Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪
সবংয়ে খুন তৃণমূল কর্মী

শাসানি থেকে রেহাই পাচ্ছে না তৃণমূল পরিবারও

ভোটের বাকি দু’দিন। তার আগে এক তৃণমূল কর্মীকে পিটিয়ে খুনের অভিযোগ ওঠার পরে সবংয়ের পাশাপাশি দুই গ্রামে ছবি। শুক্রবার রাতে স্থানীয় মোহাড় পঞ্চায়েতের দুবরাজপুর গ্রামে জয়দেব জানা (৩৮) নামে এক তৃণমূল কর্মীকে পিটিয়ে খুনের অভিযোগ ওঠে।

ক্যামেরার সামনেই হাতাহাতি সিপিএম-তৃণমূল সমর্থকদের।

ক্যামেরার সামনেই হাতাহাতি সিপিএম-তৃণমূল সমর্থকদের।

দেবমাল্য বাগচী
দুবরাজপুর শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৬ ০১:১৫
Share: Save:

ভোটের বাকি দু’দিন। তার আগে এক তৃণমূল কর্মীকে পিটিয়ে খুনের অভিযোগ ওঠার পরে সবংয়ের পাশাপাশি দুই গ্রামে ছবি।

শুক্রবার রাতে স্থানীয় মোহাড় পঞ্চায়েতের দুবরাজপুর গ্রামে জয়দেব জানা (৩৮) নামে এক তৃণমূল কর্মীকে পিটিয়ে খুনের অভিযোগ ওঠে। ঘটনায় এলাকার প্রার্থী, প্রবীণ কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়া-সহ ২২ জনের নামে অভিযোগ দায়ের হয়েছে। ৮ জন বাম ও কংগ্রেস সমর্থককে গ্রেফতারও করেছে পুলিশ। খড়্গপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অভিষেক গুপ্ত বলেন, ‘‘ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে ৮ জনকে ধরেছি আমরা।’’

পূর্ব মেদিনীপুরের ময়না সীমানা লাগোয়া গ্রাম দুবরাজপুর। পাশের গ্রাম মিঠাপুকুর। মিঠাপুকুরেরই বাসিন্দা ছিলেন জয়দেব। স্থানীয় সূত্রের খবর, পাশাপাশি এই দু’টি গ্রামেই সিপিএম-কংগ্রেস সমর্থকদের সংখ্যা বেশি। পালাবদলের পরে তাঁরা কিছুটা গুটিয়ে গেলেও এখন জোটের হাওয়ায় তারা কিছুটা জোর ফিরে পেয়েছে। জয়দেবও আগে কংগ্রেস করতেন। পরে তৃণমূলে নাম লিখিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন তৃণমূলের দুবরাজপুর বুথ সভাপতি।

ঠিক কী ঘটেছিল শুক্রবার?

গ্রামবাসীরা জানালেন, ক’দিন ধরেই রাতে দুবরাজপুরে আসা শুরু করেছিল জয়দেব ও তার দলবল। তৃণমূলকে ভোট দিতে হবে বলে শাসাচ্ছিল। শুক্রবারও রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ তিনটি মোটরবাইকে মোট ৯ জন তৃণমূল কর্মী গ্রামে ঢোকে। নেতৃত্বে ছিলেন জয়দেব। গ্রামবাসীর অভিযোগ, স্থানীয় মন্দিরের সামনে মোটরবাইকগুলি রেখে গ্রামে ঢোকেন জয়দেবরা। তারপর হুঙ্কার ছেড়ে তাঁরা বলে ওঠেন, ‘‘সিপিএম-কংগ্রেসের যারা আছিস, সাহস থাকে তো বেরিয়ে আয়।’ এ দিন গ্রামের কিছু মহিলা জানালেন, সে কথা শুনে বেশ কয়েকটি বাড়ির ছেলেরা বাইরে বেরোয়। আর তারপরই শুরু হয় অশান্তি। স্থানীয় সূত্রের খবর, লোহার রড, লাঠি নিয়ে দু’পক্ষের মারামারিতে লুটিয়ে পড়েন জয়দেব। পরে পুলিশ এসে তাঁকে সবং গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে যায়। তবে ততক্ষণে মৃত্যু হয়েছে ওই তৃণমূল কর্মীর। সংঘর্ষে জখম হন সিপিএম সমর্থক বাপন করণও। তাঁর মাথা ফেটেছে। গ্রামের বাসিন্দা নিয়তি করণের কথায়, ‘‘তৃণমূলের লোকজন লোহার রড, লাঠি নিয়ে এসেছিল। বাড়ির ছেলেদের ডাকছিল। ওরা বেরোতেই অশান্তি বাধে।’’

তৃণমূলের অভিযোগ, মানস ভুঁইয়ার উস্কানিতেই এই ঘটনা। সবংয়ের তৃণমূল প্রার্থী নির্মল ঘোষের কথায়, ‘‘কংগ্রেস ভয় পেয়ে মানুষ মারার রাজনীতি করছে। জয়দেব দলীয় বৈঠক সেরে বাড়ি ফিরছিল। তখনই মানস ভুঁইয়ার নেতৃত্বে ওঁদের লোকজন জয়দেবকে খুন করেছে।’’ মানসবাবু অবশ্য বলেন, ‘‘দীর্ঘ দিন ধরে জয়দেব ওই এলাকায় সন্ত্রাস চালাচ্ছিল। ওঁর বিরুদ্ধে চার বার অভিযোগ করেছি। কিন্তু পুলিশ কিছু করেনি।’’ মানসবাবুর মতে, শুক্রবার রাতেও জয়দেবরা হামলা চালাতেই গিয়েছিল। মানুষ প্রতিরোধ করেছে।


সিপিএম কর্মীদের বাড়িতে পাহারা। — রামপ্রসাদ সাউ

এই ঘটনা তৃণমূলের কোন্দলের জের বলেও ইঙ্গিত করেছেন সবংয়ের বিদায়ী বিধায়ক। তাঁর অভিযোগ, ‘‘মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি করছে তৃণমূল। নিজেরাই নিজেদের লোককে মারছে। আর আমার নাম জড়িয়ে রাজনৈতিক রসিকতা করা হচ্ছে।’’ ক’দিন আগে তৃণমূলের তরফে ছিনতাই, ভাঙচুর, এমনকী শ্লীলতাহানির অভিযোগও দায়ের করা হয়েছিল মানসবাবু-সহ কয়েকজন কর্মীর বিরুদ্ধে। সেই মামলায় আগাম জামিন নিতে হয়েছে সবংয়ের জোট প্রার্থীকে। জয়দেব-খুন তৃণমূলের কোন্দলের জের বলে দাবি করেছেন বিজেপি-র রাজ্য নেতা রাহুল সিংহও। এ দিন জেলারই নাড়াজোলে প্রচারে এসে তিনি বলেন, ‘‘তৃণমূলের নিজেদের মধ্যে অশান্তির জেরেই ওই তৃণমূল কর্মী খুন হয়েছেন।’’

শনিবার সকালে দুবরাজপুরে গিয়ে দেখা গেল, বেশিরভাগ বাড়িই পুরুষশূন্য। কোনও কোনও বাড়িতে তালা ঝুলছে। গোটা গ্রামে পুলিশ পাহারা চলছে। তারই মধ্যে আশপাশের এলাকার তৃণমূল কর্মীদের জমায়েতও নজরে এল। সেই ভিড় থেকে দাবি উঠছিল, জয়দেবের খুনিদের ধরতে হবে, গ্রামের ‘হার্মাদ’দের গ্রেফতার করতে হবে। বাড়ি বাড়ি ঢুকে তৃণমূলের লোকেরাই বাড়ির ছেলেদের খোঁজ করছে। কাউকে পেলে দু’-এক ঘা দিয়ে পুলিশের হাতে তুলেও দিচ্ছে।

ঘটনাস্থলে এ দিনও পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছে মোটরবাইকের ভাঙা অংশ। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, জয়দেবের বাহিনী ভোটের মুখে গ্রামে যাতায়াত করছিল, লোকজনকে শাসাচ্ছিল। স্থানীয় অপর্ণা মালাকার বলেন, ‘‘গত বুধবার রাতেও তৃণমূলের লোকেরা ভোট চাইতে এসেছিল।’’ শাসানির হাত থেকে রেহাই পাচ্ছিলেন না তৃণমূল সমর্থকেরাও। ঘটনাস্থলে থেকে কিছুটা দূরে বাড়ি বন্দনা করণের। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমরা তৃণমূল করি। কিন্তু আমার ভাসুরের পরিবার সিপিএম সমর্থক। তৃণমূলের লোকজন ভাবে, আমরাও সিপিএমের সঙ্গে মিলে রয়েছি। গ্রামে ঢুকে ওরা তাই আমাদেরও শাসায়।’’ শুক্রবার রাতে তাই জয়দেবরা গ্রামে ঢুকতেই বাড়ির ছেলেদের পিছনের দরজা দিয়ে বের করে দিয়েছিলেন বলে জানালেন বন্দনাদেবী।

পাশের মিঠাপুকুর গ্রামে গিয়ে দেখা গেল অন্য ছবি। নিহত জয়দেবের বাড়ির দাওয়ায় বসেছিলেন স্ত্রী মানসী। পাশে দুই স্কুলপড়ুয়া ছেলে সরোজ ও সুব্রত। তাঁদের ঘিরে পড়শিদের ভিড়। কাঁদতে কাঁদতে মানসী বললেন, ‘‘একটা ফোন পেয়ে মানুষটা না খেয়েই বেরিয়ে গিয়েছিল। তখনও কি জানতাম এই পরিণাম হবে।’’ মানসীদেবীরও অভিযোগ, মানস ভুঁইয়ার নির্দেশে বুধা দাস, মানস গাঁতাইতরা তাঁর স্বামীকে মেরেছে। বুধা, মানস এলাকায় সিপিএম কর্মী বলে পরিচিত।

সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য অমলেশ বসু যদিও বলেন, ‘‘তৃণমূলের লোকেরা হামলা চালাতে গিয়েছিল, হুমকি দিচ্ছিল। গ্রামের মানুষ তার প্রতিরোধ করেছে।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Assembly Election 2016 TMC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy