প্রতীকী ছবি।ফাইল চিত্র।
গ্রামের ভিতর দিয়ে চলে গিয়েছে পিচের পাকা রাস্তা। তার পাশ দিয়েই গিয়েছে গলিপথ। তা অবশ্য পাকা নয়। বরং মাটি আর ঘাস দিয়ে ভরা এবড়োখেবড়ো একটা রাস্তা বলা চলে। পাকা রাস্তার মতোই সেই গলিপথের দু’পাশও ভরে রয়েছে চাষের জমিতে। যার গা ঘেঁষে সেই জমির মাঝ দিয়েই আবার চলে গিয়েছে একের পর এক আলপথ। সূর্য তখন মাঝ আকাশ থেকে অনেকটাই নেমে গিয়েছে। কিন্তু আলপথের ধারে বাড়ির উঠোনে যে আড্ডাটা দুপুরে শুরু হয়েছিল, তার আর শেষ হওয়ার নাম নেই। বরং তখনও সেই আড্ডা থেকে অঙ্ক মেলানোর চেষ্টা চলছে।
আলিপুরদুয়ার বিধানসভার উত্তর সাতকোদালি গ্রামে আরও অনেকের সঙ্গে সেই আড্ডাতেই বসেছিলেন মানু দাস। দীর্ঘদিন যাঁকে তৃণমূলের মিটিং-মিছিলে যেতে দেখা যেত। তবে এখন মানু বিজেপির সভায় যান। তবে কি আপনিও দল বদলালেন? মানতে নারাজ মানু। বললেন, “দিদি আমাদের কত কিছু দিতে চান। কিন্তু স্থানীয় পঞ্চায়েতে বসে থাকা তাঁর ভাইদের তাতে যত আপত্তি। তাই তো আমরা সেই বঞ্চিতই থাকি। মোদীজিও আমাদের অনেক কিন্তু দেবেন বলেন। টিভিতে দেখি। তাই তাদের ভাইরা কেমন হবে, সেটা বুঝতেই একটু-আধটু ওদের সভায় যাচ্ছি।” তার পরও অঙ্ক মিলছে না? এ বার কিন্তু একটু রেগেই গেলেন মানু। বললেন, “দাদা, এটা স্কুলে পড়া সেই পাটিগণিত নয় যে, একটা সূত্রে ফেলেই অঙ্ক মিলিয়ে দেবেন। এটা ভোটের অঙ্ক, যার সূত্র সময়ের সঙ্গে পাল্টায়।’’ একটু থেমে তিনি যোগ করেন, ‘‘আমরা সেই সূত্র খোঁজার চেষ্টা করছি। সূত্র বার হলেই না অঙ্ক মিলবে!”
মানু দাস একা নন। তাঁর মতো আলিপুরদুয়ারের অনেকেই এ বারের ভোটে এই অঙ্ক বোঝার চেষ্টা করছেন।
মূলত চা বলয় অধ্যুষিত জেলা আলিপুরদুয়ার। যার মধ্যে মাদারিহাট, কালচিনি ও কুমারগ্রামে অনেক চা বাগান রয়েছে। সংখ্যায় কম হলেও চা বাগান রয়েছে আলিপুরদুয়ার এবং ফালাকাটাতেও। গত বিধানসভা নির্বাচনে জেলার মাদারিহাট আসনে প্রথম পদ্মফুল ফুটেছিল। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনে জেলার পাঁচটি আসনেই পদ্ম ফোটে। ফলে দুই বছরের ব্যবধানে আর একটি ভোটে সেই একই প্রতিফলন হবে, নাকি চাকা অন্য দিকে ঘুরবে, মূলত সেই অঙ্ক মেলাতেই সূত্র খুঁজছেন ওঁরা।
বিজেপির আলিপুরদুয়ার জেলা সভাপতি গঙ্গাপ্রসাদ শর্মা অবশ্য বলেন, “মুখে নানা সরকারি প্রকল্পের কথা বললেও তৃণমূলের লোকেরা গরিব মানুষকে শুধু শোষণ করেছেন। যাঁরা প্রকল্পের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁদের থেকেও কাটমানি নিয়েছেন। লোকসভা ভোটের মতো এই নির্বাচনেও ওঁরা আবার শিক্ষা পাবেন।” তৃণমূলের জেলা সভাপতি মৃদুল গোস্বামী পাল্টা বলেন, “মিথ্যাচার চালিয়ে গত লোকসভা নির্বাচনে মানুষকে বিভ্রান্ত করেছিল বিজেপি। কিন্তু এই দুই বছরে বিজেপির মিথ্যাচার সবাই বুঝে গিয়েছেন। তাই বিজেপির উচ্ছ্বাস দেখানোর দিন শেষ।”
সাম্প্রতিককালে চা সুন্দরী প্রকল্প-সহ বাগান শ্রমিকদের উন্নয়নের লক্ষ্যে একাধিক প্রকল্প চালু করেছে রাজ্য। জেলার বিভিন্ন বাগানে চা সুন্দরী প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াও চলছে। তার পরেও বিজেপির টিকিটে ফের ভোট লড়তে নামা মাদারিহাটের মনোজ টিগ্গার চোখে-মুখে খুব বেশি চিন্তা ছাপ নেই। অথচ, বিজেপি সূত্রেরই খবর, তাঁকে ফের প্রার্থী করা নিয়ে গেরুয়া শিবিরেই ক্ষোভ রয়েছে। তার উপরে মনোজের বিরুদ্ধে এ বার তৃণমূলের প্রার্থী রাজেশ লাকড়া, যিনি এলাকায় পরিচিত ‘টাইগার’ নামে। চা বলয়ে স্বচ্ছ ভাবমূর্তি টাইগারের। তৃণমূল নেত্রীর মুখেও প্রশংসা শোনা গিয়েছে তাঁর।
কিন্তু টাইগার একটা জায়গাতেই হোঁচট খাচ্ছেন। তিনি নাগরাকাটার বাসিন্দা। অর্থাৎ, মাদারিহাট কেন্দ্রের তো নন-ই, আলিপুরদুয়ারেরও বাসিন্দা নন টাইগার। পাশের জেলা জলপাইগুড়িতে তাঁর ঘর। এই নিয়ে দলের অন্দরেও ক্ষোভ উপচে পড়ে। সেই সূত্রে মনোজেরও দাবি, “মাদারিহাটের মানুষ পরিযায়ী বিধায়ক চান না।” তৃণমূল পাল্টা বলছে, মানুষ কী চান, সেটা ভোটের পরেই বিজেপি প্রার্থী বুঝতে পারবেন। টাইগারও বলছেন, “সব ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয়ে গিয়েছে।”
কালচিনিতে পাসাং লামাকে প্রার্থী করা নিয়েও তৃণমূলের অন্দরে গোষ্ঠী কোন্দল অনেক দিন ধরে। পাসাংয়ের মূল বিরোধী জেলা পরিষদের মেন্টর মোহন শর্মা। কিন্তু তৃণমূলে মোহন শিবিরের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত কালচিনির প্রাক্তন তৃণমূল ব্লক সভাপতি অসীম মজুমদারও মানছেন, সাম্প্রতিককালে চা বাগানের উন্নয়নে রাজ্য অনেক কাজ করেছে। চা সুন্দরী প্রকল্প চালু করা ছাড়াও বাগানের রাস্তা তৈরি কিংবা পানীয় জলের বন্দোবস্তও করেছে। কিন্তু তাঁর প্রশ্ন, “বাগানে রাস্তা ও জলের ব্যবস্থার দায়িত্ব তো বাগান কর্তৃপক্ষের। এটা করে কি রাজ্য মালিকপক্ষকে তোষণ করছে? শ্রমিকদের পিএফ-এর টাকা নিয়ে দীর্ঘদিন চলা দুর্নীতি নিয়ে রাজ্য কেন চুপ?” যদিও মৃদুলের দাবি, তাঁদের সরকারের আমলে পিএফ দুর্নীতি নিয়ে চা বাগান কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ২৭টা এফআইআর হয়েছে।
অঙ্ক কিন্তু তার পরেও বাকি। গত লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের দাবি ছিল, বাম-কংগ্রেসের ভোট বিজেপির ঝুলিতে গিয়েছে। এ বার আলিপুরদুয়ার কেন্দ্রে দেবপ্রসাদ রায় মতো নেতা কংগ্রেস প্রার্থী হওয়ায় এ ক্ষেত্রেও লোকসভা নির্বাচনের পুনরাবৃত্তির সুযোগ থাকছে কি না, সেই প্রশ্নও কিন্তু উঠছে অনেকের মনে। এই অঙ্কের হিসেবও করছেন বহু মানুষ। এর সঙ্গে যোগ করুন ফালাকাটাকে পুরসভা ঘোষণা। ভোটের আগে শুধু ঘোষণা করে দেখানোতেই ক্ষান্ত হননি তৃণমূল নেত্রী, তার পরে দ্রুত পুরসভা গঠন নিয়ে বিজ্ঞপ্তিও বার হয়েছে। অর্থাৎ, আশ্বাসকে কাজে করে দেখানোর চেষ্টা। তাতে কি অঙ্ক বদলাচ্ছে?
ফালাকাটায় জাতীয় সড়কের এক ধারে পরপর দোকান তাঁদের। কারও বইয়ের তো কারও সাধারণ মণিহারি। কাজ সবই হয়েছে, মাথা ঝুঁকিয়ে মেনে নিলেন তাঁরা। তার পরও বললেন, ‘‘কিন্তু হাওয়া অন্যরকম।’’ শুভেন্দু অধিকারীর রথযাত্রায় মানুষের ভিড়ও যেন অঙ্কে বসাচ্ছে অন্য সংখ্যা। যদিও এ সবের পরেও স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব আত্মবিশ্বাসী এই আসন নিয়ে।
এ সব যোগ-বিয়োগেই ঘুরছে আলিপুরদুয়ার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy