অর্জুন, তুমি অর্জুন: বলেন, বাবা-মা অর্জুনের নামেই নাম রেখেছিলেন। ‘সব্যসাচী’ শব্দের অর্থ যার দু’হাতই সমান চলে। যদিও রাজনীতির সব্যসাচীর ক্ষেত্রে সেটা সত্যি নয়। দু’হাতে মানুষের সেবা করার দাবি করেন। কিন্তু দু’হাতে খাওয়া বা লেখার দাবি করেন না। তবে দু’হাত এক সঙ্গে না চললেও তৃণমূল থেকে বিজেপি-তে যোগদানের আগে নাকি তাঁর দু’পা দুই নৌকাতেই ছিল বলে অভিযোগ করেছিল তৃণমূল।
প্রাক্তন ল্যাম্প পোস্ট: তৃণমূল এখন অতীত। তবে সেই সময়ে ল্যাম্প পোস্ট ছিলেন বলে দাবি করেন। বিজেপি-তে এসে আপ্লুত। নির্বাচনে প্রার্থী করার পাশাপাশি রাজ্য স্তরের দায়িত্বও মিলেছে। শোনা যায়, তৃণমূলে থাকাকালীন বিধাননগরের মহানাগরিক হওয়া নিয়ে অনেক দরাদরি করেছিলেন। স্বীকারও করেন যে, তখন তিন দিন মুকুল রায়ের পিছনে ঘুরে বারবার বলেছিলেন ‘হাফ প্যান্ট’ মন্ত্রী হবেন না। বরং মহানাগরিক হবেন। এখন অবশ্য বলছেন,‘‘নতুন দল যা ভাল বুঝবে করবে।’’
হাফ প্যান্ট সফর: হাফ প্যান্ট মন্ত্রী হওয়া না পসন্দ ঠিকই। কিন্তু একবার হাফ প্যান্টই একমাত্র ভরসা ছিল। এক বন্ধুর সঙ্গে রাঁচী বেড়াতে যাওয়ার পথে ট্রেন থেকে নেমে প্ল্যাটফর্মে বসে বিরিয়ানি খেয়েছিলেন। কামরায় ফিরে দেখেন, সঙ্গের ব্যাগটি আর নেই। গোটা সফর তাই হাফ প্যান্টেই সারতে হয়েছিল। এখনও মনে পড়লে একা একাই হাসেন।
লুচি-আলুরদম: সব্যসাচীর দলবদলের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বাঙালির প্রিয় ছুটির দিনের জলখাবার ‘লুচি-আলুরদম’। সব্যসাচী-জায়া ইন্দ্রাণী আইটেমটা খুবই ভাল বানান বলেই নাকি মুকুল রায় ২০১৯ সালের এক মার্চ-সন্ধ্যায় গিয়েছিলেন সল্টলেকের দত্তবাড়িতে। তার পর থেকেই লুচি-আলুরদম ঘিরে আবর্তিত হতে থাকে বাংলার রাজনীতি। একরকম ‘কোড’-ই হয়ে গিয়েছিল শব্দযুগল। কেউ কারও বাড়িতে লুচি-আলুরদম খেতে গেলেই তার গন্ধবিচার শুরু হত। তবে সব্যসাচীর কথায়, তাঁর বাড়িতে যে কোনও অতিথি এলেই তাঁকে আপ্যায়ন করা হয়। ‘লুচি আলুরদম’-এর কোনও বিশেষত্ব নাকি নেই।
রান্নায় কান্না: খেতে ভালবাসলেও কোনওকালে হেঁসেলে ঢোকেননি। কস্মিন কালে ঢোকার ইচ্ছেও নেই। চা’টুকুও বানাতেও পারেন না। খুব বেশি হলে গরম জল। দরকারই বা কী? বাড়িতে গিন্নির কাছে ‘এটা করে দাও, ওটা করে দাও’ বায়না করলেই তো সব মিলে যায়। বউয়ের হাতের ফ্রায়েড রাইস, চিলি চিকেনও নাকি দারুণ! তবে রোজ রোজ ভালমন্দ পদের জন্য বাড়িতে রান্নার বাঁধা ঠাকুর রয়েছেন। আর মায়ের কাছে আব্দার মানে স্রেফ সেদ্ধভাত। সঙ্গে একটা হাফ বয়েল্ড ডিম হলেই কেল্লাফতে।
সবার উপর বিরিয়ানি সত্য: সব্যসাচী মনে করেন সবার উপরে বিরিয়ানিই সত্য। তাহার উপরে নাই। একটা সময়ে মাসে ৩০ দিনই বিরিয়ানি খেতেন। চাইনিজে রুচি আছে। কিন্তু বিরিয়ানির সঙ্গে কোনও তুলনা হবে না। বিরিয়ানির মাহাত্ম্য নিয়ে গল্পও আছে। পেটুক সব্যসাচী তখন হাজরা ল’ কলেজের ছাত্র। মারাত্মক পেট খারাপ। শুধু যাওয়া-আসা, শুধু স্রোতে ভাসা। ১২-১৩ বার যাতায়াত হয়ে যাওয়ার পর এক বন্ধুর পরামর্শে ডাক্তারখানায় গেলেন। কিন্তু সেখানে আবার লম্বা লাইন। নাম আর ডাকে না। শেষে ডাক্তারখানা থেকে বেরিয়ে রাস্তার ধারের দোকানে গিয়ে খেয়ে নিলেন হাঁড়ির একেবারে তলার দিকে থাকা তেল জবজবে এক প্লেট বিরিয়ানি। বন্ধুরা ধরে নিয়েছিলেন, এ বার নিশ্চিত গন্তব্য হাসপাতাল। কিন্ত ওই বিরিয়ানিই নাকি ছিপি এঁটে দিয়েছিল! টাইট করে। বয়স হওয়ায় চিকিৎসক বন্ধুদের পরামর্শে কমাতে হয়েছে বিরিয়ানি ভোজ। তা নিয়ে যথেষ্ট আক্ষেপ রয়েছে। তবে একটা রক্ষা— গিন্নি ইন্দ্রাণী ঘি ছাড়া একটা ‘স্পেশাল বিরিয়ানি’ বানাতে জানেন। আইন বাঁচিয়ে তাতেই কব্জি ডোবান বিধাননগরের প্রাক্তন মহানাগরিক।
আকাশ কেন ডাকে: রাজনীতিতে আসার কোনও পরিকল্পনা কখনওই ছিল না। কী করে যেন হয়ে গেল! কলেজ জীবন থেকেই ইচ্ছে ছিল পাইলট হবেন। সব ঠিকঠাকও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু প্রশিক্ষণে যাওয়ার জন্য বাড়ির অভিভাবকদের ‘বন্ড’-এ সই করার নিয়মেই বিষয়টা কেঁচে গেল। দিদিমা রাজি হননি। সব্যসাচীর আকাশে ওড়াও হয়নি। এখন বিমানের যাত্রী আসনে বসলেই পাইলট হওয়ার স্বপ্নটা খানিক খোঁচা মারে। তবে রাজনীতিকের জীবন নিয়ে কোনও আক্ষেপ নেই।
সাদা-কালো: সব্যসাচী দত্ত মানেই সাদা পোশাক। ভোটের প্রচারে সাদা কুর্তা-পাজামা। কিন্তু তা ছাড়া বারো মাস ৩৬৫ দিন কালো ট্রাউজার্স-সাদা শার্ট। এটা খিদিরপুর সেন্ট টমাস স্কুলের ইউনিফর্ম। সেই ছেলেবেলা থেকেই ওই সাদা-কালো পোশাকটা পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। এখনও পছন্দ বদলায়নি। রঙিন পোশাক যে একেবারেই পরেন না, তা নয়। তবে একেবারেই কচিৎ কদাচিৎ।
বাপরে কী ডানপিটে: গাছ বাইতে বেজায় ভালবাসতেন। রাজনীতিতে উপরের দিকে ওঠার প্রশিক্ষণটা সম্ভবত শুরু হয়েছিল গাছে চড়ার অভ্যাস থেকেই। ছোটবেলায় এর বাড়ির পেয়ারা, ওর বাড়ির আম চুরিতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তখন দু’হাতই সমানে চলত। ডানপিটে বন্ধুদের দলের পাণ্ডা ছিলেন তিনিই। একবার পেয়ারা চুরি করতে গিয়ে গাছে চড়ার পর সে বাড়ির লোক দেখতে পেয়ে উপর থেকে গায়ে গরম জল ঢেলে দিয়েছিল। ভয়ে লাফ দিয়ে মাটিতে নেমেছিলেন। গরম জল থেকে বাঁচলেও হাত ভেঙেছিল।
শিব-শিব: এখন আর মন খারাপ করারও সময় পান না। তবে মন খারাপ যে একেবারে হয় না, তা-ও নয়। সেই সময়গুলোয় টিভি চালিয়ে রিমোট হাতে একটার পর একটা চ্যানেল ঘোরাতে থাকেন। ঘোরাতে ঘোরাতেই কোনও সিনেমায় আটকে যান। তবে একটা সময়ে মন খারাপ হলে চলে যেতেন বিধাননগরের লাগোয়া ভেড়ির কাছে একটি শিবমন্দির চত্বরে। শান্ত জায়গা। একা গিয়ে চুপচাপ করে বসে থাকতেন। এখন আর হয় না। এত লোকে চিনে গিয়েছে যে একা একা যাওয়া মুশকিল! ওই শিব-সঙ্গটা খুব মিস্ করেন।
ড্রিম গার্ল: নাহ্, হেমা মালিনী নন। এক এবং একমেবাদ্বিতীয়ম মাধুরী দীক্ষিত। স্বপ্নসুন্দরীও তিনি। প্রিয় নায়িকাও তিনি। সেই যুবক কাল থেকে অধরা মাধুরীতে মোহিত। রেখার অভিনয় ভাল লাগে। কিন্তু অনন্তযৌবনার সৌন্দর্য তাঁকে টানে না। বরং বলেন, রেখা দেখতে মোটেও ভাল না। হিরো একজনই— অমিতাভ বচ্চন। সবার উপরে। তবে আমির, সলমন, অক্ষয়দের কিছু কিছু ছবিও খুব টানে।
টিকিট ফাঁকি: তখন শিয়ালদহ থেকে উল্টোডাঙা স্টেশন পর্যন্ত লোকাল ট্রেনের ভাড়া ছিল ২ টাকা। কিন্তু একদিন টিকিট কেটে সেটা দেখিয়ে দিনের পর দিন ট্রেনে চড়তেন। একবার ধরা পড়ে যান। ফাইনের ৫০ টাকাও পকেটে ছিল না। স্কুল পর্যন্ত নালিশ পৌঁছেছিল।
প্যালেসের নিজাম: ছেলেবেলায় বাবার পিটুনি খেয়েছেন। কিন্তু কলেজে ঢুকতে অন্যদের মতোই ডানা গজিয়েছিল। তখন সিটি কলেজের ছাত্র। রাজনীতি শুরু করেছেন। একদিন বাবা রাত ৯টার মধ্যে বাড়ি ঢুকতে বলেছিলেন। কিন্তু যথারীতি দেরি হয়ে যায়। যৎকিঞ্চিৎ প্রহার-সহ বাবা কড়া নির্দেশ দেন, ‘‘যেখানে ছিলে সেখানেই যাও!’’ যৌবনের রাগ দেখিয়ে সাইকেল নিয়ে সোজা বন্ধুর বাড়ি। রাত কেটেছিল নিজাম প্যালেসে প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির নামে ‘বুক’ করা ঘরে আরামে শুয়ে। ওদিকে বাড়ির লোক ততক্ষণে কেঁদেকেটে একাকার। তার পর থেকে বাবার হাতে আর মার খাননি।
নর্দমায় নিরুদ্দেশ: বরাবর ইস্টবেঙ্গলের সমর্থক। তবে এখন লাল-হলুদের পাশাপাশি মহামেডান ক্লাবের পরিচালন কমিটিরও সদস্য। এখনও পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে। খেলা দেখতে গিয়ে ময়দানে ঘোড়াপুলিশের মার খেয়েছেন অনেক। শেষে একটা উপায় বার করেছিলেন। গড়ের মাঠের পাশে নর্দমায় শুয়ে পড়লে পুলিশ আর মারতে পারত না।
তথ্য: পিনাকপাণি ঘোষ, রেখাচিত্র: সুমন চৌধুরী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy