Advertisement
২৭ নভেম্বর ২০২৪

থাকা, না-থাকার তফাত ঘোচানোই চাপ মদনের

আলিপুর জেলে ঢোকার মুখে ডান দিকের চায়ের দোকানে বড় বড় করে লেখা ‘নো ভিজিটর ফর মদন মিত্র’। দোকানের সামনে মোটরবাইকের ওপরে বাবু হয়ে বসে সৌম্যজ্যোতি ওরফে বনি। হাসিমুখে সবাইকে জানাচ্ছেন, দেখা হওয়ার সুযোগ নেই।

প্রচারে পুত্রবধূ। মদন মিত্রের হয়ে কামারহাটিতে স্বাতী মিত্র। —নিজস্ব চিত্র।

প্রচারে পুত্রবধূ। মদন মিত্রের হয়ে কামারহাটিতে স্বাতী মিত্র। —নিজস্ব চিত্র।

অত্রি মিত্র
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০১৬ ০৩:২৩
Share: Save:

আলিপুর জেলে ঢোকার মুখে ডান দিকের চায়ের দোকানে বড় বড় করে লেখা ‘নো ভিজিটর ফর মদন মিত্র’।

দোকানের সামনে মোটরবাইকের ওপরে বাবু হয়ে বসে সৌম্যজ্যোতি ওরফে বনি। হাসিমুখে সবাইকে জানাচ্ছেন, দেখা হওয়ার সুযোগ নেই।

দেখা না-ই বা হল। জনা কুড়ি কর্মী-সমর্থক অধীর আগ্রহে সেখানেই বসে, কখন ‘দাদা’র নির্দেশ আসে!

ঘড়িতে দুপুর আড়াইটে।

‘দাদা’ মানে প্রাক্তন ক্রীড়া ও পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র। জেল-সুপারের উল্টো দিকের অফিসঘরে একটা পেল্লায় কাঠের টেবিল। তারই এ-প্রান্তে বড়-হাতলওয়ালা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে তিনি। টানা কয়েক মাস জেলে থাকার ফলে শরীর এখন অনেকটাই ছিপছিপে। কালো টি-শার্টের সঙ্গে ট্র্যাক শুটের প্যান্টটা তাই বেশ মানানসই।

টেবিলের ও-পারে দুই ছেলে স্বরূপ-শুভরূপ। সঙ্গে নির্বাচনী এজেন্ট প্রদীপ ঘোষ। নীল প্লাস্টিকের টেবিল-ঢাকার উপরে রাখা একটা বিগ-শপার আর লম্বা দিস্তা খাতা। খাতায় এক, দুই, তিন করে পরপর লেখা কাজের ফিরিস্তি— কবে, কোথায় বৈঠকী সভা, কোথায় বা মিছিল কিংবা ডোর-টু-ডোর প্রচার। পাখি-পড়ার মতো ছেলেদের বুঝিয়ে যাচ্ছেন, কী ভাবে বিরোধী প্রচারের মোকাবিলা করতে হবে। সারদা কেলেঙ্কারি বা জেল থেকে ভোটে লড়া নিয়ে প্রশ্ন করলেই বা উত্তর কী হবে। প্রচার-পুস্তিকায় ১০ হাজার চাকরির ব্যবস্থা করা, বন্ধ কারখানা খোলা, ৭ কোটি টাকা খরচে জেটি তৈরি, গ্রাহাম রোডের সংস্কার, ১৫টা মাঠে ফ্লাড লাইট তৈরি করে দেওয়া— এ সব কাজের ফিরিস্তি যেন বাদ না যায়।

প্রদীপবাবু একে-একে দেখাচ্ছেন ভোটারদের বিতরণের জন্য প্রচার-পুস্তিকা আর লিফলেট-এর খসড়া। প্রার্থী পরিচিতির হেডিং কী হবে? শুধুই মদন মিত্র? নাকি ‘প্রভাবশালী বা জনপ্রিয় নন, আপনাদের প্রিয়জন’? প্রার্থী পরিচিতির এক দিকে থাকছে ক্যালেন্ডার। অন্য দিকে তা হলে আইপিএল-এর ক্রীড়াসূচিটা থাকুক? আলাপ-আলোচনার মধ্যেই প্রদীপবাবু বলে উঠলেন, ‘‘তুমি বলে দেওয়ার পরেও মিঠুকে কিন্তু ওরা কাজে লাগাচ্ছে না।’’ বলামাত্র অগ্নিশর্মা মদন মিত্র। ঝাঁঝিয়ে উঠে বললেন, ‘‘এটাও আমায় বলে দিতে হবে? ওখানে কাজে লাগাতে না পারলে আপ্পার ওয়ার্ডে কাজে লাগাক!’’

মদন নিজে যত দিন ময়দানে ছিলেন, এ সব ছুটকো ঝামেলা অবলীলায় সামলেছেন। কিন্তু নিজে থাকা আর না-থাকার মধ্যে যে অনেক তফাৎ। দলে কোথায় কী হচ্ছে, অনুগামীদের মধ্যে কার সঙ্গে কার খটাখটি বাধছে— এ সব খবরই এখন তাঁকে প্রশ্ন করে জেনে নিতে হচ্ছে ছেলেদের কাছে। দু’দিন আগেই দলের মধ্যে মারপিট ঠেকাতে দুই ওয়ার্ডে যথাক্রমে অপরাজিতা-শিবু আর নির্মল-সজলকে আহ্বায়ক করে দিয়েছেন তিনি। কিন্তু সেই বন্দোবস্তে কাজ কতটা হচ্ছে, লোকমুখে খবর নেওয়া ছাড়া গতি নেই! মদন-ঘনিষ্ঠ এক নেতার কথায়, ‘‘দাদা নিজে গিয়ে দাঁড়ালে এ সব কোনও বাধাই নয়। তুড়ি মেরে সব উড়িয়ে দিত।’’ মদনের ছায়াসঙ্গী এক বন্দির কথায়, ‘‘জেলে বসে হাত কামড়াচ্ছেন দাদা। নিজে থাকতে না পারার আফশোস!’’

এই থাকা-না থাকার দ্বন্দ্বই এখন মদনের গলার কাঁটা। বিরোধীরা প্রচার করছে, বিধায়ক হলে ভোটারদের সার্টিফিকেট নিতেও জেলে যেতে হবে। ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দিচ্ছে। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের মেন গেটের সামনেই মদনের ‘পার্টি অফিস’। সেখানে গেলে দুই ভাই স্বরূপ আর শুভরূপ বসিয়ে বোঝাতে শুরু করছেন, ‘‘পাঁচ বছর আগে বাবা যখন এখানে প্রার্থী হয়েছিল, তখন এখানে তৃণমূলের চেনফ্ল্যাগ লাগানোর সাহস পেত না কেউ। এখন কামারহাটি জুড়ে শুধু জোড়াফুল। অন্ধকার কামারহাটি এখন আলোয় ঝলমল করে।’’

কিন্তু ফুল ফোটানোর কারিগরই যে সারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে জেলে! গোদের উপরে বিষফোড়া নারদের হুল। সম্প্রতি কে বা কারা কামারহাটি পুরসভার দেওয়ালেই পোস্টার মেরে দিয়ে গিয়েছে, ‘চুরি তৃণমূলের ভিত্তি / জেল তৃণমূলের ভবিষ্যৎ’। মদনের দুই ছেলে অবশ্য প্রাণপণে বোঝাচ্ছেন, ‘‘সারদায় আমরা রাজনৈতিক চক্রান্তের শিকার। আর স্টিং ভিডিওটা জাল। গত পাঁচ বছরে বাবাকে সব সময় পাশে পেয়েছেন মানুষ। বাবাকে কেউ ফেরাবেন না।’’ রাস্তার মোড়ে মোড়ে ফ্লেক্স-এ তাই লেখা ‘সততার জয়’। কোথাও বা ‘জনতার ডাক, মদন মিত্রই থাক’।

বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুত্রবধূ স্বাতী বলছেন, ‘‘আমি মদন মিত্রের ছেলের-বউ। ভাববেন না, বাবা নেই। এই সব ফোন নম্বর রেখে দিন। কোনও দরকার হলেই ফোন করবেন। কাজ কিচ্ছু পড়ে থাকবে না।’’ কালো স্নিকার আর জেগিংসের উপরে সাদা কামিজ। গলায় জোড়াফুল চিহ্নের উত্তরীয়। সঙ্গে শাশুড়ি অর্চনাদেবী। স্বাতী তাঁকে পাশে নিয়ে বলছেন, ‘‘আপনারা সবাই জানেন, বাবা কী করেছেন। এখন সময় এসেছে ‘রিটার্ন’ দেওয়ার।’’

এর মধ্যেও মদনের কিন্তু কড়া নির্দেশ — অর্চনা আর স্বাতীকে একা ছাড়া যাবে না। নির্দেশ মেনে তাঁদের নিরন্তর সঙ্গী প্রশান্ত প্রামাণিকরা। সব মিলিয়ে শ’খানেকের টিম। ছোট ছেলে শুভরূপ এক মাস আগে থেকে ঘাঁটি গেড়েছেন দক্ষিণেশ্বরের ফ্ল্যাটে। বড় ছেলে স্বরূপ মা ও স্ত্রীকে নিয়ে ভবানীপুর থেকে জেল আর কামারহাটি দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। পুরসভার চেয়ারম্যান গোপাল সাহা, তুষার চট্টোপাধ্যায়, বিশ্বজিৎ সাহারা তো আছেনই। জান লড়িয়ে দিচ্ছেন শম্ভু-ঝন্টু-উদয়দের নিয়ে ভবানীপুরের ‘টিম মদন’ও।

অন্য সময় হলে জেলের অফিসঘরে নাতি মহারূপের সঙ্গে খুনসুটিতে ব্যস্ত থাকতেন মদন। এখন সে সব ডকে উঠেছে। নাতিকে ভবানীপুরে রেখেই গোটা পরিবার বেরিয়ে পড়ছে রোজ, ফিরছে গভীর রাতে। মাঝে জেলের অফিসঘরে ঘণ্টাখানেক জরুরি বৈঠক। তার মধ্যেই প্রতিদিনের নির্দেশ দিয়ে ছোট্ট গেটটা দিয়ে নিচু হয়ে ঢুকে যাচ্ছেন মদন। সঙ্গী সেই বিগ-শপার আর খাতা। বাবার দিকে তখন পলকহীন চোখে তাকিয়ে দুই ছেলে— ডাকনামে বাবু আর সোম।

ওই একটা মুহূর্তের জন্যই মদন মিত্র নেতা নন, প্রার্থীও নন— শুধুই জেলবন্দি বাবা।

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy