প্রচারে বীরবাহা হাঁসদা। দেবরাজ ঘোষের তোলা ছবি।
এই সেই মেয়ে, বসন্তের দুপুরে কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায় যাঁর হাসি দেখে টগবগে সাঁওতাল তরুণের ‘ঝুপার’ হয়!
বাংলায় ‘ঝুপার’ মানে ‘ভর’। বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে খাবি খাওয়া। মহুয়ার থেকেও যার ধাক্কা বেশি!
সেই মেয়ে ইতিহাসে অনার্স, হাঁড়িয়া বানান চমৎকার এবং সাঁওতালি ছবির অন্যতম প্রথম সারির নায়িকা হিসেবে ঝুলিতে ভরেন ডজনখানেক পুরস্কার! গোল্ড ফেসিয়াল, হেয়ার স্পা, পেডিকিওর করে পায়ে টুকটুকে লাল নেলপলিশ, পান্তাভাত আর শাকভাজা তাঁর পছন্দের। কাজল পরার ধরনে, খুলে রাখা এক ঢাল কালো চুলে, হাতে বোনা সুতির ‘পাঞ্চিপাঁহাট শাড়ি’-র সঙ্গে থ্রি কোয়ার্টার হাতা কলমকারি ব্লাউজে তিনি সাঁওতাল মহিলা মহলে দাপুটে ‘ট্রেন্ডসেটার’।
সেই মেয়ের পুজোর সিংহাসনে প্রয়াত রাজনীতিক বাবার সাদা-কালো ছবির পাশে বাঁধানো ফ্রেমে ‘সিদো-কানহু’। শোওয়ার খাটের লাগোয়া এবড়োখেবড়ো দেওয়ালে মেটে রঙ ঘষে আঁকা বাবার স্বপ্নের ‘অখণ্ড ঝাড়খণ্ড’-এর ম্যাপ।
নিজের শর্তে বাঁচার পথে আপস করতে নারাজ হওয়ায় সেই মেয়ে ন’বছরের পুরনো প্রেম খুইয়েছেন। আর পাঁচটা সাঁওতাল মেয়ের থেকে ব্যতিক্রমী পথে হেঁটে তিনি বন্ধুহীন, একাকিনী। তবু হারতে চান না।
মারকাটারি শরীরী আবেদনের জন্য তাঁর পরিচিতি— সাঁওতালি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ‘সিল্ক স্মিতা’! তিনি তা জানেন এবং শুনে চোখ নামিয়ে লাজুক হাসেন। পরে আত্মবিশ্বাসী গলায় বলেন, ‘‘আমি শুধু জানি মানুষ পাশে আছেন। আর তাঁদের সাহায্যেই আমি নিজের একটা সিলমোহর লাগিয়ে যাব।’’
তিনি বীরবাহা হাঁসদা। বিধানসভা ভোটে পশ্চিম মেদিনীপুরের বিনপুর কেন্দ্রে ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন)-এর প্রার্থী। বীর মানে সাঁওতালিতে ‘জঙ্গল’, বাহা হল ‘ফুল’। বাবা নরেন হাঁসদা ছিলেন ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন)-এর প্রতিষ্ঠাতা দাপুটে নেতা। বিনপুরের দু’-দু’বারের বিধায়ক। মা সাঁওতাল নৃত্যশিল্পী চুনিবালাও হাঁসদা বিনপুরের বিধায়ক ছিলেন। ২০১১-য় হারেন সিপিএমের দিবাকর হাঁসদার কাছে। দুই গোঁজ প্রার্থী হার নিশ্চিত করেন তাঁর।
চুনিবালা এ বার ঝাড়গ্রাম আসনে বাম সমর্থিত নির্দল প্রার্থী। ঝাড়গ্রামেরই বিদ্যাসাগর পল্লিতে বাড়ি তাঁর। লাল মেঝেয় মেয়ের পাশে বসে চোয়াল চেপে-চেপে চুনিবালা বলেন, ‘‘তৃণমূল গত পাঁচ বছরে আমাদের উপর চরম অত্যাচার করেছে। এ বার আমার মেয়েকে গোঁজ করে বিনপুরে তৃণমূলকে হারাব। ও তৃণমূলের ভোট কাটবে। তাতে সিপিএম জিতে যাবে।’’
বীরবাহা জানেন, তাঁর জেতা কার্যত অসম্ভব। পরোয়া নেই, কারণ পাখির চোখ তৃণমূলের হার। তাঁরা মনে করেন, রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরে ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন)-এর সদস্যদের ভাঙিয়ে দলটাকেই বেপাত্তা করে দিতে চেয়েছে তৃণমূল। তাই বিনপুরে গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে সিপিএমের সেই দিবাকর হাঁসদাকেই জেতাতে চান তিনি। চান মাত্র এক বছর আগে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করে তাঁদের দল ভেঙে বেরিয়ে যাওয়া খগেন্দ্রনাথ হেমব্রমকে শিক্ষা দিতে। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক খগেন্দ্রই এ বার বিনপুরে ঘাসফুল প্রার্থী।
কিন্তু ভোটে তো প্রথম লড়ছেন না! ঝাড়গ্রাম পুরসভার গত ভোটেও প্রার্থী হয়েছিলেন বীরবাহা। সাকুল্যে ১২টি ভোট পান! তার পরেও তৃণমূলকে শেষ করার কথা বলছেন? বত্রিশ পেরোনো মেয়ে চোখে-চোখ রেখে ঠান্ডা গলায় উত্তর দেন, ‘‘আমার জীবনে কোনও কিছুই আয়াসে হয়নি। ফলে লড়াই নিয়ে আমার কোনও সমস্যা নেই। সিপিএম হোক বা তৃণমূল, দু’দলেরই টেনশন আমাকে নিয়ে। আমি এখানে প্রধান ফ্যাক্টর। আমাকে নিয়ে ওঁরা সিঁটিয়ে আছে, একটা ছাপ রাখতে পারছি। এটাই অনেক পাওয়া।’’
বাবা ছিলেন প্রাণ। তিনি আচমকা মারা যাওয়ার পর ঘিরে ধরেছিল অর্থাভাব আর নিরাপত্তাহীনতা। ভাই-বোন তখন ছোট। কলকাতায় মুরলীধর কলেজে পড়তে এলেন বীরবাহা। থাকতেন বাগমারিতে। রোজ হেঁটে গিরিশ পার্ক গিয়ে মেট্রো ধরতেন। কালীঘাটে নেমে সেখান থেকে আবার কলেজ পর্যন্ত হাঁটা। ফিরতি পথেও তাই। খাবার বলতে চাল-ডাল শুধু নুন-হলুদ দিয়ে ফোটানো। এক বার টানা সাত দিন টাকার অভাবে উপোস করে ছিলেন। বন্ধুদেরও সব খুলে বলতে পারতেন না। মুখচোরা ছিলেন, হীনমন্যতায় ভুগতেন। মানাতে পারেননি শহুরে বাঙালি সমাজের সঙ্গে।
এর পরেই আবার ধাক্কা। প্রেম ভেঙে গেল। অন্য এক জনকে বিয়ে করে সাঁওতালি প্রেমিক বাসা বাঁধল সেই কলকাতাতেই। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পরে এ বার ঘুরে দাঁড়ালেন সাঁওতালি মেয়ে। ঈশ্বরে বিশ্বাস ছেড়ে হলেন কর্মফলে বিশ্বাসী। নিজেকে বোঝালেন, পৃথিবীতে সবাই একা। আর এর কয়েক বছরের মধ্যেই হয়ে গেলেন সাঁওতালি ছবির এক নম্বর হিরোইন।
তার পর রাজনীতি।
মার্চ শেষের তপ্ত জামবনি এলাকা। কাঁকো, বরাওলি, দুধিয়া শোল, ঝাপ, মগুরা, এনাটা, দোমোহনি— প্রত্যন্ত পাথুরে গ্রামগুলোয় তাঁর বোলেরো ঘুরছে। কাচ নামিয়ে হাত নাড়তেই মাটির বাড়ির সামনে, গাছের নীচে, পথের ধারে, কুয়োর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা চেহারাগুলির চোখ বিস্ফারিত। ‘‘বীরবাহা! বারবাহা!’’ এক কোলে বাচ্চা, আরেক কোলে ঝকঝকে স্টিলের কলসি নিয়ে ছুটে এসে পা ধুইয়ে দিচ্ছেন মহিলারা। ছুঁয়ে দেখছেন, সাঁওতাল প্রথা মেনে পায়ে মাখিয়ে দিচ্ছেন সরষের তেল।
চৈত্রের ধোঁয়া ওঠা দুপুরে ঘোর লাগার মতোই ছবিগুলো। তবে এই ছবিরও অনেক রং। নেপথ্যে অনেক জটিল অঙ্ক। এই যেমন উঠোন-জোড়া আপ্যায়ন, এর সিংহভাগই যে আসলে বাড়িতে ‘হিরোইনের’ পা পড়ার উৎসাহে, সেটা বুঝতে খুব অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। আর নিজেকে ‘তোমাদেরই লোক’ বোঝানোর পথে সেটাই বীরবাহার সব চেয়ে বড় বাধা। তাঁর ফিল্মি কেরিয়ার, তাঁর সপ্রতিভ আধুনিক ‘লুক’, আঞ্চলিক টান-বর্জিত ঝরঝরে বাংলা— সবই এক একটা বাধা। গোঁড়া আদিবাসীর কাছে তাই তিনি যত না ঘরের মেয়ে, তার চেয়ে বেশি ‘আকাশের তারা’। হয়তো তাই মা-পিসি ছাড়া কোনও সত্যিকারের বন্ধু নেই বীরবাহার। আর ভোটে এর মাসুল যে তাঁকে দিতে হচ্ছে না, এমন নয়। নির্বাচন কমিশনে বীরবাহা অভিযোগ জানিয়েছেন, তাঁর ফিল্মে নামা নিয়ে তৃণমূল বলে বেড়াচ্ছে, ‘‘যে মেয়ে ইজ্জত বিক্রি করে, তাকে ভোট দেবেন না!’’
কুৎসার অভিযোগের বিচার করবে কমিশন। তবে অনেকেরই আশা, ঝাড়গ্রাম পুরসভার ‘শহুরে’ এলাকার চেয়ে বিনপুরের গ্রামে বেশি ভোটই পাবেন বীরবাহা। নরেন হাঁসদার মেয়ে হওয়াটাই সেখানে তাঁর ‘ইউএসপি’। এই পরিচয়টা যাঁরা জানেন না, প্রচারে গিয়ে তাঁদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন ‘নায়িকা’। আর প্রতি পদক্ষেপে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, রাজনীতিতে নেহাত আনকোরা তিনি নন। নিজে এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইছেন, বার্ধক্য ভাতা পান কি না, স্কুল কত দূরে, পানীয় জলের বন্দোবস্ত কেমন। শুনে একটু একটু করে যাবতীয় না পাওয়ার কথা উগরে দিচ্ছেন ছেলে-বুড়ো-মেয়েরা। গ্রামের পর গ্রাম, একই ছবি। ধামসা মাদলের সঙ্গে টানা গান হয়ে যাচ্ছে, ‘‘বীরবাহাগে, বারবাহাগে ভোট বোনএমায়ে....।’’
‘তারা’ তখন মাটিতে নেমে আসতে থাকে। হার-জিত মনে হয় তুচ্ছ। বাতাসে মহুয়ার সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে জংলা ফুলের গন্ধ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy