Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪

‘ঘরে’র ভোটই চাপে রাখছে মনিরুলদের

জোট-ফোট কোনও ব্যাপারই নয়। তৃণমূল নিজেই হতে পারে সিপিএমের জয়ের একমাত্র চাবিকাঠি।রবিবারের পড়ন্ত বিকালে লাভপুরের লা’ঘাটায় বাঁশের বেঞ্চে বসে চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিতে দিতে কথাগুলি বলছিলেন এলাকারই এক প্রাক্তন প্রধানের ছেলে। সোমবার সকালে প্রায় একই কথা বলতে শোনা গেল নানুরের পাপুড়ি গ্রামের পঞ্চায়েতের সামনে কাঁচাপাকা দাঁড়ির চায়ের দোকানিকেও।

ষাট শতাংশেরও বেশি ভোট পড়ার পরে রবিবার পাপুড়ির বুথে এজেন্ট আনতে পারলেন নানুরের তৃণমূল প্রার্থী গদাধর হাজরা। —নিজস্ব চিত্র

ষাট শতাংশেরও বেশি ভোট পড়ার পরে রবিবার পাপুড়ির বুথে এজেন্ট আনতে পারলেন নানুরের তৃণমূল প্রার্থী গদাধর হাজরা। —নিজস্ব চিত্র

অর্ঘ্য ঘোষ
লাভপুর শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৬ ০১:৪৮
Share: Save:

জোট-ফোট কোনও ব্যাপারই নয়। তৃণমূল নিজেই হতে পারে সিপিএমের জয়ের একমাত্র চাবিকাঠি।

রবিবারের পড়ন্ত বিকালে লাভপুরের লা’ঘাটায় বাঁশের বেঞ্চে বসে চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিতে দিতে কথাগুলি বলছিলেন এলাকারই এক প্রাক্তন প্রধানের ছেলে। সোমবার সকালে প্রায় একই কথা বলতে শোনা গেল নানুরের পাপুড়ি গ্রামের পঞ্চায়েতের সামনে কাঁচাপাকা দাঁড়ির চায়ের দোকানিকেও। জেলার রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদেরও মত, লাভপুর ও নানুরে তৃণমূলেরই কারণে তৃণমূলকে গড় হারাতে হতে পারে। ভোট মেটার পরেও যদিও তৃণমূল নেতারা তা মানতে নারাজ।

ঘটনা হল, লাভপুর এবং নানুর দীর্ঘ কয়েক যুগ বাম তথা সিপিএমের দুর্গ হিসাবেই পরিচিত ছিল। ২০১১ সালের পরে দু’টি কেন্দ্রই তৃণমূলের গড় হয়ে ওঠে। হাজার তিনেক ভোটের ব্যবধানে সিপিএমের নবনীতা মুখোপাধায়কে হারিয়ে বিধানসভায় জেতেন তৃণমূলের মনিরুল ইসলাম। গত পঞ্চায়েত ভোটে সেই মনিরুলেরই দাপটে এলাকার কোনও আসনে প্রার্থী দিতে পারেনি বিরোধীরা। লোকসভা ভোটে ব্যবধান আরও কয়েক গুণ বেড়ে যায়। তবুও এ বার তৃণমূলের বহু নেতা-কর্মীই জয়ের ব্যাপারে সন্দিহান। গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের কাঁটাই ভাবাচ্ছে তাঁদের।

তৃণমূল সূত্রেই খবর, ২০১১ সালেই লাভপুর বিধানসভার টিকিটের অন্যতম দাবিদার তৎকালীন জেলা সম্পাদক দেবাশিস ওঝার সঙ্গে গোষ্ঠী বিবাদ শুরু হয় মনিরুলের। সে সময়ে অনুগামীদের বিরুদ্ধ ভোট করানোর নির্দেশ দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছিল দেবাশিসবাবুর বিরুদ্ধে। কিন্তু তখন অধিকাংশ কর্মীই সে কথা কানে তোলেননি। দেবাশিসবাবুর রাগ মেটানোর থেকে সিপিএমকে হঠানোই তাঁদের কাছে বড় হয়েছিল। তাই অধিকাংশই মনিরুলের হয়ে ভোটে নেমেছিলেন। কিন্তু জেতার পরে মনিরুল ওই সব দেবাশিস অনুগামীদের কোণঠাসা করতে হয় মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়েছেন নয়তো থানায় আটকে পুলিশি নির্যাতন করিয়েছেন বলে অভিযোগ। দলে ব্রাত্য হয়ে গিয়েছেন দুর্দিনের ওই সব কর্মী-সমর্থকেরাই। আর জাঁকিয়ে বসেছেন সিপিএম-ফব থেকে আসা লোকেরা। তৃণমূলের ওই সব আদি কর্মী-সমর্থকেরা ক্ষোভে ফুঁসছিলেন। প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিও তুলেছিলেন তাঁরা। কিন্তু, তা অগ্রাহ্য হওয়ায় এ বারের ছবিটা বদলে গিয়েছে অনেকটাই।

লাভপুরে দলের প্রাক্তন ব্লক সংখ্যালঘু সেলের সভাপতি ফিরোজ আহমেদ খান সদলবলে ভোটের মুখে যোগ দিয়েছেন সিপিএমে। সাধারণ কর্মী-সমর্থকেরা তো বটেই, বহু ব্লক এবং জেলা স্তরের নেতাও প্রকাশ্যে সিপিএম প্রার্থীর হয়ে ভোটে নেমেছেন বলে খবর। আর তারই জেরে যে সিপিএমকে গত পাঁচ বছরে এলাকায় বিশেষ একটা দেখা যায়নি, ভোটের মুখে তাদেরই তৃণমূলকে সমানে টক্কর দিতে দেখা যায়। ঠিবা, কাপসুন্দি, হাতিয়া প্রভৃতি গ্রামে হয় তারা মারের বদলে মার দিয়েছেন, নয়তো মার দিয়ে মার খেয়েছেন। শাসকদলের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর দাবি, ওই সব ক্ষেত্রে সিপিএমের পাশে দেখা গিয়েছে ‘বিক্ষুদ্ধ’ তৃণমূলীদেরও। এমনকী, নিজের পাড়ায় মনিরুলের রাজনৈতিক গুরু আব্দুল মান্নানের ভোটারদের হুমকি দেওয়ার ভাষণও মোবাইল বন্দি হয়ে পৌঁছে গিয়েছে সংবাদমাধ্যমের হাতে। একই ছবি নানুরেও। ভোট মরসুমে বড় মিছিলের আয়োজন থেকে পরপর বন্ধ পার্টি অফিস খোলানো, চণ্ডীদাস কলেজ দখল— সবেতেই দাপট দেখিয়েছে বামেরা। আর সে দাপট দেখানোর সাহস তারা তৃণমূলের ঘর থেকেই পেয়েছে বলে খবর। তাই রবিবার ভোটের দিন নানুরের ৫০টি বুথে শাসকদল দীর্ঘক্ষণ এজেন্ট বসাতে না পারাটাকে কাজল-অঙ্কেই দেখতে চান রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। অন্তরালে থেকে দাপুটে তৃণমূল নেতা কাজল শেখই যে কলকাঠিটা নেড়েছেন, মানছেন তৃণমূল নেতারাও।

২৪ ঘণ্টা আগেই তাই পাপুড়ি গ্রামে সকালে বড় একাকী এবং চিন্তিত দেখা গিয়েছিল নানুরের তৃণমূল প্রার্থীকে গদাধর হাজরাকে। চার জন রক্ষী পরিবেষ্টিত হয়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে লোক তুলে এনেও এজেন্ট বসানোর ব্যর্থ চেষ্টার পরে হাল ছেড়ে দিতে দেখা গেল তাঁকে। এমনকী, গ্রামের তিনটি কেন্দ্রের বুথে লম্বা লাইন, লাগোয়া গাছতলা কিংবা চায়ের দোকানে বহু মানুষের জটলা থাকলেও কাউকেই এগিয়ে এসে কথা বলতে দেখা যায়নি গদাধরের সঙ্গে। যা দেখে রবিবারই জলুন্দি গ্রামের বুথের সামনে এক গদাধর অনুগামীকে বলতে শোনা যায়, ‘‘এ বার আর কিছু করা গেল না!’’ সকালে পাপুড়ি গ্রামের চা দোকানি থেকে শুরু করে মাদ্রাসার শিক্ষক, মসজিদের মৌলবি, এমনকী বোমা বিস্ফোরণে দু’হাত হারানো এক যুবকও বলছিলেন, ‘‘বিপদে-আপদে আমরা কাজল ভাইকেই কাছে পাই। তাই তাঁর মান-সম্মান শুধু আমাদেরই নয়, নানুরের বহু মানুষেরও। নানুরে কাজলভাই-ই শেষ কথা। প্রমাণ হয়ে যাবে ফল ঘোষণার পরে।’’

লাভপুরে কাজলের মাপের কোনও ‘আইকন’ না থাকলেও দলের একাংশের মধ্যে মনিরুল-বিরোধী হাওয়া কিন্তু ছিল। সেই বিষয়টিই লা’ঘাটায় চায়ের দোকানে বসে খোলসা করলেন তৃণমূলের এক প্রাক্তন পঞ্চায়েত প্রধানের ছেলে। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা অনুগামীদের বলেই দিয়েছিলাম, তোমরা মনিরুলের মুড়ি-ঘুগনি, চা-বিস্কুট খাও আর ভোটটা দাও কাস্তে-হাতুড়িতে। ওদের এই আচরণে মনিরুলের লোকেদের সন্দেহ জাগেনি। তাই ওরা কাকে ভোট দিচ্ছে তা নজরও করেনি।’’ কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বা বামেদের শক্তিবৃদ্ধির থেকেও তৃণমূলের ‘ঘরে’র ভোটই এ বার মনিরুলকে কুপোকাত করবে বলে তাঁর মত। যা মানছেন সিপিএম প্রার্থী মাহফুজুল করিমও। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘তৃণমূলের অপশাসনে সমাজের অন্য অংশের সঙ্গে তৃণমূলেরও অনেকে ব্রীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছেন। তাঁরা এ বার শুধু ভোটই দেননি, আমাদের পাশেও দাঁড়িয়েছেন।’’

গদাধর কিংবা মনিরুল, কেউ-ই মুখে অবশ্য এ সব মানতে নারাজ। গদাধরের প্রতিক্রিয়া, ‘‘সংবাদমাধ্যম কাজলকে কাগুজে বাঘ তৈরি করেছে। ওর যে কোনও ক্ষমতাই নেই, তা দেখিয়ে দেব।’’ অন্য দিকে, মনিরুলের প্রতিক্রিয়া, ‘‘একশোর পরে তো আর শতাংশ হয় না। না হলে বলতাম আমার ১১০ শতাংশ জয় নিশ্চিত। তাই বলছি, আমার জেতার সম্ভাবনা ১০০ শতাংশই!’’

কথাগুলো বলার সময়ে যদিও তৃণমূলের দুই নেতার গলাতেই জোরটা তেমন যুতসই লাগল না।

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016 TMC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy