে জড়ো হয়েছেন বেশ কয়েক জন। তাঁদেরই এক জন ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, ‘‘২০১৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে আমাদের ভোট দিতে দিল না কেন? এখানকার তৃণমূলের প্রধান তো আমাদের ভোটে নির্বাচিত হননি! সেই রাগ আমার মতো অনেকের রয়েছে।’’
বাস্তব ছবিটা কিন্তু ওই প্রৌঢ়ের বক্তব্যের সঙ্গে মেলে না। এবং সেটাই বীরভূমের ভোটের সবচেয়ে বড় ‘হেঁয়ালি’! ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে ‘রাস্তায় উন্নয়ন দাঁড়িয়ে’ থাকার সুবাদে জেলা জুড়ে ভোট দিতে না পারার ক্ষোভ যেমন সত্যি, তেমন এও সত্যি যে, ঠিক পরের বছরে লোকসভা নির্বাচনে গ্রামের ভোটই বৈতরণী পার করিয়ে দিয়েছিল তৃণমূলকে! প্রধানত যার জোরে গেরুয়া ঝড়েও জেলার দুই লোকসভা আসন ধরে রাখতে সমর্থ হন অনুব্রত মণ্ডলেরা। এ বারও জেলা জুড়ে নানা হেঁয়ালি। শাসকদলের উন্নয়ন বা ‘দুয়ারে সরকার’-এর মন খুলে প্রশংসা যে মানুষগুলো করছেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশংসায় যাঁরা মুক্তকণ্ঠ, তাঁরাই আবার শোনাচ্ছেন দুর্নীতি, কাটমানি, নিচুস্তরের নেতাদের ‘দাদাগিরি’ নিয়ে ক্ষোভের কথা।
২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে এই জেলায় বিজেপি দাঁত ফোটাতে না পারলেও, গত লোকসভা ভোটের পরে বহু গ্রামে মাথা তুলেছে পদ্মফুল। মূলত, বামের ভোট রামের ঘরে যাওয়ার সুবাদে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই জেলার ১১টি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে পাঁচটিতে বিজেপি এগিয়ে যায় তৃণমূলের থেকে। বেশির ভাগটাই পুর-শহর, সিউড়ি, সাঁইথিয়া, দুবরাজপুর এবং রামপুরহাট। তেমনই এই লোকসভারই সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এবং গ্রামীণ অঞ্চল মুরারই, হাঁসন ও নলহাটিতে বিজেপি-র চেয়ে অনেক বেশি ব্যবধানে এগিয়েছিল তৃণমূল। বস্তুত, ওই তিন কেন্দ্রের দৌলতেই জয়ের ‘হ্যাটট্রিক’ করেছিলেন শতাব্দী রায়। একা মুরারই প্রায় ৭০ হাজার ভোটের ‘লিড’ দিয়েছিল তাঁকে। এই জেলার পরিযায়ী শ্রমিকদের বড় অংশও থাকেন নলহাটি, মুরারইয়ে। “লকডাউনের সময় ও তার পরেও পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে উদ্যোগী হয়েছেন, তা ওঁরা ভোলেননি। ওঁরা আমাদের পাশে থাকবেন বলেই মনে করি’’—বলছিলেন মুরারই ১ ব্লক তৃণমূলের সহ-সভাপতি বিপ্লব শর্মা।
বামেদের অবশ্য আশা, এ বার তাদের ভোট অনেকটাই নিজেদের ঘরে ফিরবে। সেটা তৃণমূলের পক্ষেও স্বস্তির। তাদের আশার আর এক কারণ, বোলপুর লোকসভা আসনের ফল। ২০১৯-এ ওই আসনের ৭টি বিধানসভা কেন্দ্রের ছ’টিতেই তৃণমূল এগিয়েছিল বিজেপি-র চেয়ে। ৭টির মধ্যে চারটি কেন্দ্র বীরভূম জেলায় পড়ে। বোলপুর, লাভপুর, নানুর ও ময়ূরেশ্বর। বাকি তিন আউশগ্রাম, মঙ্গলকোট ও কেতুগ্রাম পূর্ব বর্ধমান জেলায়। একমাত্র ময়ূরেশ্বরেই বিজেপি এগিয়েছিল। জেলা তৃণমূলের সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের ঘনিষ্ঠ নেতা, বোলপুরের সুদীপ্ত ঘোষ তাই বলে দিচ্ছেন, ‘‘বিজেপি যতই তড়পাক, বীরভূমের মাটিতে এখনও তৃণমূল পোক্ত ভাবে দাঁড়িয়ে।’’
বোলপুরে এ বারও প্রার্থী প্রাক্তন মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ। তাঁর বিপক্ষে বিজেপির ‘হেভিওয়েট’ অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়। বোলপুর লাগোয়া নানুর কেন্দ্রে ২০১৬ সালে সিপিএম জিতলেও এ বার পরিস্থিতি কিছুটা আলাদা। ওই হারের পিছনে বরাবর যাঁকে দায়ী করে এসেছেন তৃণমূল নেতাদের একাংশ, সেই বিক্ষুব্ধ নেতা কাজল শেখকে পুরনো বিবাদ ভুলে ভাল পদ দিয়েছেন অনুব্রত। ফলে, নানুর নিয়ে অনেকটাই নিশ্চিন্ত তাঁরা। পাশের কেন্দ্র লাভপুরে অবশ্য অনুব্রতের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী, বিদায়ী বিধায়ক মনিরুল ইসলাম নির্দল প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত এবং লোকসভা ভোটের পরেই বিজেপি-তে যোগ দেওয়া মনিরুল তাঁর ‘খাসতালুকে’ তাঁদের ভোট কিছুটা কাটতে পারেন বলে আশঙ্কা স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের। যদিও এই কেন্দ্রে প্রার্থী, জেলা তৃণমূলের সহ-সভাপতি এবং অনুব্রতের ঘনিষ্ঠতম বৃত্তে থাকা অভিজিৎ সিংহ তা মানতে নারাজ। তাঁর কথায়, ‘‘যাঁর সঙ্গে দু’বছর এলাকার যোগ নেই, তাঁকে নিয়ে ভাবছি না।’’
টিকিট না-পাওয়ায় নির্দল হিসেবে লড়ছেন নলহাটির বিদায়ী বিধায়ক মইনুদ্দিন শামসও। এই লড়াইয়ে নিজেকে ‘ভূমিপুত্র’ হিসেবে প্রতিপন্ন করতে যথাসাধ্য প্রচার চালাচ্ছেন মইনুদ্দিন। তিনি সংখ্যালঘু ভোটে ভাগ বসান কি না, তা দেখার। তৃণমূল নেতৃত্ব যদিও মনে করছেন, ওই ভোটের বেশির ভাগই তাঁদের পক্ষে যাবে।
লোকসভার ফলের নিরিখে নিজের কেন্দ্রে অনেকটা পিছিয়ে থাকা বর্ষীয়ান তৃণমূল নেতা আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় রামপুরহাট বিধানসভা এলাকা জুড়ে লাগাতার ছুটেছেন। চার বারের বিধায়ক, বিদায়ী কৃষিমন্ত্রীর দাবি, ‘‘রামপুরহাটের কী উন্নয়ন করেছি, তা সকলে জানেন। গ্রামাঞ্চলে দুয়ারে সরকার, স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনমুখী বিভিন্ন প্রকল্পের সুবিধাও মানুষ পাচ্ছেন। তাই তাঁরা উন্নয়নের পক্ষেই রায় দেবেন।’’ বিজেপি প্রার্থী শুভাশিস চৌধুরীর আবার দাবি, ‘‘পুরসভা ও তারাপীঠ রামপুরহাট উন্নয়ন পর্ষদের উন্নয়নের নামে টাকা নয়ছয়, পুরসভায় বেআইনি ভাবে কর্মী নিয়োগ, স্বজনপোষণ, বালি, পাথর থেকে তোলাবাজি এ সমস্ত কিছুই মানুষ দেখেছেন। তৃণমূলের এ বারও আশা নেই।’’
জয় নিয়ে একই দাবি সিউড়ি কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়ের। বিজেপি-র প্রার্থী তালিকা প্রকাশের কয়েক ঘণ্টা আগে সংবাদপত্রের চাকরি ছেড়ে ওই দলে যাওয়া জগন্নাথ বলছেন, ‘‘আমি আদতে সিউড়ির ছেলে। সেটাই সবচেয়ে বড়। বহিরাগত বিধায়ক অনেক দেখেছেন সিউড়ির মানুষ।’’ যা শুনে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী, সিউড়ির তৃণমূল প্রার্থী এবং জেলা পরিষদের সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরী বললেন, ‘‘আমি বহিরাগত হতে যাব কোন দুঃখে! আমি তো গোটা জেলার সভাধিপতি। সিউড়িতে থেকেই গোটা জেলার উন্নয়নের কাজ করেছি।’’ এই কেন্দ্রেই লড়ছেন সিউড়ির আর এক ‘ঘরের ছেলে’ কংগ্রেসের চঞ্চল চট্টোপাধ্যায়। কাজের মানুষ বলে পরিচিত চঞ্চল না তাদের ভোটে ভাগ বসান, চিন্তায় শাসকদল। চঞ্চলের কটাক্ষ, ‘‘তৃণমূলের প্রার্থী বহিরাগত, বিজেপি-র ভোটপাখি।’’
লোকসভার ফলের নিরিখে আত্মবিশ্বাসী দুবরাজপুরের বিজেপি প্রার্থী অনুপ সাহাও। বলছেন, ‘‘নিশ্চিত জিতছি।’’ তাঁর দাবি, শাসকদলের দাপট, দুর্নীতি, উন্নয়ন না-হওয়া, খয়রাশোলের খুনোখুনি দেখে মানুষ বিরক্ত। তাঁরা ‘বদল’ চাইছেন। এটা ঘটনা যে দুবরাজপুর কেন্দ্রের আওতায় থাকা খয়রাশোল ব্লকে লোকসভায় ১৫ হাজার ভোটে পিছিয়ে ছিল তৃণমূল। সেই খয়রাশোলেরই নেত্রী অসীমা ধীবরের নাম প্রথমে ঘোষণা করা হলেও দলের একাংশের ‘বিরোধিতায়’ প্রার্থী বদল করতে হয়েছে তৃণমূল নেতৃত্বকে। তাতে অসীমাদেবী প্রবল ক্ষুব্ধ বলেই ভিতরের খবর। তাঁর জায়গায় যিনি প্রার্থী, পেশায় কলেজ শিক্ষক সেই দেবব্রত সাহার বক্তব্য, ‘‘বিজেপি-র হাতে কি পরশপাথর আছে, যে ওরা যা ছোঁবে তাই সোনা হবে? বরং ওদের সরকারের জন্য মানুষ খাওয়াদাওয়াই ভুলতে বসেছে।’’
শেষ দফায়, বৃহস্পতিবার এই জেলায় ভোট কে কাকে কেন দেবেন, গ্রাম-শহরের ‘হেঁয়ালি’-তেই বোধহয় লুকিয়ে তার জবাব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy