Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪

খুদে সাহিলের মুখ চেয়ে এককাট্টা গাঁয়ের লোক

হাড় জিরজিরে শরীর। রোগা গলাটা উপরে তুললে এখনও দড়ির ফাঁসের অস্পষ্ট দাগটা দেখা যায়। ডাক্তারবাবুরা নিয়মিত নজরে রাখতে বলেছেন। রিনরিনে গলায় ছেলেটা জানায়, মাথার পিছনটা এখনও ব্যথা ব্যথা করে। ব্যথা তো করবেই।

মা সাহানারার সঙ্গে সাহিল। ছবি: সামসুল হুদা

মা সাহানারার সঙ্গে সাহিল। ছবি: সামসুল হুদা

শুভাশিস ঘটক
ভাঙড় শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৬ ০৪:৩৪
Share: Save:

হাড় জিরজিরে শরীর। রোগা গলাটা উপরে তুললে এখনও দড়ির ফাঁসের অস্পষ্ট দাগটা দেখা যায়। ডাক্তারবাবুরা নিয়মিত নজরে রাখতে বলেছেন। রিনরিনে গলায় ছেলেটা জানায়, মাথার পিছনটা এখনও ব্যথা ব্যথা করে।

ব্যথা তো করবেই।

শাসক দলের ফেস্টুন ছিঁড়ে, তাতে সুতো বেঁধে ‘ঘুড়ি’ বানিয়ে ওড়াচ্ছিল বছর বারোর সাহিল মোল্লা। সাধ কম নয়! চোখে পড়বি তো পড়, তৃণমূলের নেতা-কর্মীদেরই পড়ল। তা-ও সময়টা ভোটের ঠিক আগে আগে। আর যায় কোথায়। দলের পতাকার অমর্যাদা বলে কথা! মার...মার...। ছেলেটার হাত-পা দড়ি দিয়ে বেঁধে চলে বেমক্কা মারধর। গলায় গামছার ফাঁস পেঁচিয়ে দেওয়া হয়। বেদম হয়ে পড়লে ছেলেটাকে তিল খেতের পাশে ফেলে পালায় শাসক দলের বাহুবলীরা।

গত ২৮ মে ভাঙড়ের দুর্গাপুর পঞ্চায়েতের হরিহরপুর গ্রামের ওই ঘটনায় এখনও নাকি তৃণমূলের লোকজন এসে শাসিয়ে যাচ্ছে গ্রামে। বলছে, মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। মূল অভিযুক্ত আজিজুর মোল্লা ফেরার, এমনটাই দাবি পুলিশের। এ দিকে, গ্রামের লোকের দাবি, সোমবারই মোটর বাইক ফটফট করতে করতে সাহিলের বাড়ির সামনে এসে চমকে গিয়েছে তৃণমূল নেতা আজিজুর।

কিন্তু এই অত্যাচার আর হুমকির পরিবেশটা গাঁয়ের লোককে ভয় পাওয়ানো তো দূরের কথা, বরং এককাট্টা করে তুলেছে। সকলেরই এক রা, ‘‘পুলিশ-টুলিশ পরে হবে। আজিজুরকে আমরাই খুঁজছি। হাতের নাগালে এলে দেখবেন, কী হাল হয়!’’ গ্রামে মেয়ে-বউরা আরও বলছেন, ‘‘একরত্তি একটা ছেলেকেও রেয়াত করল না ওরা! ছেলেটা সিপিএম-তৃণমূলের কী বোঝে? একটা ফেস্টুন যদি ছিঁড়েও থাকে, তা বলে ও রকম জন্তুর মতো মারতে হবে! আমরা এর শেষ দেখে ছাড়ব।’’

স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসার পরে বাড়ি এসেছে সাহিল। সে পড়ে স্থানীয় স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে। দাদু ইউনিস মোল্লা বলেন, ‘‘ডাক্তারবাবু বলেছেন চোখে চোখে রাখতে। তেমনটাই করছি আমরা। তবে ওর ভয়টা এখনও কাটছে না।’’ সাহিলের মা সাহানারা বলেন, ‘‘ওষুধের রেশ কেটে যাওয়ার পরেই মাথার যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠছে ছেলেটা। মাথার পিছনে রক্ত জমাট বেঁধেছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।’’ সাহিলের বাবা রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। সামান্য রোজগার। সাহানারা বলেন, ‘‘কী ভাবে চিকিৎসা হবে জানি না। কী যে অপেক্ষা করছে ছেলেটার জন্য!’’ গলায় উদ্বেগ ঝরে পড়ে মায়ের।

সাহিলের পরিবার আগ মার্কা সিপিএম। ইউনিস দলের স্থানীয় নেতা। গত পাঁচ বছর শাসক দলের তাণ্ডবে কিছুটা কোণঠাসা ছিলেন। ভোটের আগে থেকে অনেকটাই সক্রিয়। গ্রামের অনেকেরই বক্তব্য, সিপিএম পরিবারের ছেলে হয়ে তৃণমূলের পতাকা ছেঁড়ার ‘অপরাধে’ই এ হেন ‘শাস্তি’ পেতে হয়েছে সাহিলকে।

ঘটনার পরে ৬ জনের নামে অভিযোগ দায়ের হয় থানায়। তৃণমূল নেতারা অবশ্য শুরু থেকেই দাবি করে‌ছেন, ঘটনাটি পারিবারিক। স্থানীয় তৃণমূল নেতা তথা ভাঙড় ১ পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য আবদুল আলিম বলেন, ‘‘মিথ্যা ঘটনা নিয়ে নাটক করছে ওরা। কেউ ওদের ভয় দেখাচ্ছে না।’’ মিথ্যা অভিযোগে কয়েকজনকে ফাঁসানো হচ্ছে বলে তাঁর দাবি।

নাতিকে কোলে বসিয়ে ইউনিস মঙ্গলবার বললেন, ‘‘একটা বাচ্চা ছেলেকে এ ভাবে মারধর করায় গ্রামের লোক খেপে উঠেছে। এর মধ্যে রাজনীতি খুঁজলে ভুল হবে। এখন অপরাধীদের বিচার চেয়ে সকলেই এককাট্টা।’’ ইউনিস বলেন, ‘‘গত পাঁচ বছরে নানা অত্যাচার করেছে তৃণমূল। কখনও গাছ কেটে নিয়ে গিয়েছে। ইন্দিরা আবাস প্রকল্পে বাড়ির বরাদ্দ টাকার অর্ধেক জোর করে নিয়েছে। সব সহ্য করেছি। এখন তো শিশুদেরও মারধর করা শুরু করেছে। পুরো গ্রাম লাঠি-বঁটি নিয়ে তৈরি রয়েছে। এ বার তৃণমূলের বাহিনী আসুক, বুঝে নেব। পুলিশও বাদ যাবে না।’’

সিপিএম অধ্যুষিত গ্রাম হলেও কিছু তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ পরিবারও আছে। তবে গ্রামের মেয়ে-বৌদের অনেকেই জানালেন, রাজনীতির ভেদাভেদ এখন খুঁজলে হবে না। সাহিলের উপরে অত্যাচারের বদলা চান সকলেই। সোমবার বিকেলে এলাকায় এসেছিলেন স্থানীয় এক তৃণমূল নেতা। মহিলাদের তাড়া খেয়ে মোটর বাইকের মুখ ঘুরিয়ে নিমেষে হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছেন।

পুলিশের ভূমিকা নিয়েও ক্ষোভ আছে গ্রামের লোকের। তৃণমূলের চাপেই সাহিলকে ধরা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করছেন ইউনিস। জেলা পুলিশের এক কর্তা অবশ্য বলেন, ‘‘মূল অভিযুক্তকে ধরার চেষ্টা জারি আছে।’’ এক অভিযুক্তকে ইতিমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

তবে পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভটা বাড়ছে। ইউনিসের অনুমান, ধৃতের জামিন মঞ্জুর হওয়ার পরেই মূল অভিযুক্তকে ধরবে পুলিশ। এটা হল তৃণমূলেরই চাল। কিন্তু তাতে কী সুবিধা? দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক কর্মী ইউনিসের মতে, সে ক্ষেত্রে একজনের জামিনের আদেশ জমা দিয়ে মূল অভিযুক্তের জামিন পেতে সুবিধা হবে।

এই যুক্তি মানছেন না জেলা পুলিশের কর্তারা। কিন্তু গ্রামের লোকের জমাট বাঁধা ক্ষোভের আঁচ পাচ্ছেন তাঁরাও।

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016 Sahil Bahngor
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy