গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
এ এক অন্য নন্দীগ্রাম। যার সঙ্গে অতীতের কোনও মিলই নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শুভেন্দু অধিকারী পুরনো সমস্ত সমীকরণ ভেঙে দিয়েছেন। প্রথম জন অঙ্ক কষে বড়সড় ঝুঁকি নিয়েছেন। সেই ঝুঁকিকে হার মানাতে দ্বিতীয় জন হাতে তুলে নিয়েছেন মেরুকরণের তাস। ভোটপ্রচারের শেষ দিন পর্যন্ত দু’জনের উদ্যমে কোথাও কোনও ঘাটতি ছিল না। এক ইঞ্চি জমিও কেউ কাউকে ছেড়ে দিতে নারাজ। নীলবাড়ির লড়াইয়ে ‘হাইভোল্টেজ’ আসন নন্দীগ্রাম ঘুরে দু’পক্ষের নানাবিধ কৌশল, তার ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিক নজরে এসেছে। আর সে সবের মধ্যেই রয়েছেন তৃতীয় পক্ষের মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়। প্রধান দু’পক্ষই তাকিয়ে, মীনাক্ষী অপর পক্ষের ভোট কিছুটা কেটে নেবেন, আর তাতে তাদের সুবিধা হবে।
গোপন ডেরায় বসে নন্দীগ্রামের পুরনো ও নতুন সমীকরণ ভাঙা-গড়ার কথা বলছিলেন ১৪ বছর আগের জমি আন্দোলনের অন্যতম মুখ আবু তাহের। পুরনো মামলার কারণে সম্প্রতি তৃণমূলের এই নেতার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। তাই আপাতত গোপন ডেরায়। তাহেরের মতে, মমতা জেনেশুনে অনেক অঙ্ক কষে একটা ঝুঁকি নিয়েছেন। তৃণমূল থেকে বিজেপি-তে যাওয়া সব চেয়ে বড় ‘নাম’ শুভেন্দুর চেনা ময়দানে বিজেপি-কে হারানোর চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন। মমতা যখন প্রার্থী হবেন বলে ঘোষণা করেন, তখন বিজেপি তাদের প্রার্থিতালিকা ঘোষণা করেনি। পরে ঘটনাচক্রে, সেই শুভেন্দুকেই বিজেপি নন্দীগ্রামে প্রার্থী করে। ফলে আসন হিসেবে মমতার কাছে ‘অচেনা নন্দীগ্রাম’ থেকে ‘ম্যাচ বার করা’র চেষ্টা আসলে রাজ্য জুড়ে একটা বার্তা পৌঁছনোর হাতিয়ার। তাহেরের কথায়, ‘‘মমতার এই চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে অন্য কোনও রাস্তা না পেয়ে বিজেপি মেরুকরণের রাস্তা নিয়েছে। ধর্মের ভিত্তিতে তীব্র মেরুকরণ। আর সেটাই নন্দীগ্রামের মানুষ মানতে পারছেন না। এমনটা তো আমাদের এখানে ছিল না কোনও দিন। আমরা তো পাশাপাশি থেকেছি সমস্ত বিপদে-আপদে। এটা করে বিজেপি খারাপ করছে। নন্দীগ্রামের মানুষ এর জবাব দেবেন।’’
নন্দীগ্রাম থানার মোড়ে ভাতের হোটেলে বসে তাহেরের কথাটাই একটু অন্য রকম করে বলছিলেন শেখ মোসাল্লেম। পেশায় ওস্তাগর মোসাল্লেম বলছিলেন, ‘‘নন্দীগ্রামের মানুষ এর আগে পুলিশের গুলি খেয়েছে। পুলিশের অত্যাচার দেখেছে। দিনের পর দিন জমিদখল ঘিরে সংঘর্ষ দেখেছে। বোমা-বন্দুক-গুলির মধ্যে দিন কাটিয়েছে। ঘরছাড়া হয়ে থেকেছে। এত কিছুর মধ্যেও তারা কিন্তু মিলেমিশে থেকেছে।’’ মোসাল্লেমের ভয় অন্যত্র— ‘‘এই প্রথম নন্দীগ্রামের মানুষের মধ্যে একটা ভাবনা ঢুকেছে। ভোট তো আজ আছে, কাল চলে যাবে। কিন্তু আমার প্রতি যদি আমার প্রতিবেশী, আমার এলাকার লোক, আমার দোকানদার, আমার খরিদ্দার, সকলের বিদ্বেষ তৈরি হয়, তা হলে বাকি বেঁচে থাকাটা কঠিন হয়ে যাবে। তা হলে আমি কী করব?’’
এই প্রশ্নটাই এখন নন্দীগ্রামকে ভাবাচ্ছে। সেই সূত্রে ভাবাচ্ছে গোটা রাজনৈতিক শিবিরকে।
যে জমি আন্দোলন নন্দীগ্রামকে ‘পরিচিতি’ দিয়েছিল, সেই নন্দীগ্রামে কিন্তু এ বারের নির্বাচনী প্রচারে কোথাও তেমন করে আন্দোলন প্রসঙ্গ তোলেনি কোনও পক্ষই। শহিদ পরিবারগুলির সঙ্গেও তেমন ভাবে কোনও যোগাযোগ করেনি তারা। শেষের দিকে শুধু মমতা ‘পুরনো কথা’ মনে করিয়ে ‘বাপ-ব্যাটা’ শিশির অধিকারী-শুভেন্দুর তখনকার ভূমিকা সামনে এনেছেন। এ ছাড়া প্রধান দুই প্রতিপক্ষের বাকি প্রচার জুড়ে ‘কুকথা’। শুভেন্দু তাঁর প্রচারে সর্ব ক্ষণ মমতাকে সরাসরি ‘বেগম’ বলেছেন। ‘রোহিঙ্গাদের খালা, অনুপ্রবেশকারীদের ফুফু’ বলেছেন। ‘পাকিস্তান জিতলে এখানে যারা বাজি ফাটায়’ বলেছেন। বাংলার ভোট প্রচারে এমনটা কোনও দিন শোনা যায়নি। বিজেপি-র অন্দরের লোকজনের মতে, মমতার অঙ্ক-কষা ঝুঁকিকে প্রতিহত করতে মেরুকরণের এই তাস খেলেছেন শুভেন্দু। আর মমতা সেখানে সারা ক্ষণ নাম করে এবং না করে শুভেন্দু ও তাঁর পরিবারের প্রতি বিষোদ্গার করেছেন। ‘তুই-তোকারি’ করেছেন। ভেকুটিয়া স্কুলের কাছে ছোট্ট মুদির দোকান চালান শুভাশিস দুয়ারি। বছর বাইশের ওই তরুণ বলছিলেন, ‘‘আমি রাজনীতির তেমন কিছু বুঝি না। কিন্তু যে ভাবে প্রচার হল নন্দীগ্রামে, তাতে লজ্জাই লাগছে। এ সব কথা কখনও শুনিনি। ভোট দেব। কিন্তু কাকে দেব এখনও ভাবছি।’’
গত ১০ বছর ধরে নন্দীগ্রাম আসনটি তৃণমূলের দখলে। ২০১১ সাল থেকে বিধায়ক ফিরোজা বিবি। তার আগের ২ বছরও তিনিই ছিলেন যদিও। আর ২০১৬ সাল থেকে শুভেন্দু অধিকারী। কিন্তু গত ১০ বছরে নন্দীগ্রাম নামমাত্র উন্নয়ন হয়েছে। সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল, কিছু রাস্তাঘাট... না, আর তেমন কিছু মনে করতে পারছিলেন না দাউদপুরের শেখ রফিজুল। মুখ্যমন্ত্রীও ভোটপ্রচারে বিরুলিয়ার জনসভা থেকে একই অভিযোগ করেছেন, ‘‘এটা রাস্তা! কোনও কাজই করেনি, মন্ত্রী ছিল! এ বার আমি করব। চিন্তা করবেন না।’’ লক্ষ্যণীয়, এ বারের নির্বাচনে নন্দীগ্রামে এখানকার উন্নয়ন কোনও ‘ইস্যু’ই নয়। কেউ এ সব নিয়ে কোনও কথাই বলছে না। রফিজুলের কথায়, ‘‘অনুন্নয়ন নিয়ে গলা ফাটায় তো বিরোধীরা। এ বারের ভোটে যিনি শাসকদলের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, তিনিই এত দিন এলাকার বিধায়ক ছিলেন। ফলে কার বিরুদ্ধে বলবেন! তাই তিনি পাকিস্তান নিয়ে পড়েছেন। আর মুখ্যমন্ত্রী হুইলচেয়ারে বসে বলছেন, কাজ হয়নি! খেয়াল রাখার দায়িত্ব কার ছিল?’’
ভোট দেওয়া ছাড়াও এই প্রক্রিয়ায় আরও একটা বিষয় রয়েছে। ‘ভোট করানো’। রতনপুর মোড়ের চায়ের দোকানে বসে সেটাই বলছিলেন সুভাষ মণ্ডল। কোনও ভাবেই বলতে চাইলেন না, তিনি কোন দল করেন। শুধু একটা ব্যাখ্যা দিলেন, ‘‘ভোট করানোর একটা মেশিনারি আছে। সেই জায়গায় কিন্তু বিজেপি অনেকটাই এগিয়ে। তৃণমূল এই ভোট সামলানোর জন্য যাঁদের সেনাপতির দায়িত্ব দিয়েছে, তাঁরা সকলে কলকাতার। দোলা সেন, সুখেন্দুশেখর রায়, সুব্রত বক্সী। এঁরা কিন্তু শহরে যে রকম করে ভোট হয়, সে ভাবেই ভাবছেন। চেষ্টা করছেন। ওটা নন্দীগ্রামে চলে না। এখানে কী ভাবে চলে, সেটা শুভেন্দু অনেক ভাল বোঝেন। আবার শেখ সুফিয়ান ছাড়া মমতার সৈনিকদের কেউ ময়দানে সে ভাবে নেই। বাকিরা কে কতটা মমতার সঙ্গে আছেন, তা-ও বোঝা যাচ্ছে না। এটা কিন্তু তৃণমূলের মাইনাস পয়েন্ট।’’ ওঁর কথার হালকা একটা আভাস দেখা যায়, চণ্ডীপুর থেকে নন্দীগ্রাম আসার গোটা পথের দু’পাশে বিজেপি-র পোস্টার, পতাকা, ফ্লেক্সের বহরে। সুভাষের কথায়, ‘‘তৃণমূলকে এই সাজানোর খেলায় বিজেপি কিন্তু এক গোল দিয়ে দিয়েছে।’’
নন্দীগ্রাম বাসস্ট্যান্ডে পান-সিগারেটের দোকান চালান তরুণ যুবক শেখ আল মিরাজ। তাঁর ভাবনায় আবার অন্য প্রসঙ্গ— এক জন মুখ্যমন্ত্রী তাঁর কাছে ভোট চাইছেন। এখানকার প্রার্থী জিতে মুখ্যমন্ত্রী হবেন। মিরাজ বলছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী নন্দীগ্রাম থেকে দাঁড়িয়েছেন। সেটা নন্দীগ্রামের গর্বের ব্যাপার। আমি সেটাকে সম্মান জানাতে চাই। মুখ্যমন্ত্রীকে এখানকার মানুষ হারাবেন না।’’ মিরাজকে বলা গেল, ২০১১ সালের নির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য হেরে গিয়েছিলেন। মমতার বিরুদ্ধে তো তা-ও শুভেন্দুর মতো এক জন পাকা রাজনীতিক দাঁড়িয়েছেন। বুদ্ধদেবের বিরুদ্ধে ছিলেন মণীশ গুপ্ত। যিনি প্রাক্তন আমলা। যাঁর রাজনৈতিক তেমন কোনও পরিচয়ই ছিল না। মিরাজ এ বার কঠিন মুখে জবাব দিলেন, ‘‘মনে করে দেখুন, সেই সময় রাজ্যে পরিবর্তনের হাওয়া উঠেছিল। আগেই উঠেছিল, তবে ২০১১-য় সেটা পরিণতি পেল। এ বার এমন কিছুই হয়নি। অন্তত উপরে উপরে পরিবর্তন চাই বলে কোনও হাওয়া নেই।’’
মমতার এক ফোনে ভিআইপি বিজেপি নেতা প্রলয় পাল কিন্তু নিশ্চিত, শুভেন্দু জিতছেন। তাঁর মতে, মমতা হারছেন বুঝতে পেরেই নন্দীগ্রামে পড়ে রয়েছেন। প্রলয়ের কথায়, ‘‘আমি তো ওই দলটা আগে করতাম। রাজনৈতিক কেরিয়ারের শুরুর দিকের মমতাকে দেখেছি এমন ভাবে নিজের কেন্দ্রে পড়ে থাকতে। কারণ, তিনি সেই সময় নিশ্চিত হতে পারতেন না। এ বারও সেই হাল হয়েছে। নন্দীগ্রামে বসে রয়েছেন। গোটাটাই বৃথা চেষ্টা। নন্দীগ্রামের মানুষ ওঁকে চায় না। আমাদের প্রার্থী বিপুল ভোটে জিতবেন।’’
তাহের অবশ্য নিশ্চিত মমতার জয় নিয়ে। তাঁর দাবি, ৪০ হাজারেরও বেশি ভোটে তাঁর দলনেত্রী জিতবেন। যদিও স্বীকার করছেন, আন্দোলন যে সব এলাকা ঘিরে হয়েছিল সেই সময়, সেই গোকুলনগর, সোনাচূড়ায় বিজেপি-র প্রভাব বেড়েছে। বয়াল, ভেকুটিয়াতেও একই অবস্থা। তাহেরর কথায়, ‘‘এ ছাড়া নন্দীগ্রাম ১ পুরোটাই ‘দিদিমণি’র। যেমন ‘দিদিমণি’র নন্দীগ্রাম ২ ব্লকের একটা বড় অংশ।’’
যেখানে গোটা লড়াইটা ‘মেরুকরণ’ ও ‘প্রেস্টিজ ফাইট’, যেখানে প্রায় গোটা দেশের নজর, সেখানে এতখানি নজরে না থেকেও আরও এক জন বাড়ি বাড়ি ঘুরছেন টোটো নিয়ে। তিনি মীনাক্ষী। অসাধারণ এই কেন্দ্রে ভোটের সাধারণ কথাগুলো বলছেন তিনি। সাধারণ মেয়ে হিসাবে সাধারণ কথা বলছেন। ভোটে প্রভাব পড়ুক বা না-পড়ুক, এর একটা আলাদা প্রেক্ষিত রয়েছে। জমি আন্দোলনের পর থেকে সিপিএমের যেখানে কোনও জমিই ছিল না, সেখানে বেশ কিছু জায়গায় কম লোকজন নিয়েও মীনাক্ষী সাধারণ প্রার্থী হিসেবে পাড়ায় পাড়ায় পৌঁছতে পেরেছেন। তাঁর প্রাপ্ত ভোটের উপর নন্দীগ্রামের ফলাফল খানিকটা নির্ভরশীল বৈকি!
আসলে দু’দলের হাতে দুটো তাস। প্রথম জনের তাস অঙ্ক কষে ঝুঁকি। দ্বিতীয়ের তাস মেরুকরণ। ভোটের দোরগোড়ায় নন্দীগ্রাম। মেরুকরণের তাসটা কি বিজেপি-র খেলাটা অপেক্ষাকৃত কঠিন করে দিল?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy