Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪

চার হাতে খেলে শশীর ‘পূর্ণ প্রকাশ’

চারমূর্তির খেল! এক—অ্যালবার্ট। কাশী দত্ত স্ট্রিটের পার্টি অফিসের সামনে দু’হাতে জলের বোতল নিয়ে জাগলিং করতে করতে বললেন, ‘‘আমি কোথাও যাব না। এখানে বসেই যা করার করব।’’ তাঁর আদর্শ অনুব্রত মণ্ডলঃ ‘‘অনুব্রতর মধ্যে একটা ক্যালি আছে।’’

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৬ ০১:০২
Share: Save:

চারমূর্তির খেল!

এক—অ্যালবার্ট। কাশী দত্ত স্ট্রিটের পার্টি অফিসের সামনে দু’হাতে জলের বোতল নিয়ে জাগলিং করতে করতে বললেন, ‘‘আমি কোথাও যাব না। এখানে বসেই যা করার করব।’’ তাঁর আদর্শ অনুব্রত মণ্ডলঃ ‘‘অনুব্রতর মধ্যে একটা ক্যালি আছে।’’

দুই—অমিত সেন। কানে ব্লু টুথ। এক হাতের শালপাতায় কচুরি-আলুর দম। অন্য হাতে গোছা ভোটার স্লিপ বিলোচ্ছেন। পাশের চেয়ারে রাখা বেশ কিছু ভোটার কার্ড। সামনে সার সার অটোতে বাছাই করা ভোটার তুলতে তুলতেই মন্তব্য, ‘‘মস্তানি নয়। জনসেবা করছি।’’

তিন—কালাচাঁদ পাল ওরফে কালা। বাগবাজারের কাঁটাপুকুর, শান্তি ঘোষ স্ট্রিট এলাকার দাপুটে চরিত্র। ভর দুপুরে এক বহুতলে তাঁর নেতৃত্বে নাম বসছিল খালি ভোটার স্লিপে। কালা বললেন, ‘‘শশীদির কাজে ব্যস্ত আছি। রিপোর্টারদের সঙ্গে কথা নয়।’’

চার—রঘু। জোড়াবাগান থানার সামনে থামল তাঁর ‘হিরো প্যাশন’ বাইক। সবুজ পাঞ্জাবি পরে বাইক থেকে নামতেই পথচলতি লোকজন হাতজোড় করে দাঁড়ালেন। ফুটপাথের গ্যারাজে চেয়ার টেনে বসতে বসতে রঘুর মন্তব্য, ‘‘সকালে পুজো করেছি, সুগারের ওষুধ খেয়েছি। এখন সরাসরি ভোটে নেই। তবে দিদির সঙ্গে আছি।’’

ভোট শেষ হওয়ার মুখে চওড়া হাসি শশী পাঁজার। ‘‘অ্যালবার্ট, কালা, অমিত, রঘু—সবাইকে আমি চিনি। এরা সবাই দলের কর্মী। এরা ভোট করাবে না তো কি ঘরে বসে থাকবে?’’

শ্যামপুকুর কেন্দ্রে বৃহস্পতিবারের এই ছবি সামনে রাখলেই বোঝা যায়, ভোট সেখানে কতটা ‘অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ’ হয়েছে।

সংসারে চওড়া ভাঙন। এলাকায় দলের নিচুতলার একাংশ তাঁর বিরুদ্ধে মাঠে নেমে বিদ্রোহের হুমকি দিয়েছেন। ঘর-শত্রু বিভীষণদের সামলে জিততে মরিয়া শশী এলাকার এই চারমূর্তিকেই ভোট বৈতরণী উতরে দেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তাঁরা তা পালনও করে গিয়েছেন সারা দিন। তাঁদের দাপটে নিজের গলি ছেড়ে বেরনোর সাহস পাননি দাপুটে সিপিএম নেতা সুধাংশু শীল এবং তাঁর সঙ্গীরা। দুপুরের পরে পরিচিত সাংবাদিকদের ফোন করে সুধাংশুবাবুর আর্তনাদ, ‘‘ভয়ঙ্কর সব কাণ্ড। সব লুঠ হয়ে গেল। আমরা দেখেও কিছু করতে পারছি না।’’

পরিস্থিতির আঁচ পাওয়া গিয়েছিল এ দিন সকালেই। শ্যামপুকুরের ২০ নম্বর ওয়ার্ডে প্রদীপ শীল ওরফে অ্যালবার্টের মুখে ১০টা না বাজতেই চওড়া হাসি। সাফারি সুট পরা এক চেহারা তাঁর পিঠ চাপড়ে আশ্বাস দিলেন, ‘‘সিপিএম গিয়েছে মায়ের ভোগে। কোনও শালা বাইরে বেরোচ্ছে না। দিদি মুখ্যমন্ত্রী হয়ে গেছেন।’’

তা হলে তো আর অ্যালবার্টের ‘গুস্সা’র কারণ নেই। বিনয়ী হেসে অ্যালবার্টের উক্তি, ‘‘আমার গুস্সা আসে না। জানতামই কী হচ্ছে।’’

তার কিছুক্ষণ আগেই শোনা গিয়েছিল অমিত সেনের নাম। পুরনো আহিরিটোলার বেশ কিছু বাড়ি থেকে ভোটারেরা ভোট দিতে বেরোতে পারছেন না, তাঁদের কার্ড কেড়ে নেওয়া হচ্ছে শুনে যাওয়া হয়েছিল এলাকায়। সুনসান চারদিক। যে দু’একজনের দেখা পাওয়া গেল, তাঁরা চোখ নামিয়ে বললেন, ‘সব ঠিক আছে’। শুধু একজনের স্বগতোক্তি, ‘‘সত্যি কথা বললে কি আর অমিত এই পাড়ায় টিকতে দেবে?’’

কে এই অমিত? কয়েক পা এগোতেই আহিরিটোলা স্ট্রিটে দেখা হয়ে গেল। পেশায় এক প্রোমোটর, পাশাপাশি তৃণমূলের সক্রিয় কর্মী। তাঁর নামে অভিযোগ উঠেছে শুনে হেসে বললেন, ‘‘পাড়ার ছেলে কখনও মস্তানি করে? ওদের দলের লোকেরাই ভোটে উৎসাহ হারিয়েছে।’’ তাঁর চারপাশে অটোর ভিড় তখন বাড়ছে। বাড়ছে ছেলের সংখ্যাও। তাড়া-তাড়া ভোটার কার্ড আর স্লিপ তাঁরা জমা করছেন অমিতের হাতে। সে সব গোছাতে গোছাতেই অমিতের প্রশ্ন, ‘‘আর কোনও অভিযোগ? একটু জল-মিষ্টির ব্যবস্থা করি এ বার।’’

এরই মধ্যে খবর আসতে লাগল দর্জিপাড়ার গণভবন, ডাফ স্কুল, টাউন স্কুল, বিদ্যাভারতী স্কুলে দেদার ছাপ্পা ভোট চলছে। গণ ভবনের দোতলায় ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থী পিয়ালী পালের এজেন্ট প্রতিবাদ করতেই আঙুল উঁচিয়ে তেড়ে এলেন তৃণমূলের এজেন্ট রমাকান্ত অগ্রবাল। ‘‘ভোট মিটে গেলে রিপোর্টাররা বাঁচাবে?’’ পিয়ালীর আর এক এজেন্টের ফোনে তখন অভিযোগ এসেছে, বাগবাজারের ৫, শান্তি ঘোষ স্ট্রিটের এক ফ্ল্যাট বাড়িতে ভেতর থেকে তালা লাগিয়ে স্লিপে ‘পছন্দের ভোটার’দের নাম ভরছেন কালা। শোনা যায়, তিনি নাকি শশী পাঁজার ডান হাত প্রসূন ঘোষের খাস লোক। বাগবাজারে তাঁর কাজ যথেষ্ট ‘চর্চিত’। দেখা করতে চাইলে সটান ‘না’ করে দিলেন কালা এবং প্রসূন দুজনেই।

এক কথাতেই অবশ্য দেখা করতে রাজি হয়েছিলেন ২১ নম্বর ওয়ার্ডের রঘু হাজরা। শশী-বিদ্রোহীদের মতে, তিনিই এ বার ২১ নম্বর ওয়ার্ডের ‘অপারেশন’ সামলাচ্ছেন। অ্যালবার্ট ঘনিষ্ঠ রঘু নাকি ‘শশীদি’কে অন্তর থেকে ভালবাসেন। তাই তাঁকে জেতাতে ‘সব কিছু করতে’ প্রস্তুত। বললেন, ‘‘আমি রামকৃষ্ণের ভক্ত। প্রতিহিংসা চাই না। যা করছি বুঝিয়ে সুজিয়ে করছি।’’ ফোনে অনবরত নানা লোককে আশ্বাস দিচ্ছিলেন তিনি। ‘‘চিন্তা নেই। সব ঠিক চলছে।’’

দুপুরের পর বিভিন্ন বুথে ভিড় যখন ক্রমশ পাতলা হতে শুরু করেছে, তখনই আহিরিটোলা বঙ্গবিদ্যালয়ের সামনে দেখা অ্যালবার্টের সঙ্গে। আপনি এখানে যে! বলতেই ‘আমি শশী পাঁজার এজেন্ট’ বলে তীর বেগে বুথে ঢুকে গেলেন। তাঁর পরিচয়পত্রও দেখতে চাইল না কেন্দ্রীয় বাহিনী। তাঁকে অনুসরণ করে ভিতরে ঢুকে দেখা গেল, দোতলার ঘরে এজেন্টের পাশে বসে আছেন তিনি। আপনার পরিচয়পত্র কোথায়? কয়েক সেকেন্ডে ভোল বদলে অ্যালবার্টের গুস্সা এল, ‘‘আমি তো শশী পাঁজার এজেন্ট নই। আমি নির্দল প্রার্থী শম্পা বসুর রিলিভার।’’ সেই পরিচয়পত্রই বা কোথায়? দেখাতে পারেননি অ্যালবার্ট।

শ্যামপুকুরের একাধিক জায়গা থেকে সিপিএম এবং এলাকার বিক্ষুব্ধ তৃণমূল কর্মীদের ওপর হামলার খবর আসতে শুরু করছে। দিনের শেষে জ্বলজ্বল করছে চারমূর্তির স্কোরকার্ড। এত কিছুর পরেও সন্ধ্যায় সিপিএম নেতা সুধাংশুবাবু তাঁর দুপুরের বক্তব্য সংশোধন করে দাবি করেন, ‘‘যতটা খারাপ ভেবেছিলাম, ততটা হয়নি।’’

অন্য বিষয়গুলি:

tmc assembly election 2016
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy