ফাইল চিত্র।
সাড়ে তিন বছর পরে কপালের বলিরেখাটা আরও স্পষ্ট। চেহারা কিছুটা ভারী হয়েছে। আগের মতো হুট করে আর চড়াই ভাঙেন না। ধীরেসুস্থে এগিয়ে আস্তে কথা বলার রীতিটাও যেন অজ্ঞাতবাসে রপ্ত করেছেন। কখনও হাতে লাঠির দেখাও মিলেছে। পাহাড় থেকে তরাই, ডুয়ার্স মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে পুজো করছেন। প্রচারও। কখনও আবার লাঠি হাতেই পাকদণ্ডী বেয়ে উঠে পৌঁছে যাচ্ছেন ছোট্ট বসতিতে। চা হাতে বসে শোনাচ্ছেন নিজের কথা। কখনও গাছতলায় প্যান্ডেল খাটিয়ে চলছে প্রচার। চা বাগিচা, সিঙ্কোনা বাগানে গোর্খা, আদিবাসীদের সঙ্গে পা মিলিয়ে ঢুকে পড়ছেন ছোট ছোট শ্রমিক মহল্লায়। রাত অবধি খোলা থাকছে তাঁর পাতলেবাসের পার্টি অফিস।
এমন বিমল গুরুংকে শেষ কবে দেখেছে পাহাড়? বা আদৌ দেখেছে কি? বদলেছেন গুরুং। শুধু কাকভোরে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাসটা বাদ দিলে অনেক কিছুই তাঁর জীবনে নতুন। কমিয়েছেন লবণ চা খাওয়া। ঘাম ঝরাচ্ছেন এবং তা মুছতে সঙ্গে থাকছে তোয়ালে। করোনার দাপটে চারপাশে ভিড় কমেছে। আগে সন্ধ্যার পরে আর বার হতেন না। এখন গভীর রাত অবধি ঘুরছেন, বৈঠক করছেন। বদলেছে তাঁর সমর্থনের ফুলও। ১৪ বছর পদ্মের সঙ্গে ঘরে করে এ বারে কেন নিঃশর্তভাবে ঘাসফুলের পাশে এসেছেন, তা বোঝাতেই ব্যস্ত তিনি।
এ বার এমনই পরীক্ষায় গুরুং।
পাহাড়ের লোকজন বলছেন, ২০০৯ সালে তাঁর হাত ধরে প্রথম কোনও জনপ্রতিনিধি জেতেন। লোকসভা আসনে জয় পেয়েছিলেন বিজেপির যশোবন্ত সিংহ। তার পর থেকে এত কঠিন পরীক্ষায় সম্ভবত কখনও বসতে হয়নি গুরুংকে। দু’বছর আগে লোকসভা ভোটে যখন তিনি ফেরার ছিলেন, তখনও তাঁর বরাভয় পেয়েই নীরজ জিম্বা আর রাজু বিস্তা পাহাড় প্রমাণ বাধা টপকাতে পেরেছিলেন, এমনই মনে করা হয়েছিল তখন।
পরীক্ষাটা কেমন? ২০১৭ সালে অন্তর্হিত হওয়ার আগে কয়েক হাজার মানুষের সমাবেশ না হলে সামনেই আসতেন না গুরুং। কম করে ৫০ জন গোর্খাল্যান্ড পার্সোলান বা জিএলপি তাঁকে ঘিরে থাকতেন। এখন সেই মোর্চা নেই। দলে ভাগ বসিয়েছেন বিনয় তামাং। ভাগ হয়েছে ভিড়ও। সিংমারির পার্টি অফিসের মুখগুলির অনেকেই জজবাজারের বিনয়ের অফিসে। গত কয়েক মাসে গুরুংয়ের সঙ্গ ছেড়ে কয়েক জন গিয়েছেন বিজেপিতেও।
এই অবস্থায় ‘একচ্ছত্র অধিপতির’ তকমাটা ধরে রাখাই সব থেকে বড় পরীক্ষা গুরুংয়ের। তাতে বিনয় তামাং, অনীত থাপাদের মতো বিজেপি-জিএনএলএফ জোটের প্রার্থীর বিরুদ্ধেও লড়তে হচ্ছে তাঁকে। ত্রিমুখী এই যুদ্ধে প্রচারের ফাঁকে গুরুং বলছেন, ‘‘আমি কেউ না। আমার আর কিছু চাই না। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আমার লড়াই। মিথ্যাচারী, দুর্নীতিবাজ এবং ভাঁততাবাজদের বিরুদ্ধে লড়াই। দিদিকে মুখ্যমন্ত্রীর করার লড়াই।’’
গত ১৪ বছরে গোর্খাল্যান্ড বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল তো দূরের কথা, স্থায়ী সমাধানে সঠিকভাবে বৈঠক বা ১১ জনজাতির তফসিলি স্বীকৃতিও অবধি পায়নি পাহাড়। এই অপ্রাপ্তির জায়গায় কিন্তু দুই মোর্চাই এক। দু’পক্ষই বলছে, বিজেপি শুধু প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিন দফায় সাংসদ নিয়েছে, এক দফায় বিধায়কও। দুই শিবিরের তফাৎ একটাই। গুরুং যখন সাড়ে তিন বছর পর এসে নিজেকে প্রমাণ করতে নেমেছেন, তখন বিনয় তামাংরা তৃতীয় বারের পরীক্ষায় পাশের আশায় ময়দানে। বিনয় শিবিরের তিন প্রার্থীই তরুণ প্রজন্মের। আর গুরুংয়ের? পুরনো পোড়খাওয়া তিন সহকর্মী।
গুরুং সঙ্গ ত্যাগের পরে বিনয় এখনও কোনও ভোটে জেতেননি। তবু তাঁর পার্টি অফিসে লোকজনের ছড়াছড়ি। তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্য ছাড়াও সকাল থেকে রাত বিনয়-অনীত দু’জনই পাহাড়ের চা বাগান থেকে গ্রাম, ওয়ার্ড থেকে ব্যবসায়ীদের বৈঠক, সিঙ্কোনার মিটিং থেকে সরকারি কর্মীদের নিয়ে আলোচনা, বাদ রাখছেন না কিছুই। ২০১৭ সালে পাহাড়ের আগুন নেভানো, জিটিএ-র মাধ্যমে উন্নয়নের কাজ জারি রেখে নতুন চিন্তা ও নতুন দিশার দার্জিলিঙের কথা বলছেন বিনয়। জীবনে প্রথমবার হোলির উৎসবে যোগ দিয়ে রং খেলেছেন বিনয়। তিনি বলছেন, ‘‘আমরা নেতিবাচক প্রচারে নেই। আমরা উন্নয়ন আর শান্তিতে বিশ্বাসী। মানুষকে বলছি, তিন বছরে শান্তিতে আছে পাহাড়। বিকাশ হচ্ছে। তা জারি রাখতে হলে আমাদের হাত শক্ত করুন।’’
বিনয়েরা পেয়েছেন বাঁশি প্রতীক। পাহাড়ের অলিগলিতে বাজছে সেই বাঁশি। সেখানে গুরুংকে দার্জিলিঙে টিভি, কার্শিয়াং ও কালিম্পঙে টেবিল প্রতীক নিয়ে লড়তে হচ্ছে। এই দুই শিবিরের টানাটানির মাঝে পাহাড়ে অতীতের ধারা বজায় রেখে পদ্ম বাঁচিয়ে রাখতে মরিয়া গেরুয়া শিবির। তাদের জোট শরিকের সঙ্গে এখনও সম্পর্ক পুরোপুরি সহজ নয়। জিএনএলএফের একটা অংশের প্রার্থী নিয়ে গোসা রয়েছে। তা কাটানোর চেষ্টায় পদ্ম শিবিরেও রাতদিন কাজ চলছে। কেন্দ্র ও রাজ্যের নেতাদের সঙ্গে সঙ্ঘ পরিবারের ভিড় লেগেই রয়েছে পাহাড়ের আনাচে কানাচে। বিজেপির আশার কথা, ২০০৯ সাল থেকে পাহাড়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকই পদ্ম প্রতীকে ছাপ দেওয়া অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছেন। সেখানে বাঁশি বা টিভি চিহ্ন একেবারেই নতুন। তাই দার্জিলিঙের বিজেপি সাংসদ রাজু বিস্তা বলেছেন, ‘‘পাহাড় নিয়ে বিজেপি বরাবর আন্তরিক। পাহাড়েও এ বার পরিবর্তনের লড়াই।’’
শুধু এবারে ময়দানে নেই ঘাসফুল। তিনটি আসন পাহাড়ের মোর্চা সঙ্গীদের জন্য ছেড়েছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘যাঁরা জিতবেন, তাঁরা তৃণমূলের সঙ্গে কাজ করব’— নেত্রীর এই ঘোষণারেও পর দুই মোর্চাকে এক করার চেষ্টা হয়েছে এবং তা বিফলে গিয়েছে। এর মধ্যে পাহাড়ের হাতে গোনা ক্ষমতাসীন তৃণমূলিরা আবার গুরুংকে সমর্থন করেছেন। তাতে ক্ষেপে তরুণ তৃণমূলিরা বিনয়দের সঙ্গে। তাই কালিম্পঙের প্রাক্তন মোর্চা বিধায়ক তথা জন আন্দোলন পার্টির সভাপতি হরকা বাহাদুর ছেত্রী বলছেন, ‘‘বিজেপিকে আমরা চাই না, তা প্রচারও করছি। দুই মোর্চা এক হলে ভাবতেও হত না। কিন্তু এখন ভোট কাটাকাটিতে আবার পদ্ম ফুটলে পাহাড়ের ঘোর বিপদ।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy