পিঠে মারের দাগ দেখাচ্ছেন নাজিবুল। ছবি: নির্মল বসু।
ক’দিন ধরে আশঙ্কাটা ছিলই। সত্যি হল ভোটের আগের রাতে। বাড়ির সামনে বোমা পড়ল। বাড়িতে ঢুকে ভাঙচুর চালাল দুষ্কৃতীরা। মারধর করল।
কিন্তু নাজিবুলের জেদ বাড়িয়ে দিল সেটাই। প্রথমবার ভোট দিতে গিয়েই ঝেঁটিয়ে ভূত তাড়ালেন বছর বাইশের যুবক।
এই কাজে পাশে পেলেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান, এমনকী রাজ্য পুলিশকেও। যে পুলিশের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগে এই সে দিন পর্যন্ত সরব ছিল বিরোধী দলগুলি। কিন্তু পঞ্চম দফা ভোটের আগে নির্বাচন কমিশনের হুড়ো খেয়ে তারাও নড়ে বসেছে। সোমবার যার সাক্ষী থাকল মিনাখাঁর বকচরা গ্রাম।
বকচোরার বাসিন্দা নাজিবুল লস্কর বসিরহাট কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। এসএফআইয়ের মিনাখাঁ জোনাল কমিটির সম্পাদকও তিনি। বাবা আমজেদ সিপিএমের মিনাখাঁ জোনাল কমিটির সদস্য। আগ মার্কা সিপিএম পরিবার। রবিবার বাড়ির ছাদেই তাঁরা বসেছিলেন মিটিংয়ে। দলের আরও কয়েকজন ছিলেন সেখানে।
অভিযোগ, হঠাৎই পর পর তিনটি বোমা পড়ে বাড়ির সামনে। দুড়দাড় করে সকলে নেমে আসেন নীচে। ততক্ষণে বাড়ি তাক করে শুরু হয়েছে ইটবৃষ্টি। মোবাইলে পুলিশ, দলের লোকজনকে খবর দেওয়ার চেষ্টা করেন নাজিবুলরা। তারই মধ্যে হুড়মুড় করে বাড়িতে ঢুকে পড়ে ১০-১২ জন দুষ্কৃতী। বাড়ির সকলে পালাতে পারলেও নাজিবুলকে সামনে পেয়ে শুরু হয় এলোপাথাড়ি মার। সঙ্গে ডায়ালগ, ‘‘তোদের সব ক’টার ভোট দেওয়ার সাধ মিটিয়ে দেবো?’’ বন্দুকের বাঁটের আঘাতে ছিটকে পড়েন নাজিবুল। পায়ে বাঁট দিয়ে মারে একজন। রক্তাক্ত নাজিুল উঠতে গেল পিঠে সপাসপ ঘা পড়ে বাঁশের। কোনও মতে প্রাণ বাঁচিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালান তিনি।
খবর পেয়ে রাতে পুলিশ আসে। তৃণমূলের ৬ জনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করা হয়।
নাজিবুলের কথায়, ‘‘হামলার পরে তখনও গায়ে অসহ্য যন্ত্রণা। পা কেটে রক্ত পড়ছে। কাছেই হাসপাতালে চিকিৎসা করাই। কিন্তু ঠিক করে ফেলি, যা ঘটে ঘটুক, ভোটটা এ বার দেবোই।’’
বনগাঁর একটি ভোটে ছবি
তুলেছেন নির্মাল্য প্রামাণিক।
কিন্তু এ দিন সকালে ১৪৩ নম্বর বুধে ভোট দিতে গেলে ফের তাঁর পথ আটকায় আগের রাতের দুষ্কৃতীরাই। অভিযোগ, ফের একপ্রস্থ শাসানো হয় নাজিবুলকে। ভোট দিলে গুলি খেতে হবে বলে হুমকি দেয়।
তখনকার মতো পালান নাজিবুল। কিন্তু রুখে দাঁড়ানোর জোশ তখন চেপে বসেছে মাথায়। নাজিবুল খবর দেন কংগ্রেস নেতা রাজীব বিশ্বাস-সহ দলের কয়েকজনকে। মিনাখাঁ ব্লকের যুব কংগ্রেস সভাপতি রাজীববাবু বলেন, ‘‘ সব শুনে আমরা লোকজন নিয়ে ওই বুথে মোতায়েন বাহিনীর জওয়ানদের সব জানাই। পুলিশকেও বলি। তাঁরা বলেন, কুছ পরোয়া নেহি, সকলে ভোট দিতে চলে আসুন।
কংগ্রেসের লোকজনের উপস্থিতিতেই নাজিবুল, তাঁর বাবা এবং সিপিএমের আরও কয়েকজন এরপরে বুথমুখো হন। মারধর, হুমকির অভিযোগ অবশ্য মিথ্যা এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করেছেন বসিরহাটের সাংসদ ইদ্রিশ আলি। তিনি বলেন, ‘‘যেমনটা বলা হচ্ছে, তেমন কিছু হয়নি। ভোট শান্তিপূর্ণ ভাবে হয়েছে। পড়ে গিয়ে ছেলেটা পিঠে, পায়ে ছড়ে যেতে পারে।’’
নাজিবুল বলেন, ‘‘এ বারই প্রথম ভোট দেওয়ার কথা। তা-ও নাকি দিতে দেবে না। জুলুমবাজি নাকি! মার খেয়ে আরও জেদ চড়ে গিয়েছিল।’’ আর তাঁর বাবার কথায়, ‘‘অনেক দিন ধরে রাজনীতি করি। কিন্তু ছেলেকে যে ভাবে মেরেছিল, ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। বলেছিলাম, ভোট দিয়ে কাজ নেই। কিন্তু ছেলেটা গোঁ ধরল।’’
এমন গোঁ ধরেছিলেন হাড়োয়া কেন্দ্রের অন্তর্গত ভাগ্যবন্তপুর, বহিরা এলাকার শ’তিনেক ভোটারও। রবিবার রাতে তাঁদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ। সে কথা তাঁরা জানান হাড়োয়ার সিপিএম প্রার্থী ইমতিয়াজ হোসেনকে। তিনি সোমবার সকালে সেখানে পৌঁছন। খবর দেন নির্বাচন কমিশন, কেন্দ্রীয় বাহিনীকে। বাহিনীর উপস্থিতিতে বুথমুখো হয়েছেন সকলে।
শাসনে এ দিন সিপিএমের ভোট মেশিনারি ছিল দেখার মতো। এজেন্টদের মধ্যে ২ টাকার কয়েন বিলি করে ভুয়ো ভোটার নিয়ে অভিযোগ জানানোর জন্য তৈরি রাখাই হয়েছিল। ৩০টি বাদে আর বাকি কেন্দ্রে বিরোধীদের এজেন্টও দেখা গিয়েছে। কীর্তিপুরে ভোটের লাইনে দশ হাত ছাড়া ছাড়া এক জন করে সিপিএম কর্মী দাঁড়িয়ে পড়েন ভোটের লাইনে। সেখানে এসে কেউ যাতে ধমক-চমক না দিতে পারে, সে জন্যই এই ব্যবস্থা। কীর্তিপুরের বাসিন্দারা জানালেন, ২০০৮ সালের পর থেকে এত দিন পর্যন্ত ভোটই দিতে পারেননি। এক প্রবীণ ভোটারের কথায়, ‘‘সাহস করে বেরোলাম। আর ক’দ্দিন ভয়ে ভয়ে বাঁচব!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy