বুথের বাইরে রাজ্য পুলিশ আর ভিতরে কেন্দ্রীয় বাহিনী। পাঁশকুড়া পশ্চিম বিধানসভার মাইশোরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দেবরাজ ঘোষের তোলা ছবি।
জঙ্গলমহল ও পশ্চিম মেদিনীপুরের ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী ছিল বুথের বাইরে। বিগত দু’টি ভোটেই লাঠিধারী রাজ্য পুলিশকে দেখা গিয়েছিল বুথের ভিতরে। বৃহস্পতিবার পূর্ব মেদিনীপুর জেলার পাঁশকুড়া পশ্চিম ও পূর্ব বিধানসভায় ছবিটা কিন্তু আলাদা।
লাঠি হাতে রাজ্য পুলিশের কনস্টেবল ও এনভিএফ কর্মীরা দিনভর থাকলেন বুথের বাইরে। কার্যক্ষেত্রে বুথের অনেকটা বাইরেই থাকতে হল রাজ্য পুলিশকে। ভোটারদের লাইন ঠিক করা থেকে যাবতীয় দায়িত্ব সামলালেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা। পাঁশকুড়া পশ্চিম ও পূর্ব এই দু’টি বিধানসভার বুথ গুলিতে নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল সিআইএসএফ, আরপিএফ, উত্তরপ্রদেশ পুলিশ ও রাজস্থান পুলিশের বিশেষ বাহিনী।
বৃহস্পতিবার সকাল সোয়া দশটা। পাঁশকুড়া পশ্চিম বিধানসভার অন্তর্গত উত্তর মেচগ্রাম জিএসএফ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৮৭ নম্বর বুথে ভোটারদের লাইন। কেন্দ্রীয় বাহিনী সিআইএফএসের জওয়ান শৈলেশ কুমার ভোটারদের আঙুল দেখছিলেন। সোনাডাঙা গ্রামের শোভন দাস ও মীরা দাস অবাক হয়ে প্রশ্ন করে ফেলেন, “এখনও তো ভোটই দিইনি। তাহলে কেন?” শৈলেশের জবাব, ‘‘ “কুছ ভি হো। সব কুছ চেকিং করনে কে বাদ হম আপকো বুথ কে অন্দর জানে দেঙ্গে।”
ইনসাস এবং একে ৪৭ উঁচিয়ে আরও জনা তিনেক কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান বুথের ভিতরের বারন্দায় কড়া পাহারায় রয়েছেন। বুথের বাইরে বেশ কিছুটা দূরে লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন এনভিএফ কর্মী সুকুমার মান্না। জানালেন, এর আগে দুই ২৪ পরগনা ও মুর্শিদাবাদে ভোটের ডিউটি করে এসেছেন। কিন্তু এ বার বুথের বারন্দাতেও ওঠা মানা। সুকুমারবাবু বললেন, “আজকের ভোটে নিরপেক্ষতা, কড়াকড়ি অনেক বেশি।”
উত্তর মেচগ্রামের এই বুথে ঢোকার পথে দেখেছিলাম, তৃণমূল ছাড়া আর কোনও দলের বুথ ক্যাম্প নেই। শাসক দলের লোকজন বুথের বাইরে ঘুরঘুর করছিলেন। রাজ্য পুলিশের লাঠিধারীর আপত্তিকে মোটেই পাত্তা দিচ্ছিলেন না তৃণমূলের কিছু যুবক। ইনসাস কাঁধে সিআইএসএফ জওয়ান শৈলেশ কুমার লাঠি উঁচিয়ে তাড়া করলেন তৃণমূলের জমায়েতের দিকে। তৃণমূলের লোকজন তখন পড়ি মরি করে ছুটছেন।
ভোট শুরুর মুখে সকাল সাতটায় পাঁশকুড়া পশ্চিম বিধানসভার জয়কৃষ্ণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় বুথে লম্বা লাইন। অনেকটা দূরে দাঁড়িয়েছিলেন এক এনভিএফ কর্মী। প্রতাপপুর ভীমতলায় কেন্দ্রীয় বাহিনী ও রাজ্য পুলিশের টহল চলছিল জোর কদমে। খণ্ডখোলা গ্রাম পঞ্চায়েতের গোগ্রাস বোর্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় চত্বরে সিআইএসএফের চারজন জওয়ান। মুর্শিদাবাদ থেকে আসা রাজ্য পুলিশের লাঠিধারী কনস্টেবল মহম্মদ মোজাম্মাত হোসেন একেবারে স্কুলের চৌহদ্দির বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে গজগজ করছিলেন তৃণমূলের লোকজন। বাইক দাবড়ে আসা এক তৃণমূল কর্মী ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, “এভাবে ভোট হলে তো সর্বনাশ!” সিআইএসএফ এবং রাজ্য পুলিশ কর্মী তেড়ে যেতেই অবশ্য পিঠটান দিতে বাধ্য হন শাসক দলের কর্মীরা। সকাল ৯টায় ৯০৮ জন ভোটারের মধ্যে ১৯১ জন ভোট দিয়েছেন। ভোটার গৃহবধূ খুকু দাস বললেন, “বড্ড কড়াকড়ি। ভোটার কার্ডের সঙ্গে প্রত্যেকের চেহারা মিলিয়ে বুথে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে।”
সকাল দশটায় পাঁশকুড়া বনমালী কলেজের বুথের বাইরে ছিলেন মুর্শিদাবাদ জেলার পুলিশ কনস্টেবল লিটন মণ্ডল। বললেন, “আমাদের ভিতরে যাওয়ার অনুমতি নেই। তাই বাইরে থেকেই ভোটারদের দেখে ছাড়ছি।” এই কলেজেই কয়েক দিন আগে শুভেন্দু অধিকারী জেলার কয়েকজন ওসিকে নিয়ে বৈঠক করেছিলেন বলে অভিযোগ করেছিল সিপিএম। এই বুথের ভিতরে সিসিটিভিতে অনলাইন নজরদারি চলছে। মোবাইল, ছাতা নিয়ে ভোটারদের ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। সিআইএসএফের সাব ইন্সপেক্টর কপিলকুমার বললেন, “অবাধ ও নিরপেক্ষ ভোট করাতে এসেছি। কোনও রকম অভিযোগ যাতে না ওঠে সে জন্য আমরা তৎপর।”
মাইশোরা অঞ্চলে একচেটিয়া তৃণমূলের আধিপত্য। কয়েকটি বুথে এজেন্ট দিতে পারেনি বামেরা। খুবই স্পর্শকাতর মাইশোরা এলাকার শ্রীকৃষ্ণ প্রাথমিক বিদ্যালয় চত্বরেই ছিল সেক্টর অফিসও। খবর এল পশ্চিম পাড়ার বেশ কিছু বিরোধী সমর্থককে ভয় দেখানো হয়েছে। তাঁরা ভোট দিতে আসতে পারছেন না। বাহিনীর গাড়ি বেরিয়ে পড়ল। মাইশোরা-শ্যামপুর পিচ রাস্তার ধারে তৃণমূলের জমায়েত দেখে বাহিনী ধাওয়া করতেই শাসকদলের লোকজন কংসাবতী খাল পেরিয়ে সব ধা।ঁ কমলা জামা পরা এক যুবক ও তাঁর সঙ্গী ঘুরপথে চম্পট দিতেই বাহিনীর গাড়ি উল্টো পথে ধাওয়া করে ধরে ফেলল ওই দুই যুবককে। তারপর বেধড়ক লাঠিপেটা।
পাঁশকুড়া পূর্ব বিধানসভা এলাকাতেও ছিল সেই একই কড়াকড়ির ছবি। তা সত্ত্বেও বিক্ষিপ্ত ঘটনা এড়ানো যায়নি। সকাল ১১টা নাগাদ আমলহাণ্ডা পঞ্চায়েতের বাড়বহলা এলাকায় গোপালগঞ্জ প্রিয়নাথ বাণীভবন হাইস্কুল বুথের বাইরে তৃণমূলের জমায়েত দেখে সেক্টর অফিসে ফোন করে খবর দিয়েছিলেন এক সিপিএম কর্মী। প্রবোধ সাহু নামে ওই সিপিএম কর্মীকে বেধড়ক মারধর করার অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। মারের চোটে প্রবোধবাবুর দু’টি চোখ গুরুতর ভাবে জখম হয়। গোলমালের জেরে কিছুক্ষণ ভোটগ্রহণ বন্ধ থাকে। ওই বুথে উত্তরপ্রদেশ সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর জওয়ানরা জানালেন, বুথ চত্বরের বাইরে গোলমাল হয়েছিল। পাঁশকুড়া পূর্ব বিধানসভার বড়িশা প্রাথমিক ও জুনিয়র হাইস্কুলের বুথে গিয়ে দেখা গেল নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন রাজস্থান পুলিশের এমবিসি বাহিনীর জওয়ানেরা। শেষ বিকেলে চওড়া গোঁঁফের জওয়ান হিম্মত সিংহ জানালেন, “একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে দুপুরে মাংস-ভাত খাওয়ানোর জন্য জোর করেছিল। আমরা কিন্তু সেই আবদার মানিনি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy