ভারতী মুৎসুদ্দির সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন সায়ন্তিকার মা দেবশ্রী ঘোষ। (ডান দিকে) হালিশহরের পুরসভায় তৃণমূলের উপ-পুরপ্রধান রাজা দত্ত। বৃহস্পতিবার সজল চট্টোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।
এ-ও যেন এক রাজ-কাহিনি!
এ রাজার নামে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খায়। হালিশহর-কাঁচরাপাড়ায় এমনটাই প্রবাদ!
এ রাজা বীজপুরের বিদায়ী তৃণমূল বিধায়ক শুভ্রাংশু রায়ের ‘ডান হাত’। ‘রাজা আসছে’ বললেই কাজ হয়। বলছেন হালিশহরের অনেকেই!
এ হেন রাজা মুচলেকা চেয়েছেন। না দিয়ে থাকেন কী করে শ্যামল ঘোষ! ঘাড়ে তো একটাই মাথা। ভোটের আগের রাতে যতই তৃণমূলের হামলার শিকার হোন, যতই তাঁর একরত্তি মেয়ে সায়ন্তিকা প্রহৃত হোক— ঢোঁক গিলতে হয়েছে শ্যামলবাবুকে। বুধবার রাজার কাছে মুচলেকায় তিনি জানিয়ে দিয়েছেন— ‘তাঁর বাড়িতে হামলা করেনি তৃণমূলের কোনও কর্মী। ব্যক্তিগত গোলমালের জেরেই তাঁর তিন বছরের মেয়ে মার খেয়েছে’। কেননা, তার আগেই তো শুনতে হয়েছিল শান্ত গলার হুমকি, ‘পারিবারিক কোন্দল বলে বিষয়টি হয় ধামাচাপা দিতে হবে, নইলে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত সব কিছুতেই’। সেই অভিযোগ তুলে বৃহস্পতিবার শ্যামলবাবু বলেন, ‘‘যে-সে বললে এক রকম। কিন্তু রাজাবাবু বলেছেন। না মানলে সব শেষ হয়ে যাবে। পুরসভার অ্যাম্বুল্যান্স চালাই। সেটাও যাবে।’’
কে এই রাজা?
খাতায়-কলমে বর্তমানে হালিশহর পুরসভায় তৃণমূলের উপ-পুরপ্রধান। কিন্তু রাজা দত্তের এটাই একমাত্র পরিচয় নয়। কেউ তাঁকে মনে করেন ‘রবিন হুড’। কারও কাছে তিনি ‘গব্বর’। হালিশহরে তাঁর চারটি বাড়ি। বিরোধীদের দাবি, রাজা এই শহরতলির পুকুর-ভরাটের ‘নাটের গুরু’। ‘সিন্ডিকেটরাজ’-এর মাথা। যিনি সরকারি নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কাও করেন না।
তিন ভাইয়ের মধ্যে মেজো রাজা ‘পরিবর্তনের জমানা’র আগে দিনমজুরি করতেন। এক সময়ে ছোট্ট শুভ্রাংশুকে স্কুলে দিয়ে আসা-নিয়ে আসার কাজও করতেন। কংগ্রেসের হাত ধরে রাজনীতিতে হাতেখড়ি। পরে শুভ্রাংশুর বাবা মুকুল রায়ের হাত ধরে তৃণমূলে। ২০১১-র ভোটে এক নির্বাচনী আধিকারিকে মারধরের ঘটনায় নাম জড়ায় রাজার। সেই প্রচারে আসা শুরু। ২০১৪-র মাঝামাঝি অনাস্থা এনে বামেদের হটিয়ে হালিশহর পুরসভার দখল নেয় তৃণমূল। এলাকাছাড়া হন বাম কাউন্সিলররা। তার পিছনেও রাজা দত্তের ‘হাতযশ’-এর অভিযোগ ওঠে। গত বছর ভোটে ওই পুরসভা জেতে তৃণমূল। রাজা উপ-পুরপ্রধান হন। তৃণমূলের একাংশ আপত্তি করলেও রাজাকে ঠেকানো যায়নি।
এলাকায় অবশ্য রাজার দাপট ছিল এর আগে থেকেই। এক সময়ে ‘জলাভূমি অঞ্চল’ বলে পরিচিত হালিশহরে এখন পুকুর হাতে গোনা। ভূমি দফতর এবং পুরসভার মালিকানাধীন প্রায় শ’খানেক পুকুর গত কয়েক বছরে রাজার নেতৃত্বেই ভরাট হয়েছে বলে অভিযোগ। এ নিয়ে নাজেহাল পুর-চেয়ারম্যান অংশুমান রায় জেলাশাসকের দ্বারস্থও হয়েছেন। অংশুমানবাবু বলেন, ‘‘রাজা উপ-পুরপ্রধান হিসেবে উদ্যমী। কিন্তু পুকুর-ভরাট সামলানো যাচ্ছে না। এ ছাড়া আর কিছু বলব না।’’ পুরপ্রধানের এই কথাতেই স্পষ্ট, এলাকায় কতটা শক্তি ধরেন রাজা। পুরসভার অস্থায়ী অ্যাম্বুল্যান্স-চালক শ্যামল ঘোষ তো তাঁর কাছে নস্যি!
এ হেন রাজার দাপটে শুধু শ্যামলবাবুরা নন, সন্ত্রস্ত গোটা এলাকা। ভোটের ফল প্রকাশের পরে কী হবে তা নিয়েও রীতিমতো উদ্বেগে রয়েছেন তাঁরা। শ্যামলবাবু ও তাঁর স্ত্রী দেবশ্রী মুখে বলছেন, ‘‘আমরা শেষ দেখে ছাড়ব।’’ কিন্তু মুচলেকা লেখানোর প্রতিবাদে তাঁরা বৃহস্পতিবার থানায় গিয়ে রাজার বিরুদ্ধে এফআইআরের সিদ্ধান্ত নিলেও শেষ পর্যন্ত করে উঠতে পারেননি। মনের জোর আর জেদের সঙ্গে কোথাও কি একটা চোরা ভয় কাজ করছে? চুপ করে থাকেন শ্যামলবাবু।
এলাকার লোকজন বলছেন, ভয় করবে না? বিরোধীরা যেখানে ওঁর বিরুদ্ধে কিছু বলতে সাহস করে না, সেখানে ছোট্ট সায়ন্তিকা মুখ খুলেছে। তার মা দেবশ্রী মুখ খুলেছেন। ভয় তো স্বাভাবিক। এলাকাবাসীর অনেকেই জানাচ্ছেন, বকুলতলায় বাঁশের মাচায় বসে রাজ্যপাট চালান রাজা। আগ্নেয়াস্ত্রধারী চ্যালারা তাঁকে ঘিরে থাকে। বিলকুল বিহারের মাফিয়াদের মতো। অভিযোগ, সেখানে বসেই রাজা এলাকার পুকুর-ভরাটের ছক কষেন। লোকের কাছে ভাল সাজার জন্য যাত্রা থেকে পিঠেপুলি উৎসব বা নাট্যোৎসবের আয়োজন করেন। কারও মেয়ের বিয়ে বা ছেলের স্কুলে ভর্তির সমস্যাও মিটিয়ে দেন। কিন্তু তাঁর দাবি না মিটলেই রক্তচক্ষু। রাজার ঠেকে তাঁর এক চ্যালা খুনও হয়ে গিয়েছে। আর এক জন জখম হয়।
এ সব অভিযোগ নিয়ে রাজার সঙ্গে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি। কেননা, মুচলেকা-কাণ্ড সামনে আসার পর থেকে তাঁর হদিস নেই। মোবাইল বন্ধ। বৃহস্পতিবার পুরসভাতেও যাননি। শুভ্রাংশু দাবি করেছেন, রাজার বিরুদ্ধে অত অভিযোগ তাঁর জানা নেই। তবে, সায়ন্তিকা ও তার পরিবারের লোকজনের উপরে হামলার ঘটনায় দোষীদের শাস্তি দাবি করে তিনি বলেন, ‘‘শিশুটির পরিবারের কোনও ভয় নেই। আমরা পাশে আছি।’’
প্রায় একই আশ্বাস এ দিন শ্যামল-দেবশ্রী পেয়েছেন ‘আমরা আক্রান্তের’ ভারতী মুৎসুদ্দি, চন্দন সেন, মৌসুমী কয়ালদের থেকেও।
তবু ভয় যাচ্ছে না। রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন যে অতি সাধারণ কয়েক জন মানুষ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy