ছবি পিটিআই।
গত ৯ ফেব্রুয়ারি। লালগড়ে বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জগৎপ্রকাশ নড্ডার সভা। মঞ্চে উঠে বাংলাভাষী এক নেতা বললেন, ‘‘নড্ডাজি জঙ্গলমহলে পরিবর্তন যাত্রার সূচনায় আসায় তাঁর প্রতি আভার প্রকট করছি।’’ উনি কৃতজ্ঞতা জানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ‘আভার প্রকট’-এর মানে না বুঝে কর্মী-সমর্থকদের অনেকেই তখন মুখ চাওয়াচাওয়ি করছেন।
নড্ডার সেই সভায় মাঠ ভরেনি। লোক না হওয়ায় সে দিন ঝাড়গ্রামের সভাও বাতিল করতে হয়। গত লোকসভায় জঙ্গলমহল জুড়ে পদ্ম ফোটার পরে কেন এই পরিস্থিতি, তার ময়নাতদন্তে ওড়িশা থেকে তারপরই ঝাড়গ্রামে এসেছেন বিজেপির পাঁচ সদস্যের কেন্দ্রীয় দল। কিন্তু তাঁদের কাজেও বাধা সেই ভাষা। জেলা কার্যালয়ের বৈঠকে তাঁরা বিভিন্ন মণ্ডলের নেতা সঙ্গে সাংগঠনিক আলোচনা করছেন হিন্দিতে। অথচ আদিবাসী-জনজাতি অধ্যুষিত প্রান্তিক এলাকার বিজেপি নেতাদের বেশিরভাগই হিন্দিতে সড়গড় নন। ফলে, দু’তরফেই ধোঁয়াশা থাকছে।
গত লোকসভা ভোটের সময়ও নরেন্দ্র মোদী, নির্মলা সীতারামনের মতো নেতা-নেত্রী ঝাড়গ্রামে সভা করে গিয়েছেন। কিন্তু এত ঘনঘন ভিন্ রাজ্যের নেতাদের আনাগোনা তখন ছিল না। মূল দায়িত্ব যাঁদের ঘাড়ে ছিল, সেই বাংলার নেতারাও চেনা বাংলাতেই বক্তৃতা করতেন। কিন্তু এখন তাঁরাই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ঢঙে আধা হিন্দি লব্জ ব্যবহার করছেন যা আদিবাসী-মূলবাসীদের কাছে অচেনা ঠেকছে। লালগড়ের এক বিজেপি নেতা মানছেন, ‘‘ভাষা বিভ্রাটে আগ্রহ অনেকক্ষেত্রেই মাটি হয়ে যাচ্ছে। লোকে হেলিকপ্টার দেখে বাড়িমুখো হচ্ছে।’’ ঘাটাল বিধানসভার এক শক্তিকেন্দ্র প্রমুখের আক্ষেপ, “ক’দিন আগে কেন্দ্রীয় এক নেতার বৈঠকে গিয়েছিলাম। উনি কী চাইছেন বুঝছি। কিন্তু আমরা কী চাইছি, বোঝাতে পারছি না। সমস্যা এখানেই।”
মাস খানেক আগে কেন্দ্রীয় জাহাজ মন্ত্রী মনসুখ লক্ষ্মণভাই মাণ্ডব্য এসেছিলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুরে, ‘গৃহ সম্পর্ক অভিযানে’। বাড়ি বাড়ি ঘুরে মন্ত্রী জানতে চেয়েছিলেন, কেন্দ্রীয় সরকারের কাজে মানুষ খুশি কি না। হিন্দিতে করা প্রশ্ন সে দিনও অনেকে বোঝেননি। নড্ডার সভাতেও উত্তরপ্রদেশের উপ-মুখ্যমন্ত্রী কেশবপ্রতাপ মৌর্যের উত্তরভারতীয় হিন্দি অনেকেরই বোধগম্য হয়নি। অথচ কেশবপ্রতাপ আগামী ভোটে বিজেপির হুগলি-হাওড়া-মেদিনীপুর জ়োনের দশটি জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত পর্যবেক্ষক। ফলে, প্রশ্ন উঠছে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা যদি মাটির ভাষাই না বোঝেন, সেই ভাষায় কথা বলতে না পারেন, তাহলে মানুষের মন পড়বেন কী করে?
তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক ছত্রধর মাহাতোর কটাক্ষ, ‘‘বহিরাগত কেন্দ্রীয় নেতাদের এনে ওরা যতই ‘আভার প্রকট’ করুন তাতে কোনও লাভ হবে না। মুখে সোনার বাংলা গড়ার কথা বললেও ওদের বাংলা ভাষা প্রয়োগেই স্পষ্ট, ওরা বাংলার সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে চায়।’’ বিজেপি নেতৃত্ব অবশ্য সমস্যা মানতে নারাজ। দলের তরফে মেদিনীপুর জ়োনের দায়িত্বপ্রাপ্ত তথা সাংসদ জ্যোতির্ময় সিংহ মাহাতো বলেন, ‘‘হিন্দি ভাষাটা কোনও অন্তরায় নয়। আম বাঙালি কম-বেশি হিন্দিটা বোঝেন।’’ বিজেপি-র ঝাড়গ্রাম জেলা সভাপতি সুখময় শতপথী জুড়ছেন, ‘‘বিজেপি সর্বভারতীয় দল। আমাদের দলে বিভিন্ন ভাষাভাষী নেতা রয়েছেন। আঞ্চলিক দল তৃণমূলের বাঙালি নেতা ছাড়া অন্য কোনও নেতা নেই বলেই গাত্রদাহ হচ্ছে।’’ বাংলায় অহরহ হিন্দি শব্দবন্ধ ব্যবহার প্রসঙ্গে সুখময়ের বক্তব্য, ‘‘তৃণমূলকে ভাষার ইতিহাসটা জানতে হবে। কোনটা সংস্কৃত, কোনটা হিন্দি সেটা বুঝতে হবে।’’
ঝাড়গ্রামের প্রবীণ মানুষজন বলছেন, কংগ্রেস আমলেও দিল্লির তাবড় নেতারা এসে হিন্দিতেই বক্তৃতা করেছেন। কিন্তু অনুবাদের ব্যবস্থা থাকায় সমস্যা হয়নি। এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকার কথায়, ‘‘১৯৮৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে ঝাড়গ্রাম শহরের জামদা সার্কাস মাঠে সভা করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধী। রাজীবের হিন্দি বক্তৃতা সঙ্গে সঙ্গে বাংলায় তর্জমা করেছিলেন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সী।’’
(সহ-প্রতিবেদন: অভিজিৎ চক্রবর্তী)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy