মেজাজ হারিয়ে। দলীয় কর্মীকেই চড় তৃণমূল প্রার্থী রবীন্দ্রনাথ ঘোষের। বৃহস্পতিবার। ছবি: হিমাংশুরঞ্জন দেব।
তাঁরা যত মেজাজ হারিয়েছেন, তৃণমূলের কর্মীদের মেরুদণ্ড দিয়ে ততই শিরশিরানি বেড়েছে।
এমনিতে বলা হয়, কোচবিহারের রাজনীতির ময়দানে রবীন্দ্রনাথ ঘোষ যেন ক্রিকেট মাঠের এমএসডি। বরফ ঠাসা মাথায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখেন। সেই রবিদাই নিজের একান্ত ন্যাওটা পুত্রবৎ অনুগামী মহিদুল ইসলামকে ঠাস ঠাস করে চড় মেরে বসলেন খাস ভোটের দিন। তখনই ধক করে ওঠে তৃণমূল কর্মীদের বুক। হঠাৎ এত বদলে গেলেন কেন রবিদা?
চড়টা কি আসলে নিজেকেই কষিয়েছিলেন? তৃণমূলের অন্দরেই খবর, হতাশা কতটা তীব্র হলে তবেই রবিদা এমন কাণ্ড করতে পারে। রবীন্দ্রনাথবাবুর এক অনুগামীর কথায়, ‘‘দাদা যে সকলের চোখের সামনে এমন ভাবে চড় মেরে বসতে পারেন, তা না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না। নিশ্চয়ই কোনও কারণে খুব হতাশ, তাই এমন কাণ্ড করে ফেললেন।’’
রবিদার এই কাণ্ডের পরপরই তৃণমূল শিবিরের কানে পৌঁছে যায় বাবনদার কাজ-কারবারের কথা। উদয়ন গুহকে দিনহাটায় অনেকে ওই নামেই চেনেন। ভোটের রাজনীতিতে পোড় খাওয়া নেতা উদয়নবাবু যে বুথের ভিতরে ঢুকে যাবেন, তাঁর বিরুদ্ধে ছাপ্পা ভোটের অভিযোগ উঠবে, তা ভাবতেও পারেননি তৃণমূলের কর্মীরা। বুথের সামনে পুলিশের এক এএসআইকে ধমকও দিয়ে ফেলেন উদয়ন।
বামেদের দাবি, তাঁদের চাপেই মেজাজ হারিয়েছেন রবিদা ও বাবনদা। সিপিএমের ফালাকাটা পার্টি অফিসে বসে অশোক ভট্টাচার্য নিয়মিত ফোনে চাপ রেখে গিয়েছেন। কোথাও থেকে কোনও অভিযোগ এলেই অশোক ফোনে বারবার বলেছেন, ‘‘ভয় পাবেন না কমরেড। বুথের সামনে থাকুন।’’ তাঁর সঙ্গে ছিলেন দার্জিলিং জেলা সিপিএমের সম্পাদক জীবেশ সরকার, যুব নেতা শঙ্কর ঘোষ এবং ছাত্র নেতা সৌরভ দাসও। বুধবারেই সেখানে চলে আসেন বামেদের ‘টিম শিলিগুড়ি’। অশোকবাবু বলেও ফেলেন, ‘‘আগের রাতে এসে পিচ তৈরি করেছিলাম। সারা দিন ধরে একের পর বাউন্সার দিয়েছি। সে সব সামলাতে না পেরেই তৃণমূল নেতারা মেজাজ হারিয়েছেন।’’
রবীন্দ্রনাথবাবু ও উদয়নবাবু কিন্তু দিনটা শুরু করেছিলেন খোশমেজাজেই। বেলা ১০টা বাজতেই হোঁচট খাওয়া শুরু। রবিবাবু খবর পান, নাটাবাড়িতে বুথের অদূরের ক্যাম্প অফিস ভেঙে দিয়েছে পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনী। একের পর এক বুথ থেকে তৃণমূল কর্মীদের সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কোথাও তাড়া করছে পুলিশ। তৃণমূল সূত্রেই জানা গিয়েছে, ঘনঘন ফোন পেয়ে রবিবাবু বাতানুকূল গাড়িতে বসেও ঘামতে শুরু করেন। গাড়িতে বসে নানা নির্দেশ দিতে থাকেন। তাতে কাজ না হওয়ায় নিজে ছোটাছুটি শুরু করেন। কিন্তু কর্মীদের চাঙ্গা করার কোনও উপায় বাতলাতে না পারায় কয়েক জন তো নেতার ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন তুলে ফেলেন। তারই পরিণতিতে চিলাখানার একটি বুথে গিয়ে নিজের একান্ত অনুগামী মহিদুল ইসলামের ‘রবিদা কিছু করুন’ বলে চেঁচামেচি শুনে তাঁকে সপাটে চড় কষিয়ে দেন। একই সময়ে খেই হারিয়ে ফেললেন উদয়নও। কোথাও কেন্দ্রীয় বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে হইচই বাঁধিয়ে ফেলেন। পুলিশকে ধমক-ধামক দিলেন। একটা সময়ে ১২৩ নম্বর বুথে সটান ভিতরে ঢুকে ঘেরাটোপের মধ্যে থাকা ভোটযন্ত্রের সামনেই হাজির হয়ে গেলেন তিনি।
তৃণমূলের অন্দরের খবর, শেষ দফার ভোটে চালিয়ে খেলে কয়েকটা আসনে জয় তুলে নিতে মরিয়া ছিল শাসক দল। তাই বুধবার রাত পর্যন্তও রবিবাবু, উদয়নবাবুরা বুথ ভিত্তিক হিসেব কষে ছক সাজিয়েছিলেন। কোথায়, ক’টি বুথে তাঁরা দুর্বল, সেখানে কী ভাবে বাতাস পালে টেনে আনতে হবে, সেই কৌশলও ছকা হয়েছিল। কিন্তু, আধা সামরিক বাহিনীকে সামনে রেখে পুলিশের একটা বড় অংশ যে ভাবে কলকাতা-স্টাইলে ছুটে বেড়িয়েছেন, তাতেই অনেক বুথের চেহারা বদলে যেতে শঙ্কিত হয়ে পড়েন তৃণমূল স্তরের কর্মীদের অনেকে। সেই শিরশিরানি ছড়িয়ে পড়ে সেনাপতিদের মধ্যেও। তাতেই তাঁরা ছয় মারতে গিয়ে ক্যাচ তুলেছেন বলে মত বিরোধীদের।
রবিবাবুর অবশ্য বক্তব্য, ‘‘চড় মারা নিয়ে বিতর্কে বাইরের লোক ঢুকছেন কেন? এ তো আমাদের নিজেদের ব্যাপার।’’ তাঁর বরং অভিযোগ, ‘‘আধা সামরিক বাহিনীর জওয়ানরা নানা জায়গায় সন্ত্রাস তৈরি করার চেষ্টা করে। বেআইনি ভাবে আমাদের অনেক বুথ ক্যাম্প ভাঙচুর করা হয়। নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ জানিয়েছি।” আর উদয়নের যুক্তি, ‘‘এক দৃষ্টিহীন মহিলাকে তাঁর নাতি ভোট দেওয়ার জন্য বুথে নিয়ে যান। সেই সময় আমি বুথের খোঁজখবর নিচ্ছিলাম। ছাপ্পার অভিযোগ বানানো।”
সিপিএমের কোচবিহার জেলা সম্পাদক তারিণী রায়ের অবশ্য মক্তব্য, ‘‘গণতন্ত্র রক্ষা হয়েছে। শাসক দলের নেতারা ভোট নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি।
তাতেই ক্ষোভ বেড়েছে তাঁদের।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy