প্রতীকী ছবি।
মালদহে একটা গল্প দীর্ঘদিন চালু ছিল। অনেক বছর আগের কথা। এক অকংগ্রেসি নেতা এসেছেন প্রচারে। ভোটারদের সঙ্গে কথা বলছেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘উনি তো আপনাদের বকেন?’’ জবাব এল, ‘‘হ, বুঢ়া বকে।’’ ‘‘গালি দেন?’’ ‘‘হ, গালি দেয়।’’ নেতা বললেন, ‘‘তা হলে এ বার ওঁকে ভোটটা না দিয়ে আমাদের দেবেন।’’ জবাব এল, ‘‘হ, বুঢ়া বললে দিব।’’ ‘বুঢ়া’, অর্থাৎ, আবু বরকত আতাউর গনিখান চৌধুরী তখনও জীবিত।
২০০৬ সালে তিনি মারা যান বঙ্গোপসাগরে সিপিএমকে ছুড়ে ফেলার স্বপ্ন অধরা রেখেই। তার পরে মহানন্দা, ভাগীরথী দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সিপিএমের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে তাঁর দল কংগ্রেস। মালদহে কিন্তু গনি রয়ে গিয়েছেন পর্বত হয়েই। তার উদাহরণ ফের মেলে ২০১৯ সালে, লোকসভা ভোটে গণনার দিন। মালদহ দক্ষিণ কেন্দ্রের একের পর এক রাউন্ড চলছে। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই বিজেপির শ্রীরূপা মিত্র চৌধুরীর সঙ্গে কংগ্রেসের আবু হাসেম খান চৌধুরীর (ডালু)। গনি খানের ছোট ভাই কিন্তু নিরুত্তাপ। বললেন, ‘‘সুজাপুর তো এখনও বাকি আছে!’’ দিনের শেষে এই কেন্দ্র তাঁকে জয়ের দিকে এগিয়ে দিয়েছিল।
এ বারেও সুজাপুরের হাল তাঁর ছেলে ইশা খান চৌধুরীর হাতে রাখতে আগেভাগে ফুরফুরা শরিফে গিয়ে বৈঠক করে এসেছেন ডালুবাবু। কিন্তু আব্বাস সিদ্দিকির দল ভোট না কাটলেও কি গড় ধরে রাখতে পারবেন ডালু-ইশা? নাকি ইতিমধ্যে ভাগ হয়ে যাওয়া উত্তরাধিকারে ঢুকে পড়বে ঘাসফুল?
এই আলোচনা উস্কে দিলেন বিড়ি কারখানার ঠিকাদার ভদ্রলোক। জাতীয় সড়ক থেকে ধুলো উড়িয়ে, আম বাগান, মাছ চাষের দিঘি পেরিয়ে চামাগ্রাম, আনসার শেখদের মহল্লা। আনসার কাজ করেন সৌদি আরবে। সেখান থেকে ছুটি নিয়ে এসেছেন। আত্মীয়ের দোকানের সামনে বসে শোনাচ্ছিলেন বিদেশের গল্প। পাশে জামবাটিতে ঘুগনি দিয়ে মাখা মুড়ি। আনসার বলেন, ‘‘সৌদি আরবে সরকার ঘরে ঘরে গিয়ে করোনার টিকা দিচ্ছে।’’ পাশে জড়ো হয়ে যাওয়া ফতেমা বিবি, রুবেলা বিবি, সাইমা খাতুনদের প্রশ্ন— এখানে কেন এমন হয় না?
ওঁরা সকলে বিড়ি বাঁধেন। গলায় নানা ক্ষোভ: রাস্তা, নিকাশি, পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই কেন? বার্ধক্য ভাতা মেলে না কেন? সাইমা খাতুন, নাসরিন খাতুনদের মতো একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রীরা দাবি করেন, ১৮ বছর হলেও কন্যাশ্রীর টাকা পুরো পাননি।
সেই সময়ে আসেন বিড়ি কারখানার ঠিকাদার। আসেন টোটোচালক, এলাকার বাসিন্দা আর এক বয়স্ক মানুষও। তাঁরা জনে জনে ধরে বলেন, ‘‘তোমরা পাও নাই কেন? বার্ধক্য ভাতার বয়স হয়েছে? এখনও তো মোটে ৪৫ বছর বয়স। এখানে যে দুয়ারে সরকার হয়েছিল, তখন যাওনি কেন?’’ টোটোচালকটি (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) পাশে টেনে নিয়ে গিয়ে বলেন, ‘‘এখানে দাদা এ বারে সবাই দিদিকে ভোট দেবে।’’ কেন? তাঁর কথায়, ‘‘কংগ্রেসকে দিলে লাভ হবে না, বুঝে গিয়েছে লোকজন।’’
সুজাপুরের যমজ বিধানসভা কেন্দ্র বৈষ্ণবনগর। সেখানেও পথ এঁকেবেঁকে গিয়ে ঠেকেছে সীমান্তের কাছে। এখানে ষষানি বাজারে বসে মধ্য দিনেও আড্ডা দিচ্ছেন বাবর আলি, লুৎফর হক, সঞ্জীব সাহারা। গত বার এখান থেকে জিতেছিলেন বিজেপির স্বাধীন সরকার। তার পরে যদিও বিশেষ দেখা মেলেনি তাঁর। তবে ২০১৬ সালে ভাগীরথীর তীরবর্তী বৈষ্ণবনগরে যে জাতপাতগত ভাঙন দেখা গিয়েছিল, এ বারও তার অন্যথা হবে না— জানিয়ে দিলেন তাঁরাই। বললেন, ‘‘আমরা এখানে সবাই মিলেমিশে থাকি। তবে বিভেদের রাজনীতি
শুরু হয়ে গিয়েছে।’’ সিপিএমের পঞ্চায়েত সদস্য হারাধন রজক নিজেই বলেন, ‘‘জোটের হাওয়া এ বারে নেই। বরং এনআরসি ও সিএএ জুজুতে সংখ্যালঘু ভোট এবারে তৃণমূলের দিকে যেতে পারে।’’
হাওয়া তেমন না থাকলে কী হবে, মোথাবাড়িতে আব্বাস সিদ্দিকির প্রার্থী আছে। সেই ‘বন্ধুত্বপূর্ণ লড়াইয়ের’ কাঁটাও জোটকে চিন্তায় রেখেছে। যদিও সিদ্দিকির দলের এক সদস্য, তরুণ রফিকুল ইসলাম বলছেন, ‘‘সিদ্দিকির প্রার্থী জিতবে না মনে করলে আমরা জোটকেই ভোট দেব।’’ অল্প বয়সি ছটফটে ছেলেটি টোটো নিয়ে ছুট দেওয়ার আগে বলে গেলেন, ‘‘প্রয়োজনে আমরা জোটের দিকে এককাট্টা হয়ে যাব। ভোট ভাগ হতে দেব না।’’
কিন্তু ভাগের অঙ্ক কি শুধু আব্বাসের নিজের প্রার্থী আর জোটের মধ্যেই? সংখ্যালঘু এলাকায় ভোট ভাগ হওয়ার সম্ভাবনা তো তৃণমূলের সঙ্গেও। তা হলে বিজেপি বেরিয়ে যাবে না তো? মহি শেখ, প্রসেনজিৎ দাসেরা সেই আশঙ্কাই করছেন। মোথাবাড়ি বাসস্টপ পেরিয়ে আমবাগানের মাঝখান দিয়ে ছোট সড়কটি ধরলে ছায়াঘেরা গ্রামে কিন্তু শোনা যায় এনআরসি, সিএএ। মোথাবাড়ি বাসস্ট্যান্ডে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জন জানান, কিছুটা বিজ্ঞের মতো চশমা আঙুল দিয়ে ঠেলে নিয়ে, ‘‘সমানে প্রচার চলছে তলে তলে, বিজেপি এলে এনআরসি, সিএএ হবে। তাই এই ভোট বেশির ভাগ হয়তো যাবে দিদির দিকেই।’’ রফিকুল তত ক্ষণে টোটো নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছেন।
মোথাবাড়ি যদি হয় সাবিনা ইয়াসমিনের খাসতালুক, তবে মানিকচক সাবিত্রী মিত্রের। গনির পরিবারের পুরনো ঘনিষ্ঠ সাবিত্রী মানিকচকে এ বারে লড়ছেন জীবনের সব থেকে কঠিন লড়াই। অন্য দিকে, ইংরেজবাজারে সাবিত্রীর ‘চির প্রতিদ্বন্দ্বী’, গত বারে হেরে যাওয়া কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরীর কাছে এ বারে সম্মান পুনরুদ্ধারের যুদ্ধ। অসুস্থ সাবিত্রী দীর্ঘ সময় প্রচারে বার হতে পারেননি। তবু তাঁর এলাকার তৃণমূলের লোকজন অঙ্ক কষছেন সেই জাতপাতের নিরিখে। এবং সেই অঙ্কে যদি সাবিত্রীর কোনও আশা থাকেও, কৃষ্ণেন্দুর কাছে লড়াইটা আরও অনেক বেশি শক্ত।
রাত তখন প্রায় ন’টা। তখনও গৌড় মহাবিদ্যালয়ের বড় ফটকের সামনে বসে আছেন শুভজিৎ হালদার, কৌশিক সাহারা। কেউ সদ্য পাশ করে বার হয়েছেন। কেউ এখনও কলেজে রয়েছেন। অন্যদের থেকে শুভজিৎ কিছুটা সপ্রতিভ। বলেন, ‘‘বিষয় তো অনেক আছে। জ্বালানি, নিত্যপণ্যের দাম আকাশ ছোঁয়া। তার প্রতিবাদ তো হবেই ভোটবাক্সে। তবে...’’ সামান্য অপেক্ষা করে তাঁর মন্তব্য, ‘‘জাতপাতের ভিত্তিতে ভোট ভাগ হলে ফল অন্য হবে।’’ এটা কি মহানন্দার দুই পারেই হতে পারে? শুভজিৎ মাথা নাড়েন, হতে পারে।
গনি পরিবারের কয়েক বছর আগে ফাটল ধরিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কোতুয়ালির বাড়িতে এখন মৌসম নুরের আলাদা মহল। তবে তাঁর দুই ছেলেমেয়ে এখনও থাকে ইশার স্ত্রীর কাছে। তাই ভাগের দাগটা রয়েই গিয়েছে। এ বারে সেই দাগটাকে গাঢ় করে ভোট চেয়েছেন মমতা। প্রচার করেছেন মৌসমরা। সর্বোপরি মাথার উপরে আছে বিজেপির ছায়া।
ভোট কি এ বারে ভাগ হবে, যাতে সুবিধা হতে পারে বিজেপিরই? নাকি গনির গড়ে ঘুচে যাবে ‘বুঢ়ার’ মিথ?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy